জাতীয় ঐক্যের ডাক সময়ের দাবি
16 May 2018, Wednesday
দেশ-বিদেশের নানা ঘটনার মধ্যে আবার পবিত্র মাহে রমজান আমাদের দ্বারপ্রান্তে। রোজা এক মাসের জন্য পরিবেশ পাল্টে দেবে। এর বৈশিষ্ট্যটাই পরিবেশ পাল্টে দেয়। কেউ পাল্টাবেন ইতিবাচক অর্থে; কেউ পাল্টে যাবেন নেতিবাচকভাবে। কিন্তু রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের আবেদন ফুরাবে না। তারপরও শ্রেণী নির্বিশেষে অনেক পেশাজীবীও পাল্টে যাবেন।
সেটা রাজনীতিকে যেমন পাল্টে দেবে, তেমনি দেশের অর্থনীতি-সমাজ সংস্কৃতি সব কিছুকে পাল্টে দেবে। বিশেষত বাংলাদেশের একশ্রেণীর মানুষ রোজাকে শুধু ইবাদতের মাস হিসেবে দেখেন না। নানা শ্রেণীর মানুষের কাছে রোজা ধরা দেবে নানাভাবে। কারো কাছে এর অর্থনৈতিক গুরুত্বই বেশি। কারণ তিনি এটি কাজে লাগাবেন তার অর্থনীতিকে স্ফীত করার লক্ষ্যে। রোজার সাথে যোগ হবে অর্থনীতির নানা ধরনের কর্মকাণ্ড। এর সুযোগ নেবেন অনেকেই। কিছু লোক অবশ্যই ব্যতিক্রম। তাদের কাছে রোজা মানে ইবাদতের মওসুম, নিজেকে পরিশুদ্ধ করার একটা সুবর্ণ সুযোগ। এই ধরনের পরিশুদ্ধ মনের মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার কথা নয়। আবার এ মাসে প্রচুর টাকা উড়বে। মজুদদার, মুনাফাখোর, ভেজালকারী, তারা নেবে অসৎ আয়ের সুযোগ হিসেবে। তারাও রোজা রাখবে। কার্যত তারা রোজা পালন করবে না। তাদের কাছে রোজা প্রকৃত অর্থে ধরাও দেবে না। বরং সারা বছরের কামাই-রোজগার করে নেয়ার এই একটি মাস তারা কড়ায় গণ্ডায় হিসাব করে স্বার্থ হাসিলের কাজে লাগাবে।
রাজনীতিবিদরা অবশ্য ইফতার-সংস্কৃতির বাইরে তেমন কিছু একটা করার মওকা পাবেন না, বিরাজমান রাজনৈতিক পরিবেশ সেই সুযোগ দেবে না। তবে রাজনীতিতে যে সব বণিক শ্রেণীর উপস্থিতি, সেসব রাজনীতিবিদ অবশ্য বণিকের স্বার্থে নিজেদের ব্যস্ত রাখতে কার্পণ্য করবেন না।
এটা ঠিক, বাংলাদেশের রাজনীতি রোজার মাসে ইফতার-সংস্কৃতিতে প্রবেশ করলেও রাজনীতির মেরুকরণের কাজটা ঠিক মতোই চলবে। কারণ বছরটা সম্ভবত জাতীয় নির্বাচনের। তাই রোজার সুযোগেও সংশ্লিষ্ট মেরুকরণের কাজটা বন্ধ থাকার কথা নয়।
জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিকসহ প্রতিটি খাতের অভ্যন্তরীণ চিত্র দেশবাসীর সামনে খাতওয়ারি তুলে ধরার দায়িত্ব নিয়েছে বিএনপি। সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ এই কাজটি করতে পারলে প্রকৃত বিরোধী দলীয় দায়িত্ব পালনই হবে।
বিএনপি এমন কাজ করে বিরোধী দল হিসেবে অবশ্য রাজনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে বলেই মনে হয়। তারা ক্ষমতাসীন সরকারের বিগত দিনের কর্মকাণ্ডের হিসাব খাতওয়ারি তুলে ধরার চেষ্টা করছে। একটা গবেষণা সেল এই বিষয়ে কাজ করেছে। এখনো করছে বলেও জানিয়েছে। তারা খাতওয়ারি কী পরিমাণ লোপাট হয়েছে কোথায় কতটা দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে এবং কোন কোন খাতে; নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে কিভাবে, ক্ষমতাচর্চায় কী কী বাড়াবাড়ি করা হয়েছে, এসব ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরার কাক্সিক্ষত উদ্যোগ নিয়েছে। রাস্তায় মিছিল করার সুযোগটুকু বন্ধ। শান্তিপূর্ণ জনসভারও অনুমতি নেই। রাজনৈতিক তৎপরতায় গণতন্ত্র চর্চার সাংবিধানিক সুযোগ অবারিত নয়। অবরুদ্ধ ও গণতন্ত্রে সরকারের ব্যর্থতার ও দুর্নীতির খতিয়ানটা তুলে ধরা সম্ভব হলে বিএনপির রাজনীতির গণভিত্তি ও সমর্থন বাড়বে। জনগণের কাছে পৌঁছার এটা একটা সহজ সুযোগ। বিশ্বাসযোগ্যভাবে অনিয়ম, দুর্নীতি ও দলবাজির সব তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা সম্ভব হলে জাতির জন্যও কল্যাণ। বাস্তবে এটি হবে একটি ছায়া সরকারের ভূমিকা পালনের মতো, যা মিটিং মিছিলের চেয়ে আবেদন রাখবে অনেক বেশি।
হ্যাঁ, এর মোকাবেলায় সরকারি দল নিজেদের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরতে কার্পণ্য করবে না। উন্নয়নের ফিরিস্তিটা তারা ফলাও করে প্রচার করবে। যাবতীয় সরকারি সুযোগ কাজে লাগিয়ে এই কাজটা শাসক দল অধিকতর মুন্সিয়ানার সাথে করার চেষ্টা করবে, যা ইতোমধ্যে করা শুরু করেছে। যেমন, বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতায় শুধু ব্যাংক খাতে দুই লাখ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। তবে রিজার্ভ তছরুপ বা চুরির ঘটনা থেকে ব্যাংকের পুঁজি তুলে নেয়া পর্যন্ত, দখলদারি থেকে কুঋণ পর্যন্ত হাজারো প্রক্রিয়ায় ব্যাংকগুলোকে ফোকলা করে ফেলার কথা সবাই বলছে। বিএনপি সবার মতো ‘বাজারি কথা’ বললে চলবে না। তাদেরকে তথ্য-উপাত্তসহ বস্তুনিষ্ঠতা ও সততার সাথে বিষয়টা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে। দুর্নীতির খতিয়ান তুলে ধরার ক্ষেত্রে বিরোধী দল হিসেবে শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। সঠিকভাবে বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে সুনির্দিষ্ট সত্য কথাটাই তুলে ধরার চেষ্টা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সত্যনিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ হওয়া জরুরি। এভাবে প্রকৃত চিত্র উঠে আসা বা তুলে আনাটা একটা বড় ধরনের জাতীয় কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের কথা ফলাওভাবে প্রচার করেছিল। ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির কার্যগুলো সেখানে তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ‘হাওয়া ভবনের’ বিরুদ্ধে প্রচার প্রপাগান্ডার পরিবর্তে সত্যনিষ্ঠ প্রমাণসহ অভিযোগগুলো তুলে ধরার কথা দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তবে আওয়ামী লীগ তেমন কিছু তুলে ধরতে পারেনি। গৎবাঁধা প্রচার-প্রপাগান্ডা চালিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করেছে মাত্র। এখনো তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হাওয়া ভবনের প্রসঙ্গ উঠে থাকে। আমরা আশা করেছিলাম, আওয়ামী লীগ বাস্তবে সাক্ষ্য-প্রমাণসহ বক্তব্য উপস্থাপন করবে। কার্যত সরকার সেদিকে নজর না দিয়ে নিন্দামন্দ করেই রাজনীতি শেষ করেছে। এখনো ‘লন্ডন ষড়যন্ত্র’ নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। জনগণ আসলে জানতে চায় ‘ষড়যন্ত্রটা’ কী, কারা কিভাবে, কার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। শেষ পর্যন্ত একটা পাসপোর্ট বিতর্ক তুলে ধরে সরকার নিজেকে খেলো করে দিয়েছে। জনগণ দেখল পর্বত একটা মূষিক প্রসব করল মাত্র, তবে এর রাজনৈতিক তাৎপর্য কিছুই নেই।
শুধু বিএনপি কেন, সব বিরোধী দল ও নেতা সরকারের দুর্নীতির কথা বলছেন। কিন্তু তথ্য-উপাত্তসহ সেসব তুলে ধরার কোনো গরজ দেখি না। ডক্টর কামাল, বি. চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান মান্নাÑ তারাও সরকারের লোপাটতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলেন, দলীয়করণের অভিযোগ তোলেন, অথচ জনগণ বাস্তব ও নির্দিষ্ট নজির ও উপমা চায়।
এ জাতীয় নেতাদের বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে, তারা তিক্ত সত্য বলেন; কিন্তু বলাটা শেষ করেন না।
দেশে গণতন্ত্রচর্চা নেই, জনগণ মনের কথা বলতে পারছে না। নাগরিক অধিকারগুলো সীমিত করে ফেলা হয়েছে, আইনের শাসন নেই, এসব কথা এখন প্রমাণ দিয়ে সাক্ষী-সাবুদসহ বলার সময় এসেছে। জনগণ শুধু বক্তৃতায় বিশ্বাস না করে তথ্যে বিশ্বাস করতে চায়। কারণ সামনে সম্ভবত জাতীয় নির্বাচনের মুলো ঝুলানো রয়েছে। এই মুলো যাতে ঝুলিয়েই বাজিমাৎ করার কাজটা শেষ করা না যায় সেই চেষ্টা করা উচিত।
অনেক জাতীয় নেতা ঐক্যের ডাক দিচ্ছেন। একবার ডাক দেন তো, দশবার ভাবেন; আবার দম নিয়ে ক’দিন পরে নতুন করে যখন জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হয়; তখন আগের বক্তব্যের রেশ শেষ হয়ে যায়। ততদিনে সরকারি দল নতুন কোনো পরিকল্পনা নিয়ে রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়, আর গণতন্ত্রের পথে হাঁটার হুঙ্কার মৃদু হয়ে পড়ে। আমরা বলছি না, সরকারকে কালই উপড়ে ফেলতে হবে। বরং বলছি, সরকারের বরফ গলে গেছে। সরকার নিজেই এমন কোনো নিরাপদ পথের সন্ধান করছে যাতে কোনোভাবে নিরাপদে অবতরণ করা সম্ভব হয়।
সেটা জাতীয় নির্বাচনের পথ ধরে হলেই সবার জন্য মঙ্গল। সমস্যা হচ্ছে, সরকার বাধ্য না হলে জাতীয় নির্বাচনের জন্য একটা মসৃণ সড়ক কেন নির্মাণ করবে? এই জন্য বাধ্য করার বিষয়টি হতে হবে গণতন্ত্রে সিদ্ধ এবং একমাত্র স্বীকৃত প্রক্রিয়ায়। সেই প্রক্রিয়ায় যাওয়ার জন্য সরকারকে বাধ্য করতে হলে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে ঘরে বসে থাকলে পথ ফুরাবে না।
তাই যারা জাতীয় ঐক্যের ডাক দিচ্ছেন তাদের প্রধান দায়িত্ব ঐক্যের ফ্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, ন্যূনতম কর্মসূচিতে একমত হওয়া, মোটা দাগে সরকারের ব্যর্থতাগুলো তুলে ধরা এবং সেটা জাতীয় প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে তুলে ধরা, তাতেই ক্ষমতাসীন দল চোখে অন্ধকার দেখবে।
অন্য পন্থায় সরকার পরিবর্তনের ওপর তেমন কোনো ভরসা করে লাভ নেই। বিদেশীরা শক্তের ভক্ত, নরমের যম। তা ছাড়া কোনো বিদেশী নিজেদের স্বার্থের বাইরে যাওয়ার প্রশ্ন উঠবে কেন?
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন