Image description
পিটিয়ে হত্যা, মারধর করে দেওয়া হয় পুলিশে, লুটপাট, হেনস্তা, জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানোর ভিডিও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়াসহ ঘটছে ভয়ংকর সব ঘটনা

গত বৃহস্পতিবারের ঘটনা। কুমিল্লার মুরাদনগরের বাঙ্গরা বাজার থানার আকুবপুর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের কড়াইবাড়ি গ্রামে মব সৃষ্টি করে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই এলাকার সর্বত্র এখন আতঙ্ক। মানুষ ঘরছাড়া। ১ জুলাই চট্টগ্রামের পটিয়ায় মব সৃষ্টি করে থানায় হামলা চালানো হয়। রাজধানীর মহাখালীতে হোটেল জাকারিয়া ইন্টারন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বারে ভিআইপি কেবিন না পেয়ে হামলা ও ভাঙচুর করেন বনানী থানা যুবদলের আহ্বায়ক মনির হোসেন ও তাঁর সহযোগীরা। লালমনিরহাটের পাটগ্রামে মব সৃষ্টি করে থানায় হামলা চালিয়ে সাজা পাওয়া দুই আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। হামলায় ওসিসহ আহত হয়েছেন ৩০ জন।

এমন সব ভয়ংকর মব সন্ত্রাস এখন সারা দেশে। এতে মানুষের মধ্যে এখন অজানা আতঙ্ক। মবের নামে পিটিয়ে হত্যা, মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া, লুটপাট, হেনস্তা, পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া, জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানো, ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়াসহ ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটছে। রাজনীতিবিদ, পুলিশ, শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক থেকে শুরু করে চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ মবের শিকার হচ্ছে। থানাও বাদ পড়ছে না মব সন্ত্রাস থেকে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জেরে ও ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে টার্গেট করেও ‘মব সন্ত্রাস’ তৈরি করা হচ্ছে।

সরকারের উপদেষ্টারা কয়েক মাস ধরে মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। মাঝেমধ্যে উদ্যোগ দেখা গেলেও কোনোভাবেই মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

এ অবস্থায় দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এভাবে প্রকাশ্যে সংঘবদ্ধভাবে পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনায়, মৃত্যুর ঘটনায় দায় কার-এই প্রশ্ন সামনে এসেছে। মানবাধিকারকর্মী, অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীরা এসব ঘটনা বন্ধ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ কে এম নূরুল হুদার ওপর হামলার পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, মব জাস্টিস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ কে এম নূরুল হুদার ওপর যা ঘটেছে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই ওনার ওপর হামলা হয়েছে। এ জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তদন্ত করে দেখা হবে কারা এর সঙ্গে জড়িত। যদি কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য জড়িত থাকেন, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি কোনো অপরাধী থাকে, তাহলে তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করবেন। বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কোনো অবস্থাতেই হাতে আইন তুলে নেওয়া যাবে না।

গবেষণা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত জুন পর্যন্ত ১০ মাসে ২৫৩টি মব সন্ত্রাস ঘটে। এতে ১৬৩ জন নিহত এবং ৩১২ জন আহত হন।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জুনে দেশে অন্তত ৪১টি গণপিটুনির ঘটনায় ১০ জন নিহত হন। গুরুতর আহত হন ৪৭ জন। গণপিটুনির শিকার ৩০ জনকে আহত অবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়। ডাকাতি, চুরি, খুন, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, কটূক্তি প্রতারণা ও অপহরণের অভিযোগ এনে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে তাদের। এমএসএফ মনে করে, আইন অবজ্ঞা করে মব সহিংসতা তৈরি করে সমাজে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে এক ভয়াবহ পরিবেশ তৈরিতে জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দায়িত্ব।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি-মে) গণপিটুনিতে ৭৮ জন নিহত হয়েছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে গণপিটুনির ঘটনায় ৭৫ জন নিহত হন। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) হিসাবে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত মে পর্যন্ত ৯ মাসে মব সন্ত্রাস ঘটেছে ২০২টি। এসব ঘটনায় ১৩১ জন নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হন ১৬৫ জন।

সংঘটিত মব সন্ত্রাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাধারণ মানুষের ওপর হামলা ও গণপিটুনির ঘটনা বেশি ঘটছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মব তৈরি করে হামলা চালানো হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে পেশাদার অপরাধী ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও মব তৈরি করছেন।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের মামলায় শাস্তির নজির নেই বললেই চলে। ফলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ কাজে লাগাচ্ছে আরেক অপরাধী চক্র; গণপিটুনির ফাঁদে ফেলে মারধর ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। নিরপরাধ মানুষও ফাঁদে পড়ে মারধর ও হত্যার শিকার হচ্ছেন। এ ধরনের অপরাধে জড়িতদের কঠোর আইনগত ব্যবস্থার মুখোমুখি করতে হবে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা এসব কাজে জড়িত থাকলে দল থেকে বহিষ্কারসহ নির্মোহ কঠোর পদক্ষেপই গণপিটুনির মতো ঘটনা কমিয়ে আনতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, মব ছোঁয়াচে অসুখের মতো। এটা বন্ধ করতে না পারলে ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে। যে কোনো পরিস্থিতিতে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা তৈরি হয় এবং এসব ঘটনায় যারা সংখ্যার বিচারে শক্তিশালী হয়, তারা দুর্বলদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখন যে মব হচ্ছে সেগুলো একেবারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং প্রমাণও থাকতে পারে। সেটি আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধান হবে। এখন মানুষ যদি নিজেই আইন তুলে নেয়, তাহলে দুই পক্ষের মধ্যে নৈতিক কোনো ব্যবধান থাকবে না।