মিয়ানমারে সামরিক শাসন ও রোহিঙ্গা সমস্যা
20 September 2017, Wednesday
মিয়ানমারে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর যেভাবে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ এবং খেদাও অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, এ পরিস্থিতিতে আমাদেরকেও এ বিষয়ে লিখে যেতে হচ্ছে।
বিশেষ করে এজন্য যে, মিয়ানমার বা বার্মায় এখন যেভাবে ও যা ঘটছে এটা শুধু মিয়ানমারেরই ব্যাপার নয়, এর সঙ্গে এখন পুরো সাম্রাজ্যবাদী মহল যুক্ত হয়েছে।
চীন, রাশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, সৌদি আরব, ইসরাইল ইত্যাদি দেশের নিজেদের মধ্যে যতই দ্বন্দ্ব-বিবাদ থাকুক, তারা এখন মিয়ানমার পরিস্থিতিকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্য প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমার সরকারের পেছনেই সমর্থন জোগাচ্ছে এবং তারাই হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ফ্যাসিস্ট ও ক্রিমিনাল জাতিরাষ্ট্রের শক্তির উৎস।
লক্ষ্য করার বিষয় যে- চীন, রাশিয়া, ভারত ইত্যাদি রাষ্ট্র মিয়ানমার সরকারের পক্ষে থাকলেও তারা এখন বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কিছু ত্রাণসামগ্রী পাঠাচ্ছে।
যে পরিমাণ সাহায্য তারা পাঠাচ্ছে সেটা তাদের জন্য তুচ্ছ ব্যাপার। কিন্তু আসল কথা এটা নয়। আসল কথা হল, এ প্রসঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও তার সরকার যা বলেছে তাই।
তারা বলেছে, আমরা বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য মানবিক কারণে সাহায্য পাঠালেও আমরা রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমার সরকারের সমর্থক! রাশিয়া এটা চরম ঔদ্ধত্যের সঙ্গে খোলাখুলিভাবে বললেও এটাই হল প্রতিটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের মৌলিক অবস্থান।
এদের এই অবস্থান যে কতখানি অযৌক্তিক এটা বোঝা যাবে তাদের নিজেদের বক্তব্য থেকেই। রাশিয়া মানবিক কারণে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ পাঠাচ্ছে। কিন্তু এই ‘মানবিক’ কারণ কিভাবে সৃষ্টি হল?
কাদের অমানবিক সশস্ত্র হামলার কারণে এই মানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে? কারা রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে, নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে হত্যা করে তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে?
এদিক থেকে বিচার করলে রাশিয়া, চীন, ভারত ইত্যাদি দেশের চরম সুবিধাবাদী অবস্থান বোঝার কোনো অসুবিধা হবে না। এরা এখন বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কিছু সাহায্য পাঠালেও মিয়ানমারের ফ্যাসিস্ট সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে সেখানে নিজেদের সুবিধাবাদী অবস্থান গড়ে তোলা বা রক্ষার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, মিয়ানমারে এ ধরনের কোনো স্বার্থ না থাকলেও ‘মুসলিম উম্মাহর’ নেতা হিসেবে দাবিদার সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অবস্থান ও স্বার্থরক্ষার জন্য এক্ষেত্রে রোহিঙ্গা মুসলমানদের এত বড় বিপদেও একটা কথা বলছে না।
তার সাম্রাজ্যবাদী প্রভুরা পর্যন্ত বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কিছু সাহায্য পাঠানোর ব্যবস্থা করা ও তার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও সৌদি আরব এক ছটাক সাহায্যও পাঠায়নি। পাঠানোর কোনো কথাও তাদের থেকে শোনা যাচ্ছে না। উপরন্তু এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের চরমতম শত্রু ইসরাইল এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিত্র হিসেবেই তারা নিজেদের অবস্থান রক্ষা করছে!
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপের ঘোষণা এখনও পর্যন্ত দেয়নি। বাণিজ্য ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের চিন্তা তাদের নেই। কারণ মিয়ানমারের সঙ্গে অস্ত্র বাণিজ্য থেকে সবরকম বাণিজ্য বিস্তারের চিন্তার দ্বারাই নিরাপত্তা পরিষদের সাম্রাজ্যবাদী সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ঔপনিবেশিক নীতি নির্ধারিত ও পরিচালিত হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলা দরকার যে, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সাহায্য পাঠাব, কিন্তু রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমার সরকারকেই সমর্থন করব’- রাশিয়ার এ বক্তব্যের মধ্যে তাদের শোচনীয় নৈতিক পরাজয়ের প্রমাণ ছাড়া আর কী আছে? এই পরাজয়ের কারণেই মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতিসংঘের চলমান সাধারণ অধিবেশনে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি যে মুসলমানদের কত বড় শত্রু তার প্রমাণ তিনি এভাবে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকার মধ্য দিয়েই প্রমাণ করলেন। তিনি ও সু চি এটা প্রমাণ করলেন যে, জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়ে নিজেদের মুখ দেখানোর মতো মুখ আর তাদের নেই।
এবার মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের একটি বিশেষ দিকের কথা বলা দরকার। সু চি যে সামরিক সরকারের সঙ্গে এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ একমত এবং তিনি যে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বের মতো অতি নিকৃষ্ট জাতিগত ফ্যাসিস্ট, এর ভূরি ভূরি প্রমাণ তিনি বরাবরই রেখেছেন। দু’-তিন দিন আগে তাদের পার্টির এক মুখপাত্র বেশ খোলাখুলিভাবেই বলেছেন, সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তাদের অনেক বিষয়ে মতপার্থক্য আছে, কিন্তু রোহিঙ্গা প্রশ্নে তারা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। এক্ষেত্রে তাদের নীতি একেবারে অভিন্ন! সু চি তাদের পার্টির মুখপাত্রকে দিয়ে একথা বলালেও এটা এক কঠিন সত্য যে, তাদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর ‘অনেক মতভেদ’ সত্ত্বেও তারা সামরিক বাহিনীরই পদলেহী এবং সামরিক বাহিনীর নির্দেশেই তারা এখন একধরনের বেসামরিক সরকার হিসেবে ক্ষমতায় রয়েছেন।
বাস্তবত একটা দেশের সরকার বলতে যা বোঝায় সু চির সরকার সে রকম নয়। কোনো সরকারের হাতে যদি সামরিক বাহিনী ছাড়াও পুলিশসহ অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তাহলে তাকে প্রকৃত অর্থে সরকার বলা চলে না।
অনেক দেশে সামরিক বাহিনী শক্তিশালী অবস্থানে থেকে বেসামরিক ও নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা সীমিত রাখে। কিন্তু মিয়ানমারে এ ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থা আছে, তা অন্য কোনো দেশে নেই। সামরিক বাহিনীর দ্বারা প্রণীত যে সংবিধান অনুযায়ী সু চি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ক্ষমতায় বসেছেন, সে সংবিধানে এটা বিধিবদ্ধ আছে যে, দেশের স্বরাষ্ট্র ও দেশরক্ষা মন্ত্রণালয় সরাসরি সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্বে ও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। অর্থাৎ বেসামরিক নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলেও তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনীসহ কোনো ধরনের সশস্ত্র বাহিনী বা বলপ্রয়োগকারী সংস্থার ওপর থাকবে না।
এই অবস্থা প্রকৃতপক্ষে ডানাকাটা পাখির মতো। যে সরকারের হাতে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা থাকে না তাকে সরকার বলা এক হাস্যকর ব্যাপার। মিয়ানমারে সু চির নির্বাচিত বেসরকারি সরকার এ ধরনেরই এক সরকার। মিয়ানমারে এখনও প্রকৃত শাসনকর্তা সামরিক বাহিনীর প্রধান মিন অং হ্লাইং। এক্ষেত্রে বলা দরকার যে, সু চি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে এ ধরনের ‘সমঝোতা’ করেই ক্ষমতায় এসেছেন।
তাকে ‘গণতন্ত্রের মহানায়িকা’ বলে আখ্যায়িত করে নোবেল প্রাইজ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কিভাবে একজন গণতন্ত্রী সামরিক বাহিনীর দ্বারা প্রণীত এই সংবিধানকে মেনে নিতে ও তার অধীনে নির্বাচনে যেতে পারেন?
ক্ষমতার জন্য পাগল হয়ে এ ধরনের সংবিধানকে শিরোধার্য করে ক্ষমতায় যাওয়ার সঙ্গে গণতন্ত্রের কী সম্পর্ক? কোনো সম্পর্ক যে নেই তার প্রমাণ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে তারা যেভাবে রোহিঙ্গা নিধন করছে, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে, তাদের হাজার হাজার হত্যা করে দেশত্যাগ করিয়ে অন্য দেশে শরণার্থী হতে বাধ্য করছে এর মধ্যেই পাওয়া যায়।
মিয়ানমারে এখন যে সংবিধান আছে এ সংবিধানের অধীনে শুধু যে রোহিঙ্গাদের ওপরই নির্যাতন করা হচ্ছে তাই নয়, সমগ্র মিয়ানমারে সবরকম শ্রমজীবী এবং অন্য জাতিগোষ্ঠীর ওপরও নানা ধরনের নির্যাতন আছে। এই সংবিধান ফ্যাসিস্টদের সংবিধান। সু চি এই সংবিধান মেনে নিয়ে তার অধীনে নির্বাচনে গিয়ে সরকার গঠন করে প্রমাণ করেছেন যে, তিনিও একজন ক্ষমতালোভী ফ্যাসিস্ট ছাড়া আর কিছু নয়।
এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করে তাদের দেশে ফিরিয়ে দিয়ে নাগরিক অধিকার দেয়া হলেও তার দ্বারা এই সরকারের ফ্যাসিস্ট চরিত্র পরিবর্তিত হবে না, হতে পারে না।
কারণ এর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মানুষের মতো বাঁচার ও জীবনযাপনের অধিকার যেমন নিশ্চিত হবে না, তেমনি নিশ্চিত হবে না মিয়ানমারের কৃষক, শ্রমিক ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতির এসব অধিকার। তাই সু চির মতো বেঈমান নেত্রীর দিকে তাকিয়ে না থেকে মিয়ানমারের জনগণকেই সংগ্রাম করতে হবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য, সামরিক বাহিনী প্রণীত বর্তমান সংবিধান ফেলে দিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য। এভাবে মিয়ানমারের জনগণ যতদিন না এগিয়ে আসতে ও সংগ্রাম শুরু করতে পারছেন, নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারছেন, ততদিন পর্যন্ত মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না এবং দেশটির ফ্যাসিস্ট সরকার ও তাদের সাম্রাজ্যবাদী মিত্ররা সেখানে নিজেদের শোষণ-শাসনব্যবস্থা চালিয়ে যাবে। বিদ্যমান পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে না।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন