সমাজ পরিবর্তন সম্পর্কে যেসব প্রথাগত শব্দ ও ধারণা আমাদের সমাজে জারি রয়েছে, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুখস্থ উচ্চারণ; সক্রিয় ও সজীব চিন্তার সঙ্গে তার সম্পর্ক সামান্যই। আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে চেনাজানা শব্দ বা ধারণা নিয়ে বিচার ও পর্যালোচনার আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। এই অবস্থা এখন লোহার মতো শক্ত হয়ে গিয়েছে, ভাঙা রীতিমতো মুশকিল। কিন্তু সমাজ ও রাজনীতির সংস্কার বলি কিংবা বৈপ্লবিক রূপান্তর- চেনাজানা শব্দ ও ধারণা নিয়েই আমরা মেরামতের কাজ কিংবা ভেঙে আবার নতুনভাবে গড়ার কথা ভাবতে পারি। সেই মোতাবেক কাজ করি। তাহলে সেই শব্দ বা ধারণাগুলো বলতে আমরা কী বুঝি, তার সঙ্গে আমরা কী অর্জন করতে চাই, তা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।
কিন্তু আমরা কি আদৌ বোঝাবুঝির ধার ধারি? অথচ আমরা হরদম বিপ্লব, গণতন্ত্র, সুশাসন, সংবিধান, আইন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ নানান পরিভাষা ব্যবহার করে যাচ্ছি। এ শব্দগুলো দিয়ে আমরা কী বুঝি আসলে? এই শব্দগুলোকে আশ্রয় করেই সমাজ, রাজনীতি, শাসনব্যবস্থা বা রাষ্ট্রের কায়কারবারে আমরা অংশগ্রহণ করি। তাহলে কীভাবে শব্দগুলো আমরা বুঝি, তার সঙ্গে আমাদের চলমান রাজনীতি সরাসরি জড়িত।
বিদ্যমান রাজনীতির পর্যালোচনা করতে গিয়ে অতি পরিচিত দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দ নিয়ে নানান সময়ে আমি লেখালেখি করেছি। এতে কিছু কিছু ফল হয়নি তা নয়; কিন্তু যে ফল পেলে আমরা পাথরের মতো শক্ত হয়ে থাকা চিন্তার দেয়াল ভাঙতে পারি, সেই ফল পাওয়া অনেক সাধ্য সাধনার বিষয়। তাতে কোনো ক্ষোভ নাই। একটি সমাজ চিন্তার ক্ষেত্রে হঠাৎ বিরাট কিছু বদল ঘটিয়ে দিতে পারে না। এটা একটি শ্লথ ও নীরব প্রক্রিয়া। তাছাড়া এর সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সাহিত্য চর্চা ইত্যাদির সম্পর্ক রয়েছে। দুই-একটি লেখা কিংবা কোনো একটি মহাগ্রন্থ লিখলেই সমাজ রাতারাতি বদলে যায় না। কিন্তু চিন্তাশীল লেখালেখি, অর্থাৎ সজীব ও সক্রিয় চিন্তার চর্চা ছাড়া একটি সমাজের পক্ষে সংস্কার কিংবা বিপ্লব কোনোটিই সম্ভব নয়।
সমাজে চিন্তার স্তর কোথায় কোন অবস্থায় রয়েছে সেটা পত্রিকার কলাম পড়ে বাংলাদেশের যে কোনো বুদ্ধিমান মানুষ আন্দাজ করতে পারবেন। কিংবা টেলিভিশনের টকশোতে কারা কী বিষয় নিয়ে কীভাবে কথা বলছেন তার দ্বারাও বুদ্ধিমান শ্রোতা অনেক কিছুই বুঝতে পারেন। এগুলো প্রাথমিক ব্যারোমিটারের মতো। তবে আমরা কোথায় আছি সেটা একমাত্র পর্যালোচনামূলক লেখালেখির মধ্য দিয়েই শনাক্ত করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে কোনো শর্টকাট নাই।
আমি মনে করি, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কয়েকটি নির্ধারক পরিভাষা আছে, যার পর্যালোচনা ছাড়া বাংলাদেশে কোনো ইতিবাচক রূপান্তর অসম্ভব। যেমন, ‘বিপ্লব’। এই ধারণাটি বলতে আমরা কী বুঝি? তরুণ বয়সীদের জন্য এটা অনেকটা জেমসের গান কিংবা হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের মতো। বোঝার দরকার নাই, শব্দটির ঝংকার আর ভালো লাগাই আমাদের বুদ্ধিকে জয় করে নেয়। শেষাবধি তা আবেগ ও বাগাড়ম্বরের অধিক কিছু হয় না। হয়ে ওঠে গান গাওয়া বা গল্প বলার মতো কাল্পনিক ব্যাপার, যেখানে বুদ্ধির ব্যবহার বা প্রজ্ঞার বিচার-বিবেচনার দরকার নাই।
‘বিপ্লব’ শব্দটি বাম মহলের ধারণা। কিন্তু মার্কস, লেনিন, মাও জে দং বা অন্য কোনো বিপ্লবী এ ধারণাটি কোন্ অর্থে কীভাবে ব্যবহার করেছেন সে ব্যাপারে আমাদের সমাজে কোনো পর্যালোচনামূলক আলোচনা আমার আজ অবধি চোখে পড়েনি। অথচ ‘বিপ্লবের’ জন্য বাংলাদেশে কম তরুণ আত্মাহুতি দেয়নি।
দুই
বৈপ্লবিক রূপান্তরের প্রশ্ন তাহলে সামগ্রিক বাস্তব পরিস্থিতিকে আমলে নিয়ে কর্তব্য নির্ধারণ। জনগণকে স্রেফ তত্ত্ব দিয়ে ‘বিপ্লব’ কথাটার মানে বোঝানো যায় না। আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তারা সেটা বোঝে। ‘বিপ্লব’ কথাটার ব্যবহারিক অর্থ সম্পর্কে বাংলাদেশের একসময়ের বিপ্লবী রাজনীতি খুব অস্পষ্ট ছিল বলা যায় না। শব্দটির অন্তর্গত রোমান্টিক অনুমান বা আকাক্সক্ষা দ্বারা পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশকের বিপ্লবীরা আপ্লুত হননি তা নয়; কিন্তু সেই সময় বাম ধারার মধ্যে কিছু গৎবাঁধা প্রশ্ন ছিল। যেমন, বাংলাদেশে বিপ্লবের স্তর কী? এখনকার রণনীতি ও রণকৌশল কী হবে? প্রশ্ন করার ধরনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে, বিপ্লব কোনো বিমূর্ত চিন্তা ছিল না। একটি দেশের সুনির্দিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে কর্তব্য নির্ধারণ, কী কাজ করতে হবে তার পরিকল্পনা; ইত্যাকার বিষয় বিবেচনায় নেয়ার মধ্য দিয়েই বিপ্লব বলতে বিশেষ সময়ে বিশেষ অবস্থায় কী বোঝায় সেটা বোঝানো হতো। বিপ্লব সর্বকালে সব অবস্থায় একই রকম রাজনৈতিক কর্তব্য সম্পাদন নয়। বৈপ্লবিক সংকল্পের বিশেষ রূপ রয়েছে। কী সম্ভব আর কী সম্ভব নয় সেসব দিক বিচার করার দায় রয়েছে। তবে দুর্ভাগ্য হল, কর্তব্য নির্ধারণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি, শ্রেণী ও সমাজ নিয়ে যে ঘনিষ্ঠ গবেষণার দরকার ছিল, বামপন্থীরা সেই বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করেননি। ফলে ছোট ছোট চটি প্রচার পুস্তিকা দিয়ে বাংলাদেশে পুঁজিবাদ এসেছে নাকি এখনও সামন্তবাদ, আধা সামন্তবাদ ইত্যাদি রয়ে গিয়েছে- সেই তর্কে তারা নানান ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন। প্রশ্ন তোলা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতির দরকার ছিল, বামপন্থীদের মধ্যে তার প্রকট অভাব ছিল। সেটা তাদের দোষ বা সীমাবদ্ধতা হিসেবে ভাবলে ভুল হবে। এখন মার্কস-লেনিন-মাওসহ দরকারি বই প্রায় সবই ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। কিন্তু ষাট দশকেও গুরুত্বপূর্ণ বই হাতে লিখে পড়তে হতো।
বাংলাদেশে নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী বেড়ে ওঠা খুব বেশি দিনের কথা নয়। বৈপ্লবিক চিন্তার বিকাশ বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশ ও বুর্জোয়া চিন্তা-চেতনার পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই ঐতিহাসিকভাবে ঘটার কথা। যেখানে বুর্জোয়া বিকাশই ঘটেনি সেখানে বামপন্থা বড়জোর পেটি বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীলতার অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারে না। ওঠা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা-ই ঘটেছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের মুখে বামপন্থা তাসের ঘরের মতো উড়ে গেল। শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় এখন বামপন্থী অনেকে শোভাবর্ধন করছেন। পঞ্চাশ থেকে আশির দশক অবধি বামপন্থী চিন্তা-চেতনার ইতিহাস বিচার করলে আমরা নিশ্চিত হব, যাদের আমরা এখন ফ্যাসিস্ট রাজনীতি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার অলংকার হিসেবে দেখছি, তাদের চিন্তার মধ্যে সেই সম্ভাবনা ষোল আনা হাজির ছিল।
তিন
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা হচ্ছে গণতন্ত্র। এ নিয়ে আমি বহু লেখালেখি করেছি। গণতন্ত্র মানে নির্বাচন- এ রকম নির্বাচনবাদী ধারণা কিছুটা হলেও পপুলারিটি হারিয়েছে। কিন্তু যে দিকটা বোঝানো তুলনামূলকভাবে কঠিন সেটা হচ্ছে গণতন্ত্র মানে রাষ্ট্রের একটি বিশেষ ধরন, যেখানে কথিত ‘সংবিধান’ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় না, সেটা পরিচালিত হয় ‘গঠনতন্ত্র’ বা কন্সটিটিউশন দিয়ে। তাহলে রাষ্ট্রের জীবনে একটা মূহূর্ত রয়েছে, যাকে আমরা তার জন্মমুহূর্ত বলতে পারি, যখন রাষ্ট্রটিকে গঠন করা হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়ার অনুমান হচ্ছে, সেই গঠনের কাজটা জনগণ করে, বাইরের কোনো রাজা বা কোনো রাজনৈতিক দল নয়। আমি দীর্ঘদিন ধরে একটি কথা বারবার বলে আসছি, সেটা হল, বাংলাদেশের জনগণকে রাষ্ট্র গঠনের অধিকার থেকে বাহাত্তর সালে বঞ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করেছে তিনটি নীতি কায়েমের জন্য। সেটা হল- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ বা সামাজিক ন্যায়বিচার। এই তিনটি নীতির কথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণায় স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা আছে। জনগণের এই তিনটি নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র ‘গঠন’ বা ‘কন্সটিটিউট’ করার কথা। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জনগণ এই তিনটি নীতিকে শুধু ঐতিহাসিক ন্যায্যতা দেয়নি, একে সাংবিধানিক বা আইনি মর্যাদাও দিয়েছে। এর ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন করা না হলে তা ঐতিহাসিক ও আইনি উভয় দিক থেকেই অবৈধ। এ দিকটি বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে জনগণ সেই কাজটি করল, তারই ফল হচ্ছে কন্সটিটিউশন বা গঠনতন্ত্র। জনগণ সেটা করে একটি ‘রাষ্ট্র গঠনসভা’ বা Constituent Assembly নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে। যাদের কাজ হচ্ছে জনগণ ঐতিহাসিকভাবে যে ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে তাকে ‘গঠনতান্ত্রিক’ বা কন্সটিটিউশনাল রূপ দেয়া। এর বাইরে কিছু করার অধিকার জনগণ কাউকে দেয়নি। ঐক্যবদ্ধভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শর্ত হচ্ছে এই তিন নীতি : সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ই্নসাফ বা ন্যায়বিচার।
কিন্তু যুদ্ধের পর আমরা কী দেখলাম? দেখলাম, যুদ্ধের মধ্যে জনগণ যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে লড়েছে, তাকে সম্পূর্ণ পদদলিত করে একটি দলের কর্মসূচিকে দেশের নীতি হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বলা হল, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র চারটি নীতির ওপর দাঁড়ানো : গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ‘গণতন্ত্র’ কোনো নীতি নয়, এটা রাষ্ট্রের রূপ বা ধরন। গণতন্ত্র ছাড়া বাকি তিন নীতি বাংলাদেশের জনগণের কোনো অভিপ্রায়ের বাইরের বিষয়। চাপিয়ে দেয়া নীতি। যারা এই ইতিহাসের খবর রাখেন, তারা বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পড়ে দেখতে পারেন।
দেখা যাচ্ছে ‘গণতন্ত্র’ কথাটার মানে যদি আমরা বুঝি তাহলে এটাও বুঝব যে, বাহাত্তরে জনগণের অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে একটি ‘সংবিধান’ প্রণয়ন করা হয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ঘোষণা ও প্রতিশ্র“তির বিরোধী। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অর্থ হচ্ছে এই দিকটি বোঝা, এর বিরোধিতা করা এবং স্বাধীনতার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নতুনভাবে বাংলাদেশ ‘গঠন’ করা। এটাই এখনকার গণতান্ত্রিক বৈপ্লবিক কর্তব্য।
রাজনীতির পরিভাষা এবং বাস্তবের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনুধাবন বাংলাদেশের জন্য এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আশা করি আমরা তা দ্রুত বুঝতে পারব।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন