স্বাধীনতার পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পার হওয়ার পরও প্রাথমিক পর্যায়ে সর্বজনীন ও বিনা ব্যয়ে পড়াশোনার শতভাগ সুযোগ নিশ্চিত করতে না পারার বিষয়টিকে রাষ্ট্রের বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদরা।
দেশে প্রাথমিক পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ৯৭ লাখের কিছু বেশি। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখের কাছাকাছি। বাকিরা পড়াশোনা করছে বেসরকারিভাবে স্থাপিত প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কিন্ডারগার্টেনসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অবৈতনিকভাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ। বাকি ৪৪ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীর প্রায় সবাই পড়াশোনা করছে নিজস্ব অর্থায়নে বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
স্বাধীনতার পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পার হওয়ার পরও প্রাথমিক পর্যায়ে সর্বজনীন ও বিনা ব্যয়ে পড়াশোনার শতভাগ সুযোগ নিশ্চিত করতে না পারার বিষয়টিকে রাষ্ট্রের বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদরা। তাদের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭তম অনুচ্ছেদে আইন দিয়ে নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রের প্রতি নির্দেশনা দেয়ার কথা বলা রয়েছে। একই সঙ্গে এতে একই ধরনের গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিতেরও কথা বলা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের প্রাথমিক শিক্ষা (বাধ্যতামূলককরণ) আইনের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। এ আইন প্রণয়নের তিন দশকের পরও এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে একই ধরনের ও অবৈতনিক শিক্ষা কার্যকর করা যায়নি।
প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিসংখ্যান (এপিএসসি) ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৯৭ লাখ ১৩ হাজার ৬৮৫ জন। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে ১ কোটি ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৮১৫ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ। বেসরকারি পর্যায়ের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে ৮৭ লাখ ২৭ হাজার ৮৭০ জন। সে অনুযায়ী নিজস্ব তথা পরিবারের অর্থায়নে পড়াশোনা করছে প্রাথমিক পর্যায়ের প্রায় ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এ শিক্ষার্থীদের অর্ধেকেরও বেশি পড়াশোনা করছে কিন্ডারগার্টেনে, যার সংখ্যা ৪৮ লাখ ৭৩ হাজার ৩৭৫। এর বাইরে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮ লাখ ৩৭ হাজার ৮৮৮ জন, উচ্চ বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮ লাখ ৪ হাজার ৩৫, ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় ৬ লাখ ৮২ হাজার ৮৫৫, এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়ে ৫ লাখ ৩৬ হাজার ১৬১, উচ্চ মাদ্রাসার সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক শাখায় ৪ লাখ ৮১ হাজার ১৯৯, এনজিও শিক্ষা কেন্দ্রে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৫০৪, শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট বিদ্যালয়ে ৩০ হাজার ৩৪৬ ও অন্যান্য বিদ্যালয়ে ২ লাখ ৫ হাজার ৫০৭ জন প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছে। এ পরিসংখ্যানে ইংরেজি মাধ্যম ও কওমি মাদ্রাসার তথ্য উল্লেখ করা নেই। তবে মাদ্রাসা শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, কওমি মাদ্রাসায় ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী শিক্ষার্থীর সংখ্যা অন্তত ১০ লাখ।
বেসরকারিভাবে পরিচালিত প্রাথমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পড়ছে কিন্ডারগার্টেনে। প্রাথমিক পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ২৫ শতাংশ পড়াশোনা করছে কিন্ডারগার্টেনগুলোয়। দেশের বিভিন্ন স্থানের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এলাকাভেদে এসব বিদ্যালয়ের ভর্তি ফি ২ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ মাসিক বেতন হিসেবে দিতে হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বাড়তি কোচিং করাতে হয়।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা কাওসার আহমেদ। পেশায় একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। ছয় বছর বয়সী একমাত্র সন্তানকে পড়াচ্ছেন স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনে। তার অভিযোগ, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা মানসম্মত না হওয়ার কারণেই সন্তানকে বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন তিনি।
কাওসার আহমেদ বলেন, ‘আমার বেতন সর্বসাকল্যে ২০ হাজার টাকা। এ টাকায় সংসার চালানো কঠিন। প্রথমে ভেবেছিলাম মেয়েকে সরকারি প্রাথমিকে ভর্তি করাব। কিন্তু কয়েকটি প্রাথমিক স্কুল ঘুরেও কোনো স্কুলই মানসম্মত মনে হয়নি। তাই সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করিয়েছি। কাছাকাছি যে কিন্ডারগার্টেনগুলো আছে, তার মধ্যে এটি তুলনামূলক কম ব্যয়ের। এরপরও আমাকে ভর্তির সময় ফি হিসেবে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এখন স্কুল, কোচিং আর যাতায়াতসহ প্রতি মাসে প্রায় ৩ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। এ ব্যয় সামাল দিতে এখন প্রতি মাসেই অর্থ ধার করতে হচ্ছে।’
প্রাথমিক বিদ্যালয়সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্র এখনো সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করেনি। ঢাকাসহ বেশকিছু জেলায় বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় কয়েক গুণ। এপিএসসির তথ্য অনুযায়ী ঢাকা জেলায় প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৮০ দশমিক ৯ শতাংশই বেসরকারি বিদ্যালয়। এছাড়া গাজীপুরে ৭২ দশমিক ২ শতাংশ ও নারায়ণগঞ্জে ৬৬ দশমিক ৩ শতাংশ বেসরকারি বিদ্যালয়। অভিভাবকরা জানিয়েছেন, শিক্ষার মান ছাড়াও সহজ যাতায়াত, ব্যস্ততাপূর্ণ সড়ক পরিহার ও শিশুর নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলো বিবেচনা করেও নিকটবর্তী বেসরকারি বিদ্যালয়কে বেছে নিচ্ছেন তারা। বর্তমানে ঢাকা জেলায় ৮০ দশমিক ৪ শতাংশ, গাজীপুরে ৭০ দশমিক ৬ ও নারায়ণগঞ্জে ৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করছে।
দীর্ঘদিন ধরেই দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর বড় সমস্যা হয়ে জেঁকে বসেছে শিক্ষক সংকট। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে এখন সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকের সংখ্যা ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৫১৩ জন। সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতি ৩০ জন শিক্ষার্থীর জন্য অন্তত একজন শিক্ষক থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। সে অনুযায়ী সব শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে সরকারের প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষক সংখ্যা এখনকার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণে নিতে হবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান শাহীন এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষকের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এলাকা অনুযায়ী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রয়োজন। যেসব এলাকায় এরই মধ্যে পর্যাপ্তসংখ্যক বিদ্যালয় আছে, সেসব এলাকায় নতুন বিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই। কিন্তু ঢাকাসহ যেসব এলাকায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি, কিন্তু বিদ্যালয় কম; সেগুলোয় নতুন বিদ্যালয় নির্মাণের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। এর পাশাপাশি বিদ্যমান স্কুলগুলোর সৌন্দর্যবর্ধন প্রয়োজন যাতে শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা বিদ্যালয়ের পরিবেশে সন্তুষ্ট হয়। এছাড়া মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধাও বাড়াতে হবে। এখন অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী যোগদান করলেও তাদের মধ্যে অন্য চাকরিতে চলে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। এ কারণে আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা এমন প্রত্যাশা করি, যাতে মেধাবীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আগ্রহী হন।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আরেকটি সমস্যা দীর্ঘসময় ধরে স্কুল চলা। অভিভাবকরা সন্তানকে এত দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়ে রাখতে চান না। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোয় স্কুলের সময় কম। এ কারণেও অনেকে বেসরকারি বিদ্যালয় বেছে নেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়েও এমনটি করা উচিত। অথবা মিড ডে মিলের ব্যবস্থা থাকা উচিত।’
এছাড়া কারিকুলাম নিয়ে সংশয় এবং ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহও অভিভাবকদের সন্তানের পড়াশোনার জন্য বেসরকারি স্কুল বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এমনই একজন ঢাকার মিরপুর-১১-এর বাসিন্দা রোজিনা আক্তার। পেশায় একজন গৃহকর্মী। তার তিন সন্তানের মধ্যে দুজনের বয়সই ৬ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে একজনকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও আরেকজনকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছেন।
রোজিনা আক্তার বলেন, ‘আমি চাই আমার সন্তানরা ভালো অবস্থানে যাক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভালো পড়ালেখা হয় না। স্কুলের পরিবেশও ভালো না। এছাড়া আমার মেয়ে ক্লাসে পড়া ভালো বোঝে না। এ কারণে ইচ্ছা ছিল দুই মেয়েকেই এ বছর মাদ্রাসায় ভর্তি করাব। কিন্তু সামর্থ্য না থাকায় একজনকে ভর্তি করিয়েছি। মাদ্রাসায় ভর্তিতে আমার প্রায় ২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এরপরও আমি খুশি। এখানে পড়ালেখা ভালো হয়, পরিবেশও ভালো। আবার ধর্মীয় শিক্ষাও পাচ্ছে।’
দেশে সব শিশুর প্রাথমিক পর্যায়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ দক্ষতা নিশ্চিত করতে এবং সামাজিক বৈষম্য দূর করতে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে সর্বজনীন অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে বলে অভিমত শিক্ষাবিদদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, ‘অভিভাবকরা সন্তানকে বেসরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর অন্যতম কারণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষার অভাব। প্রাথমিক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীর যে মানের শিক্ষা পাওয়া উচিত, আমাদের দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় তা নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অনেক অভিভাবক সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। যদি আমরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয়ই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারি, তবে আমাদের অভিভাবকরা বাড়তি অর্থ খরচ করে সন্তানকে বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়াবেন না।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখন যেটি হচ্ছে শিক্ষা নিয়ে এক ধরনের সামাজিক বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। যার অর্থ আছে সে ভালো মানের শিক্ষা পাচ্ছে। আর যার অর্থ নেই সে মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতির অন্যতম কারণ হলো শিক্ষায় পর্যাপ্ত বাজেটের অভাব। সরকারের উচিত পর্যাপ্ত বাজেট নিশ্চিত করে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাকে পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়া। প্রয়োজনে বিদ্যালয়ের সংখ্যা ও শিক্ষক সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবশ্যই সংবিধান অনুযায়ী গণমুখী ও সর্বজনীন করতে হবে।’
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ প্রাথমিকে একই ধরনের কারিকুলামের আওতায় একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের কথা বলা হয়েছিল। যদিও দেশে এখন সরকারিভাবে স্বীকৃত বা স্বীকৃতিহীন মিলিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় কারিকুলাম চালু আছে অন্তত পাঁচ রকমের। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধরন ও কারিকুলামের এ ভিন্নতা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের শুরুতেই অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার স্তরে ব্যাপক পার্থক্য তৈরি করে দিচ্ছে। দেশে বর্তমানে প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় পুরোপুরি সরকারি কারিকুলামকেই অনুসরণ করা হয়। এ কারিকুলাম সাধারণ শিক্ষা কারিকুলাম নামেও পরিচিত। আর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোয় সাধারণ শিক্ষা কারিকুলামে নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি বেশকিছু অতিরিক্ত বিষয়ও পড়ানো হয়। ইবতেদায়ি মাদ্রাসা এবং উচ্চ মাদ্রাসা সংলগ্ন ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় অনুসরণ করা হয় সরকার নির্ধারিত পৃথক কারিকুলাম। এ কারিকুলাম সাধারণ মাদ্রাসা কারিকুলাম নামে পরিচিত, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। আর কওমি মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলোয় সম্পূর্ণ নিজস্ব কারিকুলাম অনুসরণ করা হয়। এ দুই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন পদ্ধতিও পুরোপুরি আলাদা। কওমি মাদ্রাসায় কুরআন ও হাদিস শিক্ষায় জোর দেয়া হয় সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অনুসরণ করা হয় বিদেশী কারিকুলাম।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলছি। সেটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। আর আমাদের সংবিধানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। যদি অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হতো, তাহলে সাংবিধানিক এ অধিকার রক্ষিত না হলে নাগরিক রিট করতে পারত। এখন সংবিধান সংশোধনের যেহেতু সুযোগ এসেছে, আমাদের দাবি থাকবে বিষয়টিকে যাতে অবশ্যই নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়কেও আমরা নেতিবাচক হিসেবে দেখছি না। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি অবশ্যই বেসরকারি উদ্যোগও থাকা উচিত। তবে সব প্রতিষ্ঠানের অবশ্যই সরকারি নিয়ম-নীতির মধ্যে থাকতে হবে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোয় কী পড়ানো হবে, সে বিষয়ে সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। এখন যেমন কিন্ডারগার্টেন, কওমি মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সরকারের কাছে তথ্য নেই বা নিয়ন্ত্রণ নেই; এমনটি হতে পারে না। সার্বিকভাবে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় মোটা দাগে তিনটি সুপারিশ জানিয়েছি। প্রথমটি হলো বাজেট বৃদ্ধি, দ্বিতীয়টি সম্মিলিত শিক্ষা আইন ও সর্বশেষটি হলো পর্যাপ্ত পরিমাণে উপবৃত্তি, যা দ্বারা একজন দরিদ্র শিক্ষার্থী তার প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের ব্যয় বহন করতে পারবে।’
প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং প্রাথমিক শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গত ৩০ সেপ্টেম্বর নয় সদস্যের একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মানের ঘাটতি রয়েছে, এটি একটি সমস্যা। বিদ্যালয়গুলোকে মানসম্মত করে গড়ে তুলতে হবে। বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও থাকতেই পারে। কোনো বিত্তবান অভিভাবক যদি সন্তানকে বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়াতে চান, সে স্বাধীনতা তার থাকা উচিত। তবে সব বিদ্যালয়কে অবশ্যই সরকারি নিয়মনীতির মধ্যে থাকতে হবে। আমরা আমাদের সংস্কার প্রতিবেদনে এ বিষয়গুলো বিবেচনা করছি।’