রাজনীতির ভিত্তি কল্যাণ
নিজে যেহেতু রাজনৈতিক কর্মী, সেহেতু আমার লেখা বেশির ভাগ কলাম রাজনীতিকেন্দ্রিক। গত বুধবার (২৭ নভেম্বর ২০১৯) প্রকাশিত কলামটিও ছিল রাজনীতিকেন্দ্রিক। শিরোনাম ছিল ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতির এক যুগ’। গত সপ্তাহে বলতে চেয়েছিলাম এবং এখনো বলতে চাচ্ছি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নামক রাজনৈতিক দলটির বয়স ১২ বছর তথা এক যুগ পূর্ণ হচ্ছে আজ বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০১৯। এ উপলক্ষে একটি ফুলেল শুভেচ্ছা বিনিময় সভা আয়োজন করা হয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত। যারা এই কলাম পড়ছেন এবং সময় পাবেন, তারা আসবেন; আমাকে এবং আমাদের দোয়া করে যাবেন।
পার্টির দার্শনিক ভিত্তি
আমাদের দলের রাজনীতির দার্শনিক ভিত্তি পবিত্র কুরআনের একুশতম সূরার (সূরা আম্বিয়া) ১০৭ নম্বর আয়াত। আয়াতটির উচ্চারণ এরূপ : “ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামিন।’ এই অতি বিখ্যাত আয়াতটির ভাবার্থ দিচ্ছি : ‘মহান আল্লাহ, তাঁর রাসূল মুহাম্মদ সা:-কে পাঠিয়েছেন সমস্ত সৃষ্টিজগতের জন্য রহমতস্বরূপ।’ পবিত্র কুরআনে ব্যবহৃত আরবি শব্দ রহমতের নিকটতম বাংলা প্রতিশব্দ : মঙ্গল, কল্যাণ, দয়া, মায়া, উসিলা, উপকার। অর্থাৎ মহান আল্লাহর বন্ধু রাসূলুল্লাহ সা: হলেন কল্যাণের প্রতীক, কল্যাণের বাহক, কল্যাণের ধারক এবং কল্যাণের প্রতীক। সুতরাং আমরা যারা তাঁর উম্মত, আমরা যদি রাজনীতি করি তাহলে অবশ্যই সেই রাজনীতির লক্ষ্যবস্তু হতে হবে দেশ ও জাতির কল্যাণ। অতএব কল্যাণ করতে হলে, পদ্ধতিগতভাবে বা প্রক্রিয়াগতভাবে পরিচিত বা বিদ্যমান পরিবেশে থেকেই আগাতে হবে। উপযুক্ত জায়গায় যেতে পারলে পরিবেশ এবং পদ্ধতির ত্রুটিগুলো সংশোধন করে উন্নততর পরিবেশ ও পদ্ধতি বাস্তবায়ন সম্ভব। তাই আমরা মনে করি, সেই উপযুক্ত জায়গা হলো পার্লামেন্ট। অতএব পার্লামেন্টে যাওয়া প্রয়োজন। যাওয়ার পর বিভিন্ন কথা উপস্থাপন করা যাবে। দেশব্যাপী প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, ঢাকাকেন্দ্রিক সরকারের কিছু কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ভৌগোলিকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ, দুর্নীতি-দমন প্রসঙ্গে কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত ইত্যাদি পার্লামেন্টে গিয়ে উপস্থাপন করা সহজ এবং গ্রহণযোগ্য। আমরা সেই লক্ষ্যে গত ১২ বছর কাজ করে যাচ্ছি।
রাজনীতি কঠিন
রাজনীতি আসলেই কঠিন, যদি রাজনীতির মধ্যে নীতিটাকে মানতে চান। নীতিটা হলো, নিজে সৎ থাকা, সততাকে উৎসাহিত করা, মেধা ও দক্ষতাকে উৎসাহিত করা। নীতিটা হলো, মানুষকে একত্র রাখা, উৎসাহিত করা, মানুষকে উজ্জীবিত রাখা, মানুষকে শ্রমমুখী ও সততামুখী করা, পৃথিবীর বুকে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার তাগাদা সৃষ্টি করা; নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে লালন করা এবং আগামীর দিকে সুদূর দৃষ্টি প্রসারিত রাখা। এরূপ নীতিতে বহাল থেকে রাজনীতি করা খুবই কঠিন।
রাজনীতি সহজ
রাজনীতি একদমই সহজ যদি নীতি মানা না হয়। মানুষ ধারণা করে যে, রাজনীতিবিদেরাই দেশ চালান এবং চালাবেন। অর্থাৎ তাদের হাতে ক্ষমতা থাকবে। ক্ষমতা থাকলে নিয়মনীতি ভঙ্গ করা যাবে, খাতির করা যাবে, চুরিচামারি-ডাকাতি করা যাবে, দখল-বেদখল করা যাবে। তাহলে টার্গেট ঠিক করে নিন কোন রাজনীতিবিদের পেছনে এখন সময় দিলে, ভবিষ্যতে তার ‘প্রতিদান’ পাবেন। টার্গেট ঠিক করুন, কোন রাজনীতিবিদকে খরচের জন্য টাকা-পয়সা দিলে, আগামী দিনে তিনি আপনার একটা বন্দোবস্ত করে দেবেন। যদি আপনি ২০০০ সালে টার্গেট করে থাকেন, তাহলে পরবর্তী দু’চার-পাঁচ বছর পর তার ফল পেয়েছেন; যদি কেউ বিশ্বাসঘাতকতা না করে। যদি আপনি ২০০৫ সালে টার্গেট করে থাকেন, তাহলে তার ফল ২০০৯ থেকে পেয়েই যাচ্ছেন। যদি আপনি এখন ২০১৯-এর শেষ মুহূর্তে টার্গেট করেন, তাহলে সেটার বিনিময় পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বর্ষাকালে গাছের চারা লাগানো হয়; দুই-চার বছর পর ওই গাছে ফল আসে। বৃক্ষমেলায় গেলে এমন গাছও দেখা যায় যেটাতে ফল ধরে আছে; বড় টবের মধ্যে গাছটি; দাম বেশি হবে; কিন্তু সেটিকেই এনে যদি আপনার বাগানে লাগান, তাহলে গাছে ধরা ফলগুলো সাথে সাথে খেতে পারবেন। অনুরূপ, এখন যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের যদি নগদ ‘তেল’ দেয়া যায়, তাহলে নগদ ফল পাওয়া যাবে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে, গত দশ বছর ধরে কৃত মেগা দুর্নীতির হাজারও ঘটনার মধ্যে যে দু-চারটি উদঘাটিত হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে, ফলসহ গাছ টবে আছে। কিন্তু এরূপ কর্ম তথা ‘তেল’ দেয়া এবং নগদ ফল আশা করা নীতির মধ্যে পড়ে না। তাই বলছিলাম, রাজনীতি একদমই সহজ যদি নীতি অমান্য করতে প্রস্তুত থাকতে পারেন।
মাহাথির মোহাম্মদের উদাহরণ
এই কলামের সম্মানিত পাঠক সমাজের কাছে সুপরিচিত একটি দেশের নেতার কথা উল্লেখ করা শ্রেয় মনে করি। অতীতেও অনেকবার আমার কলামে উল্লেখ করেছি, আজো করছি। দেশটির নাম মালয়েশিয়া। এক নাগাড়ে ২২ বছর মালয়েশিয়ার বারবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী থেকেই আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার হয়ে ওঠেন যিনি, তার নাম ডাক্তার মাহাথির মোহাম্মদ। তিনি বর্তমানেও প্রধানমন্ত্রী। মাহাথিরের লেখা দীর্ঘ আত্মজীবনীর নাম ‘অ্যা ডক্টর ইন দি হাউজ’। নামটির বাংলা অনুবাদ ‘বাড়িতে একজন চিকিৎসক’। অর্থাৎ মালয়েশিয়া নামক দেশটি যখন রুগ্ন ছিল, সেই রোগীর চিকিৎসা করেছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। তরুণ বয়সে আইনজীবী হতে চাইলেও, পরিস্থিতির কারণে চিকিৎসক হয়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে তিনি শুধু রোগী দেখেননি, চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা দিয়ে রাজনীতিকেও দেখেছেন। নিজের লেখা বইয়ের মধ্যেই মাহাথির মোহাম্মদ ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন যে, পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকেও মালয়েশিয়া নামক দেশ ও সমাজকে একটি রোগী মনে করলে, তার চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের প্রয়োজন ছিল। ওই ডাক্তার ‘রাজনৈতিক ডাক্তার’।
বাংলাদেশের সুস্থতা ও অসুস্থতা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অসুস্থতা নিরাময় করার জন্যও চিকিৎসক প্রয়োজন। বাংলাদেশ কি রাজনৈতিকভাবে বা সামাজিকভাবে অসুস্থ? আমার মতে- উত্তর হলো, সব আঙ্গিকে অসুস্থ না হলেও, কিছু কিছু আঙ্গিকে ‘গুরুতর অসুস্থ’। যেমন : শিক্ষা, সমাজ ও ব্যবসায় নৈতিকতায় গুরুতর অসুস্থ। জাতি গঠনের জন্য জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে গুরুতর অসুস্থ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উপযুক্ত বন্ধু বেছে নেয়ার ব্যাপারে আংশিকভাবে হলেও অসুস্থ। জনগণের আবেগকে সম্মান করার ক্ষেত্রে এ রাষ্ট্র অসুস্থ। অবশ্যই বলতে হবে যে, পুরোপুরি সুস্থ নয়। সুস্থতায় ঘাটতি কতটুকু অথবা কতটুকু অসুস্থ, তার উত্তর একেকজন চিন্তাশীল ব্যক্তি বা বিশ্লেষক একেকভাবে দেবেন। যেহেতু বাংলাদেশও রুগ্ন, সব আঙ্গিকে না হলেও অনেক আঙ্গিকে, অতএব এর জন্যও চিকিৎসক প্রয়োজন। চিকিৎসকের যুগে যুগে প্রয়োজন হয়। স্বাভাবিক নিয়মে তথা নির্বাচনী পদ্ধতিতে ভালো চিকিৎসক পাওয়ার আশা দুরাশায় পরিণত হয়েছে, সেহেতু মানুষ গভীরভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
পরিত্রাণের উপায় কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অসুস্থতা থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। যেকোনো কাজ করতে গেলে শুধু শ্রম দিয়েও হয় না। মেধা, শ্রম, সময় ও অর্থ- এসব কিছুর সমন্বিত বিনিয়োগেই একটা ফল পাওয়া যায়। কিন্তু সব কিছুর আগে প্রয়োজন একটি সিদ্ধান্তের। ইতিহাসের একেকজন মহানায়ক, তার পারিপার্শ্বিকতার পরিপ্রেক্ষিতে একেকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন; সিদ্ধান্তগুলো ছিল যুগান্তকারী। প্রথম উদাহরণ : জন্মস্থান মক্কা নগরী থেকে বাধ্য হয়ে হিজরত করেছিলেন তথা দেশান্তরী হয়েছিলেন বিশ্বনবী তথা মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:। নয় বছর পর তিনি যখন মদিনা থেকে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে মক্কা নগরী বিজয় করেছিলেন, তখন তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল, ইসলামবিদ্বেষী ও ইসলামবিরোধী মক্কাবাসীর সাথে তিনি কিরকম আচরণ করবেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। দ্বিতীয় উদাহরণ: দীর্ঘ ২৭ বছর জেলে বন্দী থাকার পর, নেলসন ম্যান্ডেলা যখন মুক্ত হন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা নামক দেশটির নেতৃত্ব নেন, তখন তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তিনি কী নিয়মে দেশ পরিচালনা করবেন, বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ কালো চামড়ার মানুষদের ওপর দীর্ঘ দিন অত্যাচার করা সংখ্যালঘিষ্ঠ সাদা চামড়ার মানুষদের সাথে কীরকম আচার-আচরণ হবে, এ প্রসঙ্গে। ম্যান্ডেলা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে দেশ পরিচালনায় সহযোগী বানাবেন ওদের। তৃতীয় উদাহরণ : দীর্ঘদিন সংগ্রামের পর, ফরাসিদের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন ভিয়েতনামের জনগণ। এরপর কিছু দিনের মধ্যেই উত্তর এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম পৃথক হয়ে যায়। দক্ষিণ ভিয়েতনাম ক্যাপিটালিস্ট মার্কিনপন্থী এবং উত্তর ভিয়েতনাম ছিল কমিউনিস্ট চীনপন্থী। আমেরিকা চীনের বিরোধিতা করতে গিয়ে বা কমিউনিজমের সম্প্রসারণ ঠেকাতে গিয়ে, দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষ নেয় এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন সামরিক বাহিনী ব্যাপকভাবে মোতায়েন করা হয়। আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রায় দেড় দশক যুদ্ধ করে ১৯৭৩ সালে ভিয়েতনাম আক্ষরিক অর্থেই দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছিল। কমিউনিস্টপন্থী উত্তর ভিয়েতনামের পক্ষে ছিল আরেক বৃহৎ রাষ্ট্র যার নাম গণচীন। যুদ্ধের পর, ভিয়েতনামকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কিরকম সম্পর্ক রাখবে এবং চীনের সাথে কিরকম সম্পর্ক রাখবে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল উভয়ের সাথে সমঝোতা ও সহযোগিতার সম্পর্ক সৃষ্টি করবে। চতুর্থ উদাহরণ তথা বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা; নয় মাসের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের নেতৃত্বকেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তারা নিকটতম প্রতিবেশী, একটু দূরের প্রতিবেশী, অনেক দূরের প্রতিবেশী-এরূপ রাষ্ট্রগুলোর সাথে কিরকম সম্পর্ক রাখবে এবং শাসনব্যবস্থা কিরকম হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাথমিক বছরগুলোতে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো, পরবর্তী দশকগুলোতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে প্রভাবিত করছে। স্থানের অভাবে সিদ্ধান্তগুলো এখানে আলোচনা করছি না; অন্য দিন করব। নীট ফল, আজ ২০১৯ সালে এসে, সাংবিধানিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ বিপর্যস্ত, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দেশটি ভদ্রবেশী দুর্বৃত্তদের দখলে, বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিবেশী দেশের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল, রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বিস্ফোরণের অপেক্ষায় থাকা একটি আগ্নেয়গিরির মতো। আমাদের সাফল্য যা কিছু আছে, তার জন্য কৃতিত্ব যেমন আমাদের, তেমনি ব্যর্থতাগুলোর দায়ও আমাদের। এরূপ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। অতীতের ভুল সংশোধন প্রয়োজন। একটি দেশ রাজনীতিবিদেরা পরিচালনা করেন। তাই, রাজনীতি নামক কর্মপ্রক্রিয়ার চিকিৎসা প্রয়োজন। এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই রাজনীতি করছি, গত ১২ বছর।
পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তাগুলো
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুণগত পরিবর্তন চাই। দেশে বিদ্যমান বহুদলীয় রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই এই গুণগত পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করতে হবে বলে বিশ্বাস করি। আমরা চাই সৎ, মেধাবী, সাহসী ব্যক্তিরা রাজনীতিতে জড়িত হোন। আমরা চাই সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই জনগণের খেদমতের সুযোগ যেন পান। আমরা চাই, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এমন হোক যেখানে সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিরা নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন; জনগণের সামনে নিজেদের উপস্থাপন করতে পারেন এবং জনগণকে আশ্বস্ত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেতে পারেন। যথেষ্ট বা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৎ, মেধাবী, সাহসী ব্যক্তি যদি পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন, তাহলে পার্লামেন্ট সদস্যদের মধ্যে একটি গুণগত পরিবর্তন সূচিত হবে। সে জন্য বাংলাদেশে সাহসী ভোটার প্রয়োজন, যারা সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন। সে জন্য বাংলাদেশে সাহসী মিডিয়া প্রয়োজন, যে মিডিয়া সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিদের উৎসাহিত করবে এবং প্রচারণায় পৃষ্ঠপোষকতা দেবে। এই অনুচ্ছেদটি পড়ে কেউ কেউ হাসতেই পারেন; কলাম লেখকের বক্তব্যকে ‘আকাশ-কুসুম কল্পনা’ বলে উড়িয়ে দিতে পারেন। হাসাহাসি করা বা উড়িয়ে দেয়া স্বাভাবিক। কিন্তু যদি এইটুকু আশা স্থির করা সম্ভব না হয়, তাহলে কেন কষ্ট করে রাজনীতি করব; নিজের ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াব?
পরিবর্তনের জন্য মূলনীতি
গত সপ্তাহের কলামে যা লিখেছি তার অতিরিক্ত, বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের আরো কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ। প্রথম : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনা সম্মিলিতভাবে বা যুগপৎ বিদ্যমান থাকবে। দ্বিতীয় : সব ধর্মের ধর্মীয় নেতাগণ, মুক্তিযুদ্ধের নেতাগণ এবং জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাগণ, জাতীয় ঐক্যের প্রেরণা হবেন, জাতীয় বিভক্তির কারণ হবেন না। তৃতীয় : সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায় ও সাম্য। চতুর্থ : জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস শুরু হবে। পঞ্চম : প্রতিহিংসা নয়, পারস্পরিক প্রতিযোগিতাই হবে উন্নয়নের এবং অবদানের কাঠামো। ষষ্ঠ : আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, সততা এবং প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সপ্তম : রাজনীতি ও ব্যবসার অঙ্গনে তারুণ্যকে তথা বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে উৎসাহিত করতে হবে এবং অগ্রাধিকার দিতে হবে। অষ্টম এবং শেষ : বাংলাদেশের মঙ্গল, বাংলাদেশের কল্যাণ, বাংলাদেশের নাগরিকদের উপকার কোন কোন পন্থায় এবং কিসে কিসে নিহিত, এ প্রসঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে পরিকল্পিতভাবে সচেতনতা সৃষ্টির কর্মসূচি চালু করতে হবে।
কী বার্তা পৌঁছাতে চেয়েছি?
গত ১২ বছরের রাজনৈতিক জীবনে আমি এবং আমার রাজনৈতিক সঙ্গীরা বাংলাদেশের সুধী মণ্ডলীর কাছে এবং জনগণের কাছে এই বক্তব্য পৌঁছাতে চেয়েছি যে, (ক) বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন প্রয়োজন এবং (খ) প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের মাঝখানে যথাসম্ভব নতুন রাজনৈতিক ধারা প্রয়োজন। কিন্তু (গ) একদম নতুন ধারা সম্ভব না হলেও প্রধান দু’টি ধারার মধ্যে অধিকতর গ্রহণযোগ্যতাপূর্ণ ধারাটিকে লালন করে তার মাধ্যমেই বা তার সাহায্যেই, গুণগত পরিবর্তন আনার চেষ্টা করতে হবে।
কী কী আবিষ্কার করেছি?
গত ১২ বছর ধরে কাজ করতে গিয়ে আমরা আবিষ্কার করেছি যে, (ক) আমাদের আবেদন বা বক্তব্য জনগণের কাছে পৌঁছানো এবং তাদের সম্মতি আদায় করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ, সময়সাপেক্ষ কাজ এবং আর্থিকভাবে ব্যয়বহুল। (খ) জনগণের একটি অংশ ও সুধী সমাজের একটি অংশ অবশ্যই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণগত পরিবর্তন চায়। কিন্তু তারা নিজেরা সংগঠিত হতে বেশি আগ্রহী নন, অথবা কোনো পদক্ষেপ নিতে বেশি আগ্রহী নন তথা কোনো প্রকারের নতুন রাজনৈতিক ধারাকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে লজ্জা পোষণ করে। (গ) আমাদের সময় কম, আমাদের আর্থিক সচ্ছলতা নেই কিন্তু আন্তরিকতা আছে। অতএব, কী করণীয়?
কী করণীয়?
করণীয় হতে পারে (ক) চুপচাপ বসে থাকা অথবা (খ) পরিবর্তনের সব আশা ত্যাগ করে হতাশ হয়ে বসে থাকা অথবা (গ) বিদ্যমান পরিবেশে আত্মসমর্পণ করা অথবা (ঘ) নতুনভাবে কর্মপন্থা নির্ধারণ করা। বর্তমান ও ভবিষ্যতের সময়ের হিসেবে নতুন কর্মপন্থার তিনটি স্তর থাকতে পারে; (ঘ.১) নিকটবর্তী স্তর, (ঘ.২) মধ্যবর্তী স্তর এবং (ঘ.৩) দূরবর্তী স্তর। আমরা বিশ্বাস করি, তৃতীয় স্তরটিই বাস্তবসম্মত। কিন্তু কাজ করতে গেলে কর্মীবাহিনী কোথা থেকে আসবে? যেহেতু জনসংখ্যার প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠই তরুণ, তাহলে কর্মীবাহিনীও আসতে হবে তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে। আমরা অর্থাৎ এই কলামের লেখক বা তার সমসাময়িক ব্যক্তিরা যদি নিজেদের তরুণ ভাবি, অথবা এই কলামের পাঠকদের মধ্যে যারা তরুণ, তাহলে আমাদের বা তাদের চিন্তাচেতনার বাস্তবতা কী?
তরুণদের বাস্তবতা ও নেতৃত্বের শর্ত
আমরা তরুণরা নিকটবর্তী স্তর নিয়েই অধিক চিন্তা করছি। আমরা পরিবর্তনের পক্ষে। যুবক ও তরুণ বন্ধুগণ কোন স্তরে কী নিয়মে এই পরিবর্তনের আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারেন, সেই প্রসঙ্গে চিন্তা করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। বাস্তবতা হলো : আমাদের সামনে সময় কম, আমাদের আর্থিক সচ্ছলতা নেই কিন্তু আমাদের আন্তরিকতা আছে। আমরা বিশ্বাস করি যে, দেশ, জাতি বা সমাজের বা কোনো জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব প্রদানে পাঁচটি শর্ত বা ধাপ প্রযোজ্য; তথা শর্ত বা ধাপ থাকাটাই বাস্তবসম্মত। প্রথম ধাপ : দেশ ও জাতিকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে। দ্বিতীয় ধাপ : যা চিন্তা করলাম সেটি প্রকাশ করতে হবে মৌখিকভাবে বা লিখিতভাবে। তৃতীয় ধাপ : প্রকাশিত বক্তব্যের দ্বারা অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য উপায় বা মাধ্যম বের করতে হবে। চতুর্থ ধাপ : যাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করা হলো, তাদের সংগঠিত করতে হবে। পঞ্চম ধাপ : সংগঠনের মাধ্যমে পরিবর্তনের কর্মসূচিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিদায়ী বক্তব্য
এই পন্থা অনুসরণ করেই বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি গত ১২টি বছর পার করেছে। ৪ ডিসেম্বর ২০০৭ থেকে পরবর্তী চার বছর স্বতন্ত্রভাবে চলেছে। ২০১১ সালের শেষে এবং ২০১২ সালের শুরুতে, আমরা ১৮ দলীয় জোটে সম্মিলিত হই; পরে এটি ২০ দলীয় জোট হয়েছে এবং এখনো বহাল আছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে এবং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি। আমি নিজে সর্বশেষ নির্বাচন করেছি চট্টগ্রাম-৫, অর্থাৎ হাটহাজারী উপজেলা আসন থেকে। শান্তিপ্রিয় দেশপ্রেমিক জনগণ এ নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি কিন্তু আগ্রহী ছিলেন; তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। নির্বাচন কমিশনের শর্ত মোতাবেক প্রয়োজনীয় সংখ্যক জেলায়, মহানগরে এবং উপজেলায় কল্যাণ পার্টির শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত ও সক্রিয় করা হয়; সেখানকার নেতাকর্মী ভাইদের প্রতি অভিনন্দন জানাচ্ছি। পাঁচটি সহযোগী সংগঠন, মূল সংগঠনের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে; তাদের নেতাকর্মীদের প্রতিও অভিনন্দন জানাচ্ছি। প্রতি তিন বছর অন্তর, পার্টির জাতীয় কাউন্সিল করা হয়; সর্বশেষটি হয় ৬ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে। এ বছর জুলাইতে এসে, ২০ দলীয় জোটের আওতার ভেতরে থেকেই, জাতীয় মুক্তিমঞ্চের সাথেও আমরা সক্রিয় হয়েছি। এভাবে কঠিন পথ অতিক্রম করতে করতেই আজ ৪ ডিসেম্বর ২০১৯ এক যুগ পূর্তি পালন করছি। পার্টির ওয়েবসাইট আছে www.bkp-org.bd, ঢাকা মহানগরের ৮৫ নম্বর পুরানা পল্টনে ষষ্ঠতলায় পার্টির জাতীয় কার্যালয়; মহাখালী ডিওএইচএস-এ পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়। পার্টির বেশ কিছু কিছু নেতাকর্মী গত ১২ বছরে মৃত্যুবরণ করেছেন; তাদের স্মরণ করছি। বর্তমানে সক্রিয় জাতীয়, জেলা, মহানগর ও উপজেলাপর্যায়ের সব নেতাকর্মীর আন্তরিক অবদান বা সময়, মেধা, শ্রম ও আর্থিক অবদানকে সম্মান জানাচ্ছি। বেশ কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রুজু করা মামলা আছে; তাদের সাথে সহানুভূতি ও একাত্মতা প্রকাশ করছি। রাজনৈতিক সহযোগী এবং কল্যাণ পার্টির শুভাকাক্সক্ষীদের স্মরণ করছি। মিডিয়ার ভাইবোনদের প্রতি জানাচ্ছি কৃতজ্ঞতা। আমার কলামের পাঠকদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং সবার কাছ থেকে দোয়া প্রার্থনা করছি।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন