ইমরান খান
পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নানা দোলাচলে আছে। মনে হয়, বেশ কিছু মাস এমনই থাকবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর ক্ষমতায় চলে এসেছে যৌথ বিরোধী দল। পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) প্রধান নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। পার্লামেন্টে ইমরান সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে নাটকীয়তা চলছিল। ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) অন্যতম বৃহত্তম শরিক করাচি-হায়দরাবাদকেন্দ্রিক মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম, পার্লামেন্টে এর সদস্যসংখ্যা সাত ছিল) এবং অন্যান্য দল বিরোধী জোটের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় ইমরান খান সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। পিটিআইয়ের নিজস্ব সদস্যসংখ্যা ছিল ১৫৫ এবং সে কারণেই বৃহত্তর দল হিসেবে দলটি জোট সরকার গঠন করতে পেরেছিল।
শুধু শরিক দলই নয়, নিজের দলের প্রায় ৪০ সাংসদ ইমরানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন বলেও খবরে প্রকাশ পেয়েছে। এ কারণে ইমরান খান সংবিধানের ৬২ (১) (এফ) এবং ৬৪ ধারার ব্যাখ্যা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন করেছিলেন। ওই ধারা অনুযায়ী দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে দল ওই সদস্যদের ‘অযোগ্য’ বলে ঘোষণা করতে পারবে কি না। দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তাতে ঘন ঘন বিদ্রোহ ও সদস্য থাকাকালীন নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়া ও দলবদল বেশ কঠিন করা হয়েছে। অবশ্য অনাস্থা প্রস্তাবে ইমরানের দলের কোনো সদস্য তাঁর বিরুদ্ধে ভোট দেননি। তবে শরিক দল, বিশেষ করে এমকিউএম সরে যাওয়ায় তাঁর সরকারের পতন ঘটেছে। বর্তমানে এমকিউএম এবং আরও ছোট কয়েকটি দল বিরোধীদের সঙ্গে মিলে গিয়েছে। সর্বশেষ পার্লামেন্টে ইমরান খানের মাত্র ১৫৫টি আসন ছিল। অপর দিকে নারী আসনসহ এমকিউএমের সদস্যসংখ্যা সাত ছিল। বাকি ছোট দলসহ মোট ছয়টি দল, নির্দলীয় সদস্যসহ ১৭৮টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে ইমরান সরকার। ৩৪২টি আসনের পাকিস্তানের পার্লামেন্টের একক দল বা জোটবদ্ধভাবে সরকার গঠনে প্রয়োজন হয় ১৭২টি আসন।
কয়েক মাস ধরে অর্থনীতির বেহালের প্রতিবাদে নাগরিকদের আন্দোলন এবং বিরোধী দলগুলোর ঐক্য ইমরান খানের সরকারের পতনের পটভূমি সৃষ্টি করে
রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, এ ধরনের সরকারের অবস্থা এমনই টলমলে থাকে। তবে ইমরান ও তাঁর দলের ভাষ্য, বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে বিশ্বের পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রমাণস্বরূপ বাইডেন প্রশাসনের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আসাদ মজিদের মাধ্যমে পাকিস্তানের ইমরান সরকারকে হুমকি দিয়েছে, সরকার আস্থা ভোটে জিতলেও পাকিস্তানের কপালে দুঃখ আছে। এ কথোপকথনের মেমো রাষ্ট্রদূত সরকারকে পাঠিয়েছে। সে তথ্যই ইমরান জনগণকে জানিয়েছে। যদিও এর পক্ষে এখনো দালিলিক প্রমাণ জনসাধারণ পায়নি। তবে ইমরান খানের শেষ দিনের মন্ত্রিসভার বৈঠকে এমন চিঠি বা মেমোকে ‘অব-বিন্যাস’ (ডি-ক্ল্যাসিফিকেশন) করা হয়েছে এবং এর অনুলিপি সুপ্রিম কোর্ট, রাষ্ট্রপতি এবং উভয় সংসদের স্পিকার ও চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, প্রধানমন্ত্রী এমনটা করতে পারেন কি না। ইতিমধ্যেই ইসলামাবাদ হাইকোর্ট ইমরানের বিরুদ্ধে আনীত ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো যে পিটিআই পার্লামেন্ট থেকে ওয়াকআউট করেছে এবং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে অংশ নেয়নি, যদিও নেওয়ার কথা ছিল। এখন সেই পিটিআই সদলে সংসদ থেকে ইস্তফা দিতে পারে? সে ক্ষেত্রে সদস্যদের স্বীয় পদত্যাগপত্র স্পিকারের কাছে জমা দেওয়ার পরও কিছু সময় লাগবে। পদত্যাগ করার এ ধারণা আরও সুদৃঢ় হয়েছে ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার পর। সারা পাকিস্তান ও বিদেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর পক্ষে শান্তিপূর্ণ আবালবৃদ্ধবনিতা বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। রাস্তায় ইমরান খানের সমর্থন নিশ্চয়ই শাহবাজ শরিফ ও তাঁর সহযোগী দলগুলোকেও কিছুটা হলেও চিন্তিত করেছে। একই সঙ্গে আমার মতে, পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনী, যাদের মনে করা হয় পাকিস্তানের রাজনীতির পেছনের শক্তি, তাদেরও চিন্তিত করেছে।
অপর দিকে তিনটি প্রদেশে, বিশেষ করে পাঞ্জাব, খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তানে জোট সরকার রয়েছে। তাদের অবস্থাও নড়বড়ে। কাজেই প্রদেশগুলোর সরকারও যদি কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থায় পড়ে, তবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট আরও গভীর হবে।
পাকিস্তানে পুরোনো নেতাদের পুনরাবির্ভাব হয়েছে, যাঁদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষোভ। কারণ, তাঁরা ব্যাপক দুর্নীতির ওস্তাদ। এ ধরনের অভিযোগ এখনো ইমরানের বিরুদ্ধে ওঠেনি। তবে দেড় বছরের মাথায় পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচন পর্যন্ত রাজনৈতিক জল কোন দিকে গড়ায়, তা দেখার বিষয়। আশা করি, পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকবে। অন্যথায় উপমহাদেশে নতুন ধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি হতে পারে।
দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে শরিকদের প্রায় উপেক্ষা করেছেন ইমরান খান। বিষয়টি শরিকদের তাঁর বিরুদ্ধে যেতে সহায়তা করেছে। অন্যদিকে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিরা ইমরানের মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ায় প্রশাসন তেমন কার্যকর হয়নি। এমনকি পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগ নিয়ে শরিক দল খুশি ছিল না। অপর দিকে অর্থনীতির অবস্থা চরম পর্যায়ে চলে গেছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদির চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়নি। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যও আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছিল। অব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা, রপ্তানিতে ভাটা, কৃষি উৎপাদন কম হওয়া—সবই পাকিস্তানকে জেঁকে ধরেছে। ইমরানের তিন বছরের শাসনে এ পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি, যদিও বহু ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতির ছাপ ছিল।
ইমরান খানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর গত এক বছরে দূরত্ব বেড়েছিল সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স) প্রধানকে নিয়োগ নিয়ে। ইমরান সেনাবাহিনীর ওপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অদেখা টানাপোড়েনে পড়েছিল। বৈদেশিক নীতি নিয়েও সেনাবাহিনী আর সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন ছিল। ইমরান খানের রাশিয়া সফর এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পাকিস্তানের ভূমিকার বিপরীতে সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়ার বক্তব্য থেকেই সেটি স্পষ্ট।
ইমরানের দাবি, বৈদেশিক শক্তির স্বার্থেই তাঁকে সরানো হয়েছে এবং তিনি সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেই চলেছেন। ইমরান খানের পশ্চিমা বিরোধের যথেষ্ট উদাহরণ অতীতেও রয়েছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সব সরকারের ওপরই প্রভাব রেখেছিল এবং অনেক সামরিক-বেসামরিক সরকারের পতনও হয়েছিল পশ্চিমের বিরাগভাজন হওয়ার কারণে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাবর্তনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ‘ওভার দ্য হরাইজন’ নীতি বাস্তবায়নের জন্য ঘাঁটি দরকার ছিল, যা স্পষ্টতই ইমরানের সরকার সরাসরি নাকচ করে দিয়েছিল। অপর দিকে চীন-রাশিয়ার সঙ্গে আফগানিস্তান ঘিরে পাকিস্তানের সম্পর্ক উষ্ণতর হচ্ছিল, সে কারণেও ইমরানকে বিরাগভাজন হতে হয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে পাকিস্তানের অবস্থান রাশিয়ার পক্ষে হেলে থাকার বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্র সহজভাবে নেয়নি।
যা-ই হোক, পাকিস্তানে পুরোনো নেতাদের পুনরাবির্ভাব হয়েছে, যাঁদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষোভ। কারণ, তাঁরা ব্যাপক দুর্নীতির ওস্তাদ। এ ধরনের অভিযোগ এখনো ইমরানের বিরুদ্ধে ওঠেনি। তবে দেড় বছরের মাথায় পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচন পর্যন্ত রাজনৈতিক জল কোন দিকে গড়ায়, তা দেখার বিষয়। আশা করি, পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকবে। অন্যথায় উপমহাদেশে নতুন ধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি হতে পারে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন