প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের অকালমৃত্যুর খবরে আমরা সবাই যখন দিশেহারা, তখন নিরাপদ ভ্রমণের শেষ আশ্রয় রেলওয়েও মুখ থুবড়ে পড়ছে। কদিন পরপরই রেল দুর্ঘটনার খবর, লাইনচ্যুত হচ্ছে প্রায়ই, অনেক সংবাদপত্রেই সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে লাইন ও নাটবল্টু খারাপ, স্লিপার ধসে গেছে, সিগন্যাল ঠিক নেই ইত্যাদি। এর মধ্যেই বড় দুর্ঘটনায় নিহত হলেন ১৬ জন। একদিকে বৈদ্যুতিক ট্রেনের গল্প, মেট্রোরেলের আয়োজন, মহাকাশে উপগ্রহ, লাখ কোটি টাকা পাচার আর অন্যদিকে কোটি মানুষের প্রিয় দরকারি বাহন রেলের এই অবস্থা। কেন?
বাংলাদেশে এ রকম মানুষ পাওয়া কঠিন হবে, যাঁরা ট্রেন থাকলে আর ট্রেনের টিকিট পেলে বাসের দিকে তাকান। ব্যয়, পরিবেশ, নিরাপত্তা—সব বিবেচনাতেই সর্বজন পরিবহন ও পণ্য পরিবহনের জন্য এ দেশে ট্রেনই প্রধান বাহন হওয়ার কথা। অবকাঠামো, প্রশিক্ষিত জনশক্তিও ছিল, সহজেই বিকশিত হতে পারত। কিন্তু হয়নি। হতে পারত নৌযানও। এ রকম নদীবহুল, জালের মতো নদী দিয়ে ঘেরা দেশ পৃথিবীতে কমই আছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ ও সুযোগ নদী ও পানিসম্পদ। অথচ খুন-দখলে নদী আধমরা, নৌপথ কমে গেছে, নৌচলাচলের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। নৌযানকে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ায় তা কখনোই জনপরিবহন হিসেবে ক্ষমতা অনুযায়ী বিকাশ লাভ করতে পারেনি।
বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রকম শক্তি ও দুর্বলতা থাকে। প্রয়োজন হলো শক্তির জায়গাটা কাজে লাগানো আর দুর্বলতা বা সমস্যার জায়গাটা কমানো। বাংলাদেশ ছোট আয়তনের দেশ, মানুষ বেশি। এগুলো নিয়ে হাহাকারের বদলে দরকার সে অনুযায়ী উন্নয়ন পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন। অথচ বাংলাদেশের উন্নয়ন পথ, পরিবহন, আবাসন, নদী, পানি ব্যবস্থাপনা, শিল্পায়ন সবই হয় এই বাস্তবতাকে গুরুত্ব না দিয়ে। পরিবহনের বিষয়টি এর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। যে দেশে জনসংখ্যা বেশি, জমি কম; সেখানে সর্বজনের পরিবহন বিশেষত রেলওয়ে ও বড় জাহাজই প্রধানত গুরুত্ব পাওয়ার কথা। কিন্তু তা না, গুরুত্ব পেয়েছে সড়ক পরিবহন এবং ব্যক্তিগত গাড়ি।
১৯৪০-এর দশকে এ দেশে মাত্র ৬০০ কিলোমিটার পাকা সড়ক ছিল, যা এখন প্রায় ২১ হাজার ৫৯৬ কিলোমিটার হয়েছে। অন্যদিকে রেলওয়ে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ছিল ২ হাজার ৮৫৮ কিলোমিটার, পরে কিছু যোগ এবং কিছু বিয়োগ করে ২০১৯ সালের সরকারি দলিল অনুযায়ী হয়েছে ২ হাজার ৯৫৬ কিলোমিটার! স্বাধীনতার পর থেকে বিশ্বব্যাংক-এডিবি গোষ্ঠী ‘উন্নয়ন সহযোগিতা’র নামে ঋণ দিয়েছে প্রধানত সড়ক অবকাঠামোর জন্য। যত সড়ক হবে, ততই গাড়ি কোম্পানির গাড়ি, বাস-ট্রাক বিক্রি হবে। সড়ক একে একে দুই লেন, চার লেন থেকে এখন ছয়-আট লেনের কথা হচ্ছে। অথচ এই টাকার একাংশ দিয়ে দেশজুড়ে রেললাইন যদি চার-ছয় লাইন হতো, তাহলে এ দেশের অর্থনীতি আরও গতি পেত, মানুষের জীবন সহজ এবং নিরাপদ হতে পারত। আর রেলের জন্য এই একই গোষ্ঠী ঋণ দিয়েছে উল্টো কাজে—দক্ষ জনশক্তিকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক করতে, নিজস্ব কারখানা সংকুচিত করে আমদানি বাড়াতে, দিয়েছে স্টেশনসহ নানা নির্মাণে আর বিদেশ সফরে। ঋণের টাকায় মোটাতাজা হয়েছে শরিক দেশিরা, রেলের প্রায় বারোটা বেজেছে।
রেলওয়ের সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, গত ১১ বছরে রেলের উন্নয়ন প্রকল্প আর রেল পরিচালনা মিলিয়ে খরচ হয়েছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আছে বিদেশি ঋণযুক্ত বহু প্রকল্প, এতে বরাদ্দ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে সোয়া লাখ কোটি টাকার ৪৮টি প্রকল্প চলছে। কিন্তু রেললাইন, সেতু ভাঙাচোরা। রেলের ৪ হাজার একর জমি দখলে। ‘১৯৭৩-৭৪ সালে মোট রেল ইঞ্জিনের সংখ্যা ছিল ৫১৬; ২০১৮ নাগাদ তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭২টি।’ ৭৩-৭৪ সালে মোট ওয়াগনের (যাত্রী ও অন্যান্য) সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ৮১ টি, এখন তার সংখ্যা ৮ হাজার ৬৮৯ টি।’ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৯) ২৭২টি ইঞ্জিনের ১৯৫ টির আয়ুষ্কাল শেষ, বেশির ভাগ বগিরও শেষ অবস্থা। দক্ষ জনশক্তি ছাঁটাই হয়েছে, নানা স্থানে বেসরকারীকরণ করায় ব্যয় ও দুর্নীতি বেড়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৯৯১ সালে রেলওয়ে রিকভারি প্রোগ্রামের আওতায় রেলওয়ের লোকবল ৫৮ হাজার থেকে ৩৫ হাজার জনে নামিয়ে আনা হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান দুটি কারখানা সৈয়দপুর ও পাহাড়তলীতে বর্তমানে ব্যবহৃত অধিকাংশ মেশিনের বয়স ৫০ বছরের ওপরে চলে গেছে। অথচ যথাযথ নীতি গ্রহণ করলে সৈয়দপুর ও পার্বতীপুর কারখানায় প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক কোচ ও ওয়াগন শুধু মেরামত নয়, তৈরি করাই সম্ভব ছিল।
এসব ক্ষেত্রে এই দশার জন্য অর্থের অভাবের যুক্তি দেওয়া হলেও ভবন নির্মাণ আর আমদানির জন্য বরাদ্দের সমস্যা নেই। যেমন চীন থেকে কেনা হয়েছে প্রায় অচল ডেমু ট্রেন, ৯১টি নতুন স্টেশন ভবন নির্মাণ এবং ১৭৭টি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। স্টেশন হয়েছে, রেললাইন বন্ধ হয়েছে। অন্যদিকে স্টেশনমাস্টার ও পয়েন্টসম্যানের অভাবে বন্ধ প্রায় এক-চতুর্থাংশ রেলস্টেশন।’ (প্রথম আলো, ৪ এপ্রিল ২০১৯) ‘ভারত ও চীন থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়। চালানোর লোক নেই। যন্ত্রপাতিও মানহীন।’ (দেশ রূপান্তর, ১৬ নভেম্বর ২০১৯)
ভারতের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। নব্বইয়ের দশকে অর্থনীতির পুঁজিপন্থী সংস্কারে ভারতের বিশাল রেলওয়ে গভীর সংকটে পতিত হয়েছিল। কিন্তু একপর্যায়ে রেলওয়ে ভিন্নযাত্রা দিয়ে নিজেকে রক্ষা শুধু নয়, আরও বিকশিত করে। বিষয়টি জানতে সুধীর কুমার ও শাগুন মেহরোত্রা রচিত ব্যাংক্রাপটসি টু বিলিয়নস: হাউ দ্য ইন্ডিয়ান রেলওয়েস ট্রান্সফর্মড বইটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সুধীর কুমার ভারতীয় রেলওয়ের এই রূপান্তরের সময়কালে রেল মন্ত্রণালয়ে বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন, কর্মনীতি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শাগুন মেহরোত্রা নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অবকাঠামো অর্থনীতি ও নগর-পরিকল্পনাবিষয়ক গবেষক। তাঁরা এই গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মোহন কমিটিসহ বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের প্রস্তাবের বিপরীত পদক্ষেপ গ্রহণ করেই ভারতীয় রেলওয়ের অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো হয়। এসব সংস্থার দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাব ছিল যাত্রীভাড়া বাড়ানোর। রেলওয়ে উল্টো যাত্রীভাড়া হ্রাস করে। তারা রেলওয়ের করপোরেটাইজেশন করে রেলওয়ের কারখানা বেসরকারীকরণের পরামর্শ দেয়। রেল মন্ত্রণালয় উল্টো ডিজেল ও ইলেকট্রিক ইঞ্জিন, চাকা, যাত্রীবাহী কোচ তৈরির সক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়।...প্রস্তাব ছিল লোক ছাঁটাই করার। উল্টো রেলওয়েকে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগানো হয়।...নতুন রেললাইন নির্মাণ ও ইউনিগেজ পলিসির বিরোধিতা এলেও ২০০৫ থেকে ২০০৮ সাল নাগাদ আগের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি নতুন রেললাইন নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়।’ (এই গ্রন্থের কল্লোল মোস্তফাকৃত সারসংক্ষেপ দেখুন, সর্বজনকথা, নভেম্বর ২০১৫। এই সংখ্যায় আতিকুর রহমান ও নাহিদ হাসান বাংলাদেশ রেলওয়ে নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন)
তার মানে, ভারতে যেসব সুপারিশ অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করে রেলওয়ে নতুন জীবন লাভ করেছিল, বাংলাদেশে সেসব সুপারিশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে রেলওয়েকে বিপর্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন আমলের সরকার কেন ঋণদাতা সংস্থার কথায় নাচে? নাচে, কারণ এতে ‘উন্নয়নের ঘোর’ তৈরি ছাড়াও তাদের অনেকের স্বার্থ থাকে—কেনাকাটা, বিদেশ সফর, কনসালটেন্সি, কমিশন, ঠিকাদারি সর্বোপরি রেলের জমিসহ নানা সম্পদ দখল। এভাবেই ঋণের টাকায় সর্বজনের সর্বনাশ হতে থাকে।
একটি যাত্রীবাহী ট্রেনের বিকল্প হলো শতাধিক বাস, একটি মালবাহী ট্রেনের বিকল্প দুই শতাধিক পাঁচ টনি ট্রাক। একটি বড় লঞ্চ মানেও শতাধিক বাস। চিন্তা করা যায় ট্রেন ও লঞ্চের বিকল্প মানে কত তেল পোড়ানো, কত পরিবেশদূষণ, কত জমি নষ্ট, কত বেশি অর্থ ব্যয়, কত যানজট আর কত জীবনহানির ঝুঁকি? বাংলাদেশে পরিবহন ব্যয় শুধুই বাড়ছে, প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের জীবন যাচ্ছে, আরও বহু পঙ্গু হচ্ছে ট্রেন ও লঞ্চকে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ার জন্যই।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন