Image description

২৪ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখের 'আমার দেশ' একটি শিরোনাম করেছে 'ফেব্রুয়ারির মধ্যে ছাত্রদের রাজনৈতিক দল' আর একই দিন 'মানবজমিন' প্রধান শিরোনাম করেছে 'রাজনীতিতে চাঞ্চল্য: ফখরুলের বক্তব্যের কড়া জবাব নাহিদের'।

দৈনিক দুটির এ দুটো সংবাদ শিরোনাম চলমান বাংলাদেশি রাজনীতির একটি বাস্তবতা দেখিয়ে দিচ্ছে।

অন্যতম অথবা বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। জেঁকে বসা শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ থেকে দেশ-জাতিকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছে দলটি। বিপরীতে দলটির বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী সীমাহীন নির্যাতন ভোগ করেছে। নানামাতৃক সেই নির্যাতন। কিন্তু দলটি সেই ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারে নি। দেশকে সেই মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দিয়েছে প্রধানত ছাত্ররা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে তারা আন্দোলন শুরু করেছিলো। অনেক জীবন ও ত্যাগের বিনিময়ে দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছে। বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি সেই বাস্তবতা মানে এবং স্বীকার করে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিব অনেকবার স্পষ্ট করে তা উচ্চারণ করেছেন।

বিএনপির মহাসচিব মি. ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্ট উচ্চারণেই বলেছেন, 'আমরা ১৫ বছর ধরে চেষ্টা করেছি এই হাসিনা সরকারকে হটাতে। আমরা পারি নি। শেষ গোলটা ছাত্ররাই মেরেছে '।  মি. তারেক রহমানও  ছাত্রদের আন্দোলন ও আত্মত্যাগকে প্রশংসা করেছেন এবং ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এই ঐক্য দৃঢ় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

তার মানে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে বিএনপি প্রশংসার সাথেই গ্রহণ করেছিলো এবং এই অর্জনকে সংহত করার বিষয়েও মনোযোগী ছিলো।

কিন্তু গত দু-তিন মাসে রাজনৈতিক অগ্রগতি মিশ্র ফল দিয়েছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব ও তাদের ঘনিষ্ঠ যুব নেতারা যেসব দাবি উত্থাপন করেছে, তার কয়েকটি বিষয়ে বিএনপি ভিন্নমত ও ভিন্ন পন্থা নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট  সাহাবুদ্দিনের অপসারণ, বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলকরণ ও 'জুলাই ঘোষণা' এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গ। 'জাতীয় নাগরিক কমিটির' ব্যানারে যুব নেতারা ইতোমধ্যে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী মাস মানে ফেব্রুয়ারিতে সেই দলটি আত্মপ্রকাশ করবে মর্মে রংপুরে বলেছেন মি. আখতার হোসেন,  ২৪ জানুয়ারির পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয়েছে।

'রাজনীতির প্রতিদ্বন্দ্বী'

মি. আখতারের নতুন দল ঘোষণার সূত্রে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও এর সমর্থক বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব বিএনপির কাছে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন নেতা উপদেষ্টা হিসেবে আছেন। বিএনপির মহাসচিব মি. ফখরুল বিবিসি বাংলাকে এক সাক্ষাৎকারে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। এর জবাবে এক ছাত্র উপদেষ্টা মি. আসিফ ফেসবুকে ঘোষণা করেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থেকে কেউ 'রাজনীতি' করবে না। এর আগে এক ফেসবুক পোস্টে আরেক ছাত্র উপদেষ্টা মি. নাহিদ বিএনপি মহাসচিবের ২৩ জানুয়ারিতে ঢাকার এক অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যের স্পষ্ট বিরোধিতা করেন। এসব পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মাধ্যমে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বিএনপি প্রতিপক্ষের রূপ নিয়েছে, বলা যায়।

 

বিএনপির রাজনৈতিক চরিত্র

বিএনপি একটি সাধারণ মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মূল বয়ান নিয়ে দলটি সক্রিয় হয় এবং আওয়ামী লীগের বিপরীতে জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থন অর্জন করে। সামরিক শাসক থেকে রাজনীতিকে পরিণত হওয়া জিয়াউর রহমান দলটিকে জনপ্রিয় করতে মূল ভূমিকা পালন করেন। স্বল্পকালীন শাসনকালেই তিনি এ দেশের গণমানুষের গভীর আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। এ দেশেরই আরেক সামরিক শাসক থেকে রাজনীতিক হওয়া হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তুলনামূলক দীর্ঘ মেয়াদি শাসক থেকেও জিয়াউর রহমানের মতো গণআস্থা অর্জন করতে পারেন নি। এ বিষয়টি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এর সাথে দল হিসেবে বিএনপির মূল্যবান রাজনৈতিক পুঁজি বেগম খালেদা জিয়ার ঈর্ষণীয় আপোষহীন ভাবমূর্তি। খালেদা জিয়া দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনের প্রশ্নে সীমাহীন প্রতিবন্ধকতার মুখেও অটল থেকেছেন। তিনি বয়সের ও রোগ-বালাইর ভারে আক্রান্ত হলেও লন্ডনে চিকিৎসার আওতায় আছেন। তাঁর অস্তিত্বই দল হিসেবে বিএনপিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে রাখতে পারে। নেতা-কর্মীদের কম-বেশি 'সমস্যা' থাকলেও দলটি গণআস্থায় এগিয়ে যেতে পারে।

ছাত্র-যুবাদের নতুন দল

ছাত্র-যুবাদের প্রস্তাবিত নতুন দল বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে কতোটা এগুতে পারবে, তা নির্দিষ্ট করে বলার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র নেতারা শিক্ষার্থীদের মাঝে একটি উল্লেখযোগ্য সমর্থন পাবেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। অনুমানটি পরীক্ষার দাবি রাখে। শেখ হাসিনা শাসন অবসানে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতাদের কৃতিত্ব, ত্যাগ ও মোহনীয়তার স্মৃতি কতো সময় সক্রিয় থাকবে, ভোটের রাজনীতিতে তা কতোটা সক্ষম হলো, আসন্ন নির্বাচনে তার প্রমাণ মিলবে।

দাবিকৃত এ দলটির বিষয়ে আমার প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শোনাতে পারি। প্রথমত ছাত্র-যুব আন্দোলনকারীদের একটি অংশ 'জামায়াত-শিবির' সমর্থক ছিলো। ভোটের সময় এ অংশটির ভোট এই নতুন দল আশা করতে পারে না। সেই ভোট জামায়াত-শিবিরেই যাবে। আন্দোলনের একটি অংশ, যা-ই হোক, বিএনপির ছিলো। এই ভোট নতুন দল না পাবারই কথা। এর বাইরের আন্দোলনকারীদের একটি ভালো অংশের ভোট এই নতুন দল পাবে,  আশা করা চলে। কিন্তু এ আশা নিশ্চিত নয়। নানান নির্বাচনী উপাদান এ আশায় ব্যত্যয় ঘটাতে পারে। ভোটের ময়দানে চারটি সক্রিয় পক্ষ থাকবে বলে দাবি করা যায়। বিএনপি, জামায়াত, 'নতুন দল' ও আওয়ামী লীগ।

 

নতুন দলমুখী হওয়া ঠিক হলো?

খেয়াল করেছি, অনেক ভাষ্যকার আন্দোলনকারীদের নতুন দল গঠনে উৎসাহিত করেছেন। আমি এ উৎসাহের পক্ষ নিতে দ্বিধান্বিত। ' সক্রিয় রাজনীতি' করার জন্য এই আন্দোলনকারীদের যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে বলে আমি মনে করিনি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে 'নিয়মিত রাজনীতি' করা অনেক বেশি জটিল কাজ। এমন সব জটিলতাকে পাশ কাটিয়ে এই আন্দোলনকারীদের টিকে থাকা ও জয়ী হওয়া ভীষণ ঝামেলা ও ঝুঁকিপূর্ণ বলে অনেকেই মনে করছেন। এই আন্দোলকারীরা 'রাজনীতির একটি পক্ষ' হয়ে যাওয়ায়' অন্য পক্ষগুলো তাদের জন্য কেবল 'সমস্যার কারণই' হবে। রাজনীতি 'চালিয়ে যাবার' জন্য যেই বস্তুগত প্রস্তুতি বাংলাদেশে দরকার হয়, এই আন্দোলনকারীদের 'অল্পজনেরই' তা থাকার কথা।  'ভিপি নুর' এ জন্য ভালো নমুনা হতে পারেন। নতুন দল না করে, নানান পক্ষের কম-বেশি সমর্থন নিয়ে, আন্দোলনকারীরা একটি 'চাপগোষ্ঠী' হিসেবে সক্রিয় থাকতে পারলে ৫ আগস্টের অর্জনকে তারা অনেক বেশি ফলপ্রসূ করতে পারতো। এবং এর ফলে অর্জিত সুনাম ও বস্তুগত প্রস্তুতি নিয়ে পরবর্তী সময়ে নিয়মিত রাজনীতিতে তারা ভালো অবদান রাখতে পারতো। দল হিসেবে বিএনপি এই আন্দোলনকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারলে উভয় পক্ষই লাভবান হতো, 'বিপ্লবও' ফলপ্রসূ হতো, বাংলাদেশ 'জয়ী' হতো।

ডক্টর তারেক ফজল
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের প্রফেসর।