অর্থবছর পরিবর্তন করুন
29 May 2018, Tuesday
সাধারণ বছর আর অর্থবছর এক নয়। দেশের হিসাব-নিকাশ, রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয় পরিকল্পনা অর্থবছর ধরেই হয়। বছরের শুরু ও শেষ পূর্বনির্ধারিত, কারও পরিবর্তন করার ক্ষমতা নেই, কিন্তু অর্থবছর পরিবর্তন করা যায়। গত কয়েক দশকে বহু দেশ প্রয়োজন অনুযায়ী এর পরিবর্তন করেছে। বাংলাদেশে কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনো ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকে পাওয়া অর্থবছরই অনুসরণ করা হচ্ছে। জুলাই মাসে অর্থবছর শুরু হয়, শেষ হয় জুন মাসে। সে জন্য প্রতিবছর জুন মাসে সেই অর্থবছরের হিসাব শেষ করে পরবর্তী অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করা হয়।
প্রশ্ন হলো অর্থবছর কেন জুলাই থেকে জুন? ব্রিটেনে অর্থবছর অনুসরণ করেই জুলাই-জুন হয়েছিল একসময়; হয়তো পশ্চিমা দেশগুলোর আবহাওয়া বিবেচনাতেই এই সময় ঠিক হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটেনেও এখন পরিবর্তন হয়েছে। সেখানে এখন অর্থবছর শুরু হয় এপ্রিল মাসে। যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয় অক্টোবর মাসে। ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন অর্থবছর অনুসরণ করা হয় দক্ষিণ এশিয়ায় কেবল বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে। এর বাইরে আছে শুধু মিসর ও অস্ট্রেলিয়া। জানুয়ারি-ডিসেম্বর অর্থবছর অনুসরণ করা হয় অস্ট্রিয়া, ব্রাজিল, চীন, পর্তুগাল, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন ও সুইডেনে। ইংরেজি মাসের বিভিন্ন তারিখেও কোনো কোনো দেশে অর্থবছর শুরু হয়। যেমন ১৭ জুলাই নেপাল, ইথিওপিয়া ১১ সেপ্টেম্বর এবং ইরান ২১ মার্চ। এ রকম হওয়ার কারণ হতে পারে, এসব দেশের নিজস্ব বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী অর্থবছর ঠিক করা। যেমন বাংলাদেশে যদি বৈশাখ-চৈত্র অর্থবছর ধরা হয়, তাহলে অর্থবছর ইংরেজি মাস অনুযায়ী শুরু হবে ১৪ এপ্রিল।
কাজেই অর্থবছর পরিবর্তন করার বিরুদ্ধে এই যুক্তি একেবারেই টেকে না যে আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বয়ের জন্য জুলাই-জুন অর্থবছর রাখতে হবে। বাংলাদেশের আবহাওয়া অনুযায়ী অর্থবছর জানুয়ারি-ডিসেম্বর বা এপ্রিল-মার্চ (বৈশাখ-চৈত্র মিলিয়েই করা যায়) হতে পারে। এতে বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই আগের বছরের সব কাজ শেষ করা সম্ভব। এই বছরও জুলাই-জুন অর্থবছর, তাই যথারীতি শেষ মাস জুনের মধ্যে বিল পেতে দেশজুড়ে সব খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়ে গেছে। এমনিতেই ঢাকা শহরের বেশির ভাগ রাস্তা খারাপ। পানি বের হওয়ার পথ বন্ধ। তার ওপর জুনের আগে কাজ শেষ বা বিল নিতে একসঙ্গে নানা ‘উন্নয়ন’কাজের ধাক্কায় মানুষের প্রাত্যহিক জীবন আরও অতিষ্ঠ।
প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার আগে আগে সাংবাদিকেরা একটা অভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে হাজির হন, ‘এই বছরের বাজেট থেকে আপনার কী প্রত্যাশা?’ বাজেট থেকে আলাদা করে কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? অর্থনীতি যে সামগ্রিক পরিকল্পনা, নীতিকাঠামো ও প্রভাববলয় দিয়ে পরিচালিত হয়, তা অব্যাহত রাখাই বাজেটের কাজ। বাজেট নিজে নিজে কোনো নতুন মোড় নিতে পারে না। কর, শুল্ক হ্রাস-বৃদ্ধির মাধ্যমে যে ওঠানামা হয়, তা এই পরিকল্পনারই অংশ। যেমন অনেক ক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানি করে দেশে উৎপাদন করলে শুল্ক বেশি, চূড়ান্ত পণ্য দেশে আমদানি করলে শুল্ক কম। এটা হলো শিল্পোদ্যোক্তার চেয়ে আমদানিকারকমুখী অর্থনীতি পরিচালনার নীতির প্রকাশ।
যেমন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে অপরাধীদের ‘দায়মুক্তি আইন’ দিয়ে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, অনিয়ম এবং প্রাণ-প্রকৃতিবিনাশী প্রকল্প করা হচ্ছে একের পর এক। বাজেট কি এই আইন বাতিল করে পুরো খাতে স্বচ্ছতা আনবে? রামপাল, রূপপুরসহ এসব সর্বনাশা প্রকল্প ও চুক্তি বন্ধ করবে? সরকারের নীতিগত অবস্থানে পরিবর্তন ছাড়া বাজেট এগুলো কিছুই করবে না। বরং বাজেট এসব প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে তার জন-হুমকি বৃদ্ধি করবে।
বাজেট ঘোষণার আগে অর্থমন্ত্রী গর্বের সঙ্গে জানিয়েছেন, উন্নয়ন বাজেটে সবচেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত প্রথমে যোগাযোগ ও পরিবহন এবং দ্বিতীয় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। কোনো সন্দেহ নেই, এ দুটো খাতেই সরকারের অর্থ বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি। এতে কি আমাদের আনন্দিত হওয়ার কথা? অর্থ বরাদ্দ বেশি মানেই যে বেশি উন্নয়ন নয়, কাণ্ডজ্ঞান থেকেই তা বোঝা সম্ভব। কারণ প্রথমত, যে কাজ ১০০ টাকায় করা সম্ভব তা যদি করা হয় ৫০০ টাকায় তাহলে বাজেটের আকার বড় হয়, জিডিপিরও বৃদ্ধি ঘটে; কিন্তু তা চরম অদক্ষতা এবং বড় আকারের দুর্নীতির কথা জানান দেয়।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সড়ক, সেতু ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ব্যয়ে বিশ্ব রেকর্ড করেছে। এসব ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো তো বটেই ইউরোপ-আমেরিকার অনেক ব্যয়বহুল অর্থনীতির তুলনাতেও বাংলাদেশে সড়ক-সেতু বানানোর খরচ অনেক বেশি। আবার গুণগত মানও যে খারাপ, তার দৃষ্টান্ত বহু। তাহলে বাড়তি বিপুল টাকা যায় কোথায়? সহজেই বোঝা যায়, তা যায় ক্ষমতাবানদের পকেটে; তা দেশের চোরাই অর্থনীতির আকার বাড়ায় আর সম্পদ দেশের বাইরে পাচার হয়। এ ক্ষেত্রে বাজেট কি ভিন্ন কিছু করবে? না, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থেকে দূরে থাকায় বাজেট এবারও এসব দুর্নীতি-অনিয়মের বৈধতা দেবে।
ব্যাংক খাত নিয়ে প্রচলিত অর্থশাস্ত্রের প্রশিক্ষণ অনুযায়ী বহু অবিশ্বাস্য ঘটনার কিছু কিছু সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের কোষাগার লুণ্ঠন, বহু হাজার কোটি টাকা লোপাটের খবর সবার জানা। এটাও জানা যে এসব কাজে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। ব্যাংকিং খাতে এসব তৎপরতায় এসব প্রতিষ্ঠান যখন তহবিল-সংকটে তখন সরকার করের আওতা বাড়িয়ে, মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়িয়ে, সেই টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে এসব ব্যাংকে। তলাবিহীন ঝুড়িতে ক্রমাগত যত টাকা যাবে, তার সবই ফাটা তলা দিয়ে চলে যাবে অন্য কারও পকেটে। সরকারের তাতে কোনো আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। বাজেট তার জন্যই বরাদ্দ দেবে। তাহলে বাজেট নিয়ে কী প্রত্যাশা থাকবে?
সরকারি ব্যয় উত্তরোত্তর বাড়ছে। এই বৃদ্ধি সামাল দিতে করের আওতা বাড়ছে। দুটোতেই বাজেটের চেহারা আরও ভালো দেখায়। জনগণ কর দেয় সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সার্ভিস পেতে। অর্থনীতিবিদেরা প্রচলিত অর্থশাস্ত্রের প্রশিক্ষণ অনুযায়ী জিডিপি-কর অনুপাত নিয়ে অনেক কথা বলেন এবং এই অনুপাত বৃদ্ধি করতে অর্থাৎ আরও কর বাড়াতে সুপারিশও করেন। কিন্তু তাঁরা কর-সার্ভিস অনুপাত, অর্থাৎ কতটা কর দিচ্ছি তার বিনিময়ে কতটা সার্ভিস পাচ্ছি সেই অনুপাত, কখনো পরীক্ষা করেন না। আমরা ভ্যাটসহ নানা মাধ্যমে সরকারকে কর দিই, সরকারের টাকা বলে কিছু নেই। সেই টাকাতেই সরকারের সব প্রতিষ্ঠান চলে। সরকারি শানশওকতে, বিজ্ঞাপনী তৎপরতায় খরচ হয় সেই টাকা নির্দ্বিধায়। ভুল বা জনবিধ্বংসী প্রকল্প নিয়ে জনমত নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করে না সরকার। জনমত নিয়ে সরকারের বিন্দুমাত্র দায়বোধ থাকলে সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প অনেক আগেই বাতিল হতো।
এ বছরও বলা হবে, শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ। অঙ্কের ফাঁকি অব্যাহত থাকবে। অথচ এখনো বিশ্বস্বীকৃত ব্যয় অনুপাতে বাংলাদেশ সবচেয়ে নিচের সারিতে। চিকিৎসা খাতেও অনেক সাফল্যের গল্প বলা হবে। অথচ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও সরকারের উচ্চপদের ব্যক্তিরা দেশের ভেতর চিকিৎসা করানোর মতো হাসপাতাল তৈরি করতে পারেননি। তাঁরা জনগণের অর্থে মেডিকেল চেকআপ করতেও বিদেশে যান।
তারপরও অর্থবছরের পরিবর্তন খুব সহজ কাজ। এই সহজ সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের এত অনীহা কেন বলা মুশকিল। এই পরিবর্তনে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হবে না, তবে এতে মানুষের ভোগান্তি কিছু কমবে, সঙ্গে অপচয় বা দুর্নীতির সুযোগও কিছুটা কমবে। তাতে আমলা-ব্যবসায়ী-ক্ষমতাবানদের কিছু আপত্তি হয়তো থাকতে পারে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন