প্রতিদিনের অস্বাভাবিক অকাল মৃত্যু, খুন-গুম আর নিপীড়নের ঘটনাবলিতে মানুষের আতঙ্ক আর ক্ষোভ বাড়ছে। কোনোভাবেই ‘উন্নয়ন’-এর গল্প দিয়ে তা দূর করা যাচ্ছে না। সন্ত্রাসের এ বিস্তার আর ‘উন্নয়ন’-এর ধরনের সম্পর্ক আছে। সেটা খেয়াল করা গুরুত্বপূর্ণ। ত্বকীর কথা দিয়েই শুরু করি।
বয়স আঠারো হয়নি, এক কিশোর। যার কাছে জগৎ ছিল অনেক বড়, চিন্তা ও সৃষ্টির ক্ষমতায় যে নিজের থেকেও অনেক বড় হয়ে উঠেছিল। কারও মনে কষ্ট দেয়ার কোনো চিন্তাও যার মধ্যে আসতে পারে না, যার হাতে অস্ত্র ছিল না, যার সঙ্গে কোনো বাহিনী দূরের কথা, একাকীই ছিল তার চলাফেরা, বইপড়া আর ছবি আঁকা ছিল যার জীবন। আর ছিল নিজের জন্য নয়, সবার জন্য স্বপ্ন।
তার অনুসন্ধানে সে ঘুরে বেড়াত ইতিহাস, পরীক্ষা করত অতীত মানুষদের মহৎ কাজ। এ বয়সের একজন মানুষের কাছে এতটা যা কেউ আশাও করতে পারে না। এ ছোট্ট জীবনে কুৎসিত জগৎকে দূরে ঠেলে এক মহান জগতের স্বপ্ন দেখার মতো পরিণত হয়ে উঠেছিল ত্বকী। সুকান্তের মতো। এরকম একজন নিরস্ত্র, স্বপ্নবান কিশোরকে যারা দলেবলে আঘাত করে, নির্মম নৃশংসতায় হত্যা করে- তাদের মতো ভীতু, অমানুষ আর কে হতে পারে? এমন সমাজে আমরা বাস করছি, যেখানে এ খুনিরাই ক্ষমতার আশীর্বাদে ক্ষমতাবান। এ সোনার দেশে তাদেরই আস্ফালনের নিচে চাপা পড়ে মানুষের সব স্বপ্ন।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে ছোট্ট বয়সেই এ ত্বকী হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একজন শক্তিশালী কণ্ঠ। ওর কবিতা, গদ্য আর ছবিতে তারই প্রতিফলন। অথচ এই ‘চেতনা’র নামেই এ সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে ত্বকী হত্যাকারীদের। ত্বকীর সবকিছুতে ছিল বাংলাদেশের সেই স্বপ্ন, যা ধারণ করেই এই দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল।
ত্বকী হত্যার পাঁচ বছর পার হল, খুনিরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরাই আবার দখল, লুণ্ঠন ও জননিপীড়নেও নেতৃত্বে। তাদের রক্ষার জন্যই বিচারের পথে শতবাধা তৈরি করা হয়েছে। প্রমাণ আছে, তদন্ত হয়েছে, অপরাধী শনাক্তও হয়েছে, তারপরও আটকে আছে বিচার কাজ। সদম্ভে ঘুরে বেড়াচ্ছে খুনিরা, আর উল্টো হয়রানি আর হুমকির মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বিচারপ্রার্থী মানুষ। ত্বকী হত্যার বিচার চেয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এমনকি সেই দলের নির্বাচিত অনেক জনপ্রতিনিধিও দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু অভিযুক্ত পরিবারের ক্ষমতা দলের চেয়ে বেশি।
এ ধারায় ত্বকী একা নয়। সব বয়সের মানুষের জীবনই এখন নিরাপত্তাহীন। তার মধ্যে শিশু-কিশোররা আরও বেশি নাজুক অবস্থায় রয়েছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে, হত্যাকারীদের বিচার তো দূরের কথা, তদন্তের ঘোরপ্যাঁচই কাটছে না। কয়েক বছর হল ঢাকার মিরপুরের কালশীতে বাইরে থেকে ঘরের তালা আটকে গানপাউডার ঢেলে শিশু-নারীসহ নয়জন মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে।
অভিযুক্ত ব্যক্তি সরকার দলীয় নেতা। কোনো তদন্তের খবরই পাওয়া যায় না, বিচার তো দূরের কথা! অভিজিৎ, দীপনসহ অন্যান্য লেখক-প্রকাশক খুনেরও কোনো কিনারা হয়নি। সরকারি দলের নানা গোষ্ঠীর সন্ত্রাস-দাপটে এ দলের বহু অসন্ত্রাসী নেতাকর্মীও এখন কাবু। সারা দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষের ওপর হামলা এবং জমি দখলেও মূল ভূমিকা সরকারি দলের পাণ্ডাদেরই।
নদীনালা-খালবিল-পাহাড় সবই কতিপয় দুর্বৃত্তের দখলের বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোও এখন সরকারি মাস্তানদের দখলের আওতায়। পহেলা বৈশাখের যৌন সন্ত্রাসের কোনো বিচার হয়নি, পথে-ঘরে-ঘাটে-বাজারে-প্রতিষ্ঠানে নারীর ওপর যৌন সন্ত্রাস চলছেই।
সারা দেশে এরকম দখল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও জনমত যাতে সংগঠিত হতে না পারে, সেজন্য সরকারের দমনপীড়নের সব শাখা সক্রিয়। সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থনেই পুলিশ-র্যাব অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় আটক, গ্রেফতার ও ক্রসফায়ার বাণিজ্যে লিপ্ত। এর অনেকগুলো নিয়েই উন্নয়নের যুক্তি হাজির করা হয়। প্রশ্ন হল, সরকার কী উন্নয়নের চেষ্টা করছে যে, যাদের জন্য উন্নয়ন- তাদের ওপরই চড়াও হতে হবে? সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ লোকজন জমি, খালবিল, নদী, পাহাড় দখল করতে চায়। দশ টাকার কাজ একশ’ টাকা দেখিয়ে বাকি টাকা মেরে দিতে চায়।
সেজন্যই সব বড় বড় প্রকল্প হাজির হয়, আর দিনে দিনে শুধু তার খরচ বাড়ে। টাকার সৌধ তৈরি হয় অন্যদেশে। ক্ষমতা এবং যোগাযোগের জোরে যারা জনগণের সম্পদে পেট ভরতে চায়, তাদের জন্য জোরজবরদস্তির ব্যবস্থাই দরকার; স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকলে তা সম্ভব নয়।
একদিকে তাই হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার হচ্ছে একের পর এক; অন্যদিকে টাকার অভাবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-হাসপাতাল-সড়ক ও রেলওয়ে ধুঁকছে। জাতীয় সংস্থাকে পঙ্গু বানিয়ে, কোণঠাসা করে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত দখল-বিস্তারে দেশি-বিদেশি কোম্পানিকে ব্ল্যাংক চেক দেয়া হচ্ছে। উন্নয়নের কথা বলেই জাতীয় সংস্থাকে ডুবিয়ে কমিশনের লোভে বিদেশি কোম্পানির হাতে দেশের সম্পদ তুলে দেয়া হয়েছে।
দেশি-বিদেশি কতিপয়ের লোভ মেটানোর জন্য সুন্দরবনের মতো অনবায়নযোগ্য অতুলনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে। জ্বালানি খাতে দায়মুক্তি আইন দিয়ে সব অনিয়ম-দুর্নীতিকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে, আইসিটি আইন দিয়ে সবার চিন্তা-মত বন্ধ করার জন্য ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে। গ্রেফতার, আটক, ক্রসফায়ার এখন শুধু নিপীড়নের নাম নয়; বাণিজ্যেরও বিষয়।
বাংলাদেশে সরকারি-আধাসরকারি, এমনকি বেসরকারি বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্য এখন লাখ লাখ টাকা ঘুষ জোগাড়ে নামতে হয় মানুষকে। যোগ্যতা প্রমাণে অর্থ চাই, যোগাযোগ চাই। কোটা আর অঞ্চল দিয়ে যোগ্য তরুণদের সামনে তৈরি করা হয়েছে দুর্ভেদ্য প্রাচীর। অদক্ষ, অযোগ্য, চাটুকার ও সন্ত্রাসীতে ভরে গেছে সব প্রতিষ্ঠান। সারা দেশ ভরে গেছে ছোটবড় জমিদারে। প্রতিষ্ঠানের বদলে জমিদারি স্বেচ্ছাচারিতাই এখন সবকিছু পরিচালনা করে।
যুক্তি দেয়া হয় যে, ‘জঙ্গি’, ‘মৌলবাদী’, যুদ্ধাপরাধীদের থাবা থেকে দেশকে মুক্ত করতে কিছুদিনের জন্য গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ দরকার। এগুলো লোকঠকানো যুক্তি। প্রকৃতপক্ষে অগণতান্ত্রিকতা আর তার সুযোগে দুর্নীতি, দখল ও লুণ্ঠনের বিস্তার ঘটিয়ে অগণতান্ত্রিক শক্তি দমন করা যায় না।
দীর্ঘমেয়াদে তা বরং অধিকতর অগণতান্ত্রিক শক্তিরই জায়গা তৈরি করে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হল, খুন আর সহিংসতার পক্ষে সমাজের নানাপক্ষ তৈরি করছে সম্মতি। কাউকে সন্ত্রাসী বললে ক্রসফায়ার, কাউকে চোর বললে নৃশংস নির্যাতন, কাউকে নাস্তিক বললে কুপিয়ে হত্যা, কাউকে জঙ্গি নাম দিলে হয়রানি-নির্যাতন করা যাবে, এরকম এক ভয়ংকর অসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে সমাজে।
বস্তুত ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার বাসনা তৈরি হয় লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও সর্বজনের সম্পদ দখল অব্যাহত রাখার জন্য। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে গেলে কোনো সংজ্ঞাতেই গণতন্ত্র রাখা চলে না। এমনকি দলের ভেতরও নয়।
বর্তমানে ‘উন্নয়ন বনাম গণতন্ত্র’ যে আওয়াজ তোলা হয়েছে, তার সারকথা হল এই- কিছু দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর হাতে বাংলাদেশকে তুলে দিতে গেলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও চর্চা বন্দি করতেই হবে। কেননা জবাবদিহিতা আর স্বচ্ছতা রাখলে কতিপয়ের দস্যুবৃত্তি অব্যাহত রাখা যায় না বরং আইনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করতে হয়। মূলত এভাবেই খুনি-দখলদার ও সন্ত্রাসীদের যথেচ্ছাচারের সুযোগ তৈরি হয়।
যাদের ঘোষিত দায়িত্ব দুর্বত্ত দমন করা, বাস্তবে তাদের ভূমিকা দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ বিপরীত। সহিংসতা, খুন, যৌন সন্ত্রাস, ছিনতাই, টেন্ডারবাজি, দখল, দুর্নীতি ইত্যাদিতে তাদের প্রধান কাজ দেখি অজুহাত তৈরি করা, ভুয়া প্রতিশ্র“তি দেয়া, দুর্বত্তদের পক্ষে সাফাই গাওয়া ও বিভ্রান্তি তৈরি করা, ঘটনা অস্বীকার করা, প্রমাণ নষ্ট করা, তদন্ত কমিটি নিয়ে সময়ক্ষেপণ করা, রিপোর্ট ধামাচাপা দেয়া এবং সবকিছু মিলিয়ে দুর্বৃত্তদের রক্ষা করা। তাই ত্বকী, সাগর-রুনী, অভিজিৎ, দীপন ও তনু বহুল আলোচিত হলেও ভণিতা চলে নির্দ্বিধায়।
আর যেসব খুন বড়জোর এক বা দু’দিন পত্রিকার পাতায় আসে বা আসে না, তাদের নিয়ে তো প্রশ্নই নেই। তাছাড়া গ্রেফতার, আটক, তুলে নেয়া, এমনকি আটক অবস্থায় খুন করে ক্রসফায়ারের মিথ্যা একঘেয়ে গল্প তো চলতেই থাকে।
কখনও কখনও এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। বিচারের শক্তি ও সম্ভাবনা দেখা যায়। সেটা ঘটে একমাত্র তখনই, যখন সংবাদমাধ্যম মানুষের পক্ষে থাকে, প্রতিবাদ ও জনপ্রতিরোধ তৈরি হয় এবং তা ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সমর্থ হয়। আর এখানেই আমাদের দায়, আমাদের কাজ।
আনু মুহাম্মদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন