জনগণকে জিম্মি করে বৃহৎ সিলিন্ডার ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য দুটি ঘটনা দরকার ছিল: এক. বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের কৃত্রিম সংকট তৈরি এবং দুই. গ্যাসের দাম বাড়ানো। দুটি কাজই করা হয়েছে। দামের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নামের একটি প্রতিষ্ঠান আছে। বারবারই গণশুনানি করা হয়, শুনানিতে যা-ই প্রমাণিত হোক না কেন, সরকারের ইচ্ছেমতো গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। এবারও গণশুনানিতে প্রমাণিত হয়েছে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই, তবু যেহেতু সরকারের ইচ্ছা, তাই আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো। যদি সরকারের ইচ্ছাতেই দাম নির্ধারিত হয়, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠান দিয়ে নাটক করার দরকার কী?
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার পরদিন বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এর পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে মাত্র ৩০-৩৫ লাখ গ্রাহক পাইপলাইনে গ্যাস পান। বাকি কোটি কোটি মানুষের কথাও আমাদের ভাবতে হবে।’ নিশ্চয়ই, সরকারের তো দায়িত্বই কোটি কোটি মানুষের কথা ভাবা। কিন্তু সমস্যা হলো, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কারণে এই কোটি কোটি মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, লাভবান হবে মাত্র কিছুজন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে এলপিজি বা সিলিন্ডার ব্যবসার বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তিনি এখন এই ব্যবসায়ী সংগঠনের সভাপতি। বর্তমানে এলপিজি বা সিলিন্ডার ব্যবসার প্রধান অংশ বসুন্ধরা ও যমুনা গ্রুপের হাতে, আরও দেশি-বিদেশি কোম্পানি এখন যুক্ত হচ্ছে। আর এর ফলে ‘কোটি কোটি মানুষের’ কী হবে? গ্যাসের দাম বাড়লে পরিবহন ব্যয় বাড়বে, বিদ্যুতের দাম বাড়বে—এগুলোর কারণে আবার বাড়বে বাসা ভাড়াসহ অন্য সব দ্রব্যসামগ্রীর দাম, বাড়বে শিল্প-কৃষি উৎপাদন ব্যয়। যেসব ব্যবসায়ী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পান, কিংবা বড় ঋণখেলাপি হলেও যাঁদের জন্য ব্যাংকের সিন্দুক সব সময় খোলা থাকে, তাঁরা বাদে সব উদ্যোক্তার জন্যই নতুন বিনিয়োগ এতে আরও কঠিন হয়ে যাবে। যাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কখনোই গ্যাস সংযোগ পাননি, তাঁদেরও জীবনযাত্রার ব্যয় এভাবে বাড়বে। ফলে কিছুজনের পকেট ভরবে ঠিকই, কিন্তু কাটা যাবে সর্বজনের পকেট।
সারা দেশে আবাসিক গ্রাহকসংখ্যা ৩৫ লাখ এবং প্রতিটি পরিবারের সদস্যসংখ্যা গড়ে ৫ ধরলে গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটি ৭৫ লাখ। প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা অনুসন্ধান করে লিখেছেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই সংযোগপ্রতি নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা ১০-১৫ জনও হয়। যেমন ঢাকা শহরে আশুলিয়া ও সাভার অঞ্চলের পোশাকশ্রমিকেরা যেখানে থাকেন, সেখানে একটা কমন চুলা ব্যবহার করে বহু শ্রমিকের রান্না হয়। হঠাৎ করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে এসব স্বল্প আয়ের শ্রমিক ও নিম্নবিত্ত মানুষের ওপর তো ভীষণ চাপ পড়বে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়িভাড়ায় যে বাড়তি খরচ এসব মানুষকে বহন করতে হবে, তার জন্য সরকার কি তাদের মজুরি/ বেতন বাড়ানোর দায়িত্ব নেবে?’ নেবে না। বরং এসব কথা তুললে কী রকম ভয়, ত্রাস এবং নির্যাতনের পরিবেশ তৈরি করা হয়, তার নমুনা এখনো পাওয়া যাবে।
মন্ত্রী মহোদয় জানিয়েছেন, ‘গ্যাসের দাম যৌক্তিক ও সহনীয় পর্যায়ে রাখতে’ তাঁরা বিইআরসিকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিইআরসি যত দাম বাড়িয়েছে, সরকার থেকে তাঁরা আরও বেশি মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিলেন। কারণ, এই খাতে ‘সরকার একটা বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিচ্ছে’। ঠিকই, বড় অঙ্কের ভর্তুকি তো বছরের পর বছর চলতে পারে না! কিন্তু মন্ত্রী সাহেবের এ তথ্য শতভাগ ভুল।
এক হিসাবে দেখা যায়, ২০১০ থেকে ২০১৫ অর্থবছরে পেট্রোবাংলা ও এর অধীন বিভিন্ন কোম্পানি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছে ২৫ হাজার ৮৭৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২২ হাজার কোটি টাকাই সরকার পেয়েছে সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর, ডিএসএল বকেয়া, আয়কর, কাস্টমস শুল্ক ও রয়্যালটি বাবদ। আর কোম্পানিগুলো লাভ হিসেবে রাখতে পেরেছে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর গত কয় বছরে দফায় দফায় গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করে বাড়তি অর্থ দিয়ে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে, যাতে এখন জমা হয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ‘গ্যাস বিতরণকারী ছয়টি কোম্পানিও লাভে আছে। মুনাফায় শ্রমিকের অংশ (ডব্লিউপিপিএফ) এবং কর-পরবর্তী মুনাফা পরিশোধ করার পর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি লাভ করে কোম্পানিগুলো। দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও কূপ খননকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্স ২০১৪-১৫ অর্থবছর প্রায় ৬৫ কোটি টাকা লাভ করে। ওই অর্থবছর সরকারকে ৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা লভ্যাংশ দিয়েছে বাপেক্স।’ (বণিক বার্তা, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)
গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির সময়ে একটি বিশ্বব্যাংকীয় শব্দ ব্যবহার করছে সরকার, সেটি হলো দাম সমন্বয়। কিন্তু এই সমন্বয়ের যুক্তি গত কয়েক বছরে জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে শোনা গেল না। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম তিন ভাগের এক ভাগ হওয়ার পরও জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়নি। এক বছরেই ১৬ হাজার কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে সরকারের। এই মুনাফার টাকা কোথায় যাচ্ছে, তা–ও পরিষ্কার নয়।
গ্যাস খাতের উন্নয়নের জন্য গঠিত তহবিল দিয়ে কী কাজ হচ্ছে? কেউ পরিষ্কার জানে না। উল্টো দেখা যাচ্ছে, গত ১০ বছরে কোনো উল্লেখযোগ্য অনুসন্ধান হয়নি। বরং বিনা দরপত্রে রপ্তানির বিধান রেখে চুক্তি করছে সরকার। আর বাপেক্সকে বসিয়ে রেখে তিন গুণ বেশি খরচে রাশিয়ান কোম্পানি গাজপ্রমকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে সরকার।
বস্তুত, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের মূল সমস্যা এই খাত নিয়ে সরকারের নীতিগত অবস্থানের মধ্যে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে ক্রমে দেশি-বিদেশি বৃহৎ কোম্পানির ব্যবসার বা মুনাফাভিত্তিক ব্যক্তিমালিকানার খাতে পরিণত করার নীতি বাস্তবায়নের কাজ চলছে দুই দশক ধরে। কোনো অর্থনৈতিক যুক্তিতে নয়, দেশের স্বার্থরক্ষার জন্য নয়, টেকসই উন্নয়নের জন্যও নয়; এই গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায় ক্রমে বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনে বিদেশি সংস্থার অংশীদারত্ব বাড়ানো হয়েছে, হচ্ছে। এদের কাছ থেকে দেশের প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ১০ গুণ বেশি দামে বিদেশি মুদ্রায় গ্যাস কিনতে হয়। সেভাবেই বাংলাদেশে গ্যাস সম্পদের ওপর একক কর্তৃত্ব এখন মার্কিন কোম্পানি শেভরনের, যারা বহু বছর ভালো ব্যবসা করে এখন তা বিক্রি করে চলে যেতে চায়। তারা যে দামে এই ব্যবসা বিক্রি করছে, তার চেয়ে বেশি টাকা আমরা মাগুরছড়ার ÿক্ষতিপূরণ হিসেবে শেভরনের কাছে পাই। কোনো সরকার এই ক্ষতিপূরণ আদায়ে উদ্যোগ নেয়নি, উল্টো সরকার ‘আমাদের সক্ষমতা নাই’ বলে বলে চীনা কোম্পানির হাতে এই গ্যাস খাত হস্তান্তরের রাস্তা তৈরি করছে। বিপুল অর্থ জমা থাকলেও জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের পথেও তৈরি করা হয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা।
বিইআরসির সর্বশেষ গণশুনানিকালে আরও অনেকের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা। তাঁর কথা থেকে দেশের গ্যাস কোম্পানিগুলোর মুনাফার টাকা কোথায় যাচ্ছে, সে বিষয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায়। তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে জানিয়েছেন, ‘গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির গণশুনানিতে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গিয়ে জানিয়েছিল, কোম্পানির জমা হওয়া মুনাফার টাকা মিরসরাইয়ে ভারতের জন্য নির্ধারিত ইকোনমিক জোনের অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছে সরকার।’
গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সরকারি তাগিদের পেছনে আরও কারণ আছে বলে ধারণা করা যায়। সরকারের হাতে এখন অনেক ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প। সেতু-সড়ক নির্মাণ ব্যয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সবার ওপরে। বড় প্রকল্পগুলোতে বিশ্বের অন্যত্র সর্বোচ্চ ব্যয় বিবেচনায়ও বাংলাদেশে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই টাকার সংস্থান তো জনগণের কাছ থেকেই হতে হবে। নতুন নতুন কর শুল্ক, নতুন ফি, পানি-গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি, তেলের দাম হ্রাস না করা ইত্যাদি এরই কিছু দিক।
সব সমীক্ষা এবং পরোক্ষ প্রমাণাদি থেকে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত যে, বঙ্গোপসাগরে বিপুল পরিমাণ গ্যাস আছে। তার অনুসন্ধানে নিজেদের জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ না নিয়ে সরকার একদিকে সাগরের গ্যাস রপ্তানির বিধান রেখে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করছে, অন্যদিকে গ্যাস-সংকটের অজুহাতে সুন্দরবন–বিনাশী প্রকল্প, ভয়ংকর ঝুঁকি ও বিপুল ঋণের রূপপুর প্রকল্পের উদ্যোগ নিচ্ছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কেনার চুক্তি হচ্ছে। গ্যাসের দাম বাড়তে থাকলে এসব কোম্পানির জন্যও ভালো।
এই নীতি ও দুর্নীতির রাস্তা কেবল গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সর্বজনের ভোগান্তিই বাড়াবে না, তার হাত থেকে দেশ ও দেশের সম্পদও কেড়ে নেবে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন