
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতিতে ছোট দলগুলোর কদর বাড়ছে। নিজেদের জোটের পরিধি বাড়াতে চাচ্ছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে সঙ্গে থাকা সমমনা ‘জোট’ ও ‘দল’-এর বাইরের ডান, বাম, মধ্যপন্থি সব সংগঠনকেই এবার সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনি ছক কষছে বিএনপি। সর্বশেষ ইসলামি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতি নজর তাদের। অন্যদিকে অন্যতম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীও নানা কৌশল ও ছক আঁটছে নির্বাচন ঘিরে। মান-অভিমান ভুলে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছে। ফলে ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্ব ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বিএনপিসহ সংশ্লিষ্ট দলগুলোর নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অতীতে জামায়াতে ইসলামী কখনোই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক বা ধর্ম বিষয়ে কোনো আলোচনা করেনি। এবারই প্রথম জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান নিজে চলে গেছেন চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীমের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বরিশালের চরমোনাইয়ের বাড়িতে। দুই নেতা ব্যক্তিগত শুভেচ্ছা বিনিময় নয়, রাজনীতি করার জন্য বৈঠক করেছেন। এভাবে জামায়াতে ইসলামী আরও ছোট দলগুলোর সঙ্গেও নির্বাচনের আগে বৈঠক করবে বলে জানা গেছে। এসব বৈঠকের লক্ষ্য ছোট দলগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের পক্ষে আনা।
অন্যদিকে এবার ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সর্ববৃহৎ দল বিএনপি। তাদের সঙ্গে আলোচনাও শুরু করেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। কিন্তু ছোট দলের অধিকাংশই আগামী নির্বাচনে তাদের আসন ভাগাভাগির বিষয়টি এখনই নিশ্চিত করতে চায়। এ নিয়ে বড় দলগুলো বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে ভিতরে ভিতরে তাদের আলাপ-আলোচনাও চলছে। বিএনপি দেশব্যাপী তাদের নির্বাচনি তৎপরতা চালানোর পাশাপাশি ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ব্যাপক প্রচার শুরু করেছে। পুরনো জোট ও সমমনা দলের পাশাপাশি বাম দলীয় ঐক্যজোটসহ অন্যান্য দল ও জোটকে কাছে টানারও উদ্যোগ নিয়েছে।
বিশেষ করে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে যখন ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন তথা জোট গঠনের সক্রিয় তৎপরতা চলছে, ঠিক তখনই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এ উদ্যোগ নিল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে তিনটি ইসলামি সংগঠনই প্রধানত সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এগুলো যথাক্রমে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিশ ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। দেশের মাদরাসা ও কওমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর এসব সংগঠনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে দুটি সংগঠনের সঙ্গে বিএনপির ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত সপ্তাহে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে খেলাফত মজলিশের আমির মাওলানা আবদুল বাসিত আজাদের নেতৃত্বে তাঁর দলের নেতাদের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৈঠক করেন। আর গতকাল দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতা চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সঙ্গে তাঁদের কার্যালয়ে গিয়ে বৈঠক করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির পক্ষ থেকে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনি ঐক্য করার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি বা আসন বণ্টনের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে চায় সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। নির্বাচনের পর সরকার গঠন বিশেষ করে ঐকমত্যের জাতীয় সরকার গঠনের ক্ষেত্রে ইসলামি দলের প্রতিনিধি রাখার বিষয়েও ইসলামি সংগঠনগুলোকে ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে।
জানা যায়, বিএনপি মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও তৎপরতা চালাচ্ছে। দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীও ইসলামপন্থি দলগুলো নিয়ে বৃহত্তর নির্বাচনি ঐক্য গঠনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে। থেমে নেই বাম দলগুলোও। তারা এক ছাতার নিচে আসার চেষ্টায় তৎপর। তবে শেষ মুহূর্তে এ ছাতাসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বৃহৎ নির্বাচনি জোটের দিকেই ঝুঁকতে পারেন তারা।
এদিকে, মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী দলগুলো এক প্ল্যাটফরমে আনতে চায় বিএনপি। দলটির সব কার্যক্রমই এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে। যৌক্তিক সময়ে নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে তাগিদ প্রদানের পাশাপাশি জোটের পরিধি বাড়ানোর বিষয়টিও জোরদার করছে বিএনপি। বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির মাধ্যমে অন্তত ৪০টি দল ও সংগঠনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাচনে বিজয়ী হলে সমমনা দলগুলো নিয়ে ‘জাতীয় সরকার’ এবং ‘দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায়ের আন্দোলনে যেসব দল রাজপথে ছিল আমরা সবাইকে নিয়ে আগামীতে নির্বাচন এবং পরবর্তীতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠন করতে চাই। সে লক্ষ্যে আমরা দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও বৈঠক করে চলেছি।’
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী আনুষ্ঠানিক জোট গঠনের ঘোষণা না দিলেও নির্বাচন সামনে রেখে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এক প্ল্যাটফরমে আনার চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্যে সাবেক স্বৈরাচার সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা দলগুলোর বাইরের ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছেন দলটির নেতারা। তাঁরা বলছেন, ৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে কাজ করতে হবে। এটা থিম ধরে ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছেন নেতারা। এরই মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ১২-দলীয় জোট, জাকের পার্টি, খেলাফত মজলিস, ফরায়েজী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র নায়েবে আমির আবদুল মাজেদ আতাহারী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির আবু জাফর কাসেমী, জামিয়া মাদানিয়ার মুহতামিম মনিরুজ্জামান কাসেমী, জনসেবা আন্দোলনের আমির ফখরুল ইসলামসহ ব্যক্তিপর্যায়ে বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষক ও আলেমের সঙ্গে জামায়াত আমির পৃথক মতবিনিময় করেছেন।
খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল জলিল বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের ঐক্য ধরে রাখতে আমরা বিএনপিসহ সবার সঙ্গেই আলোচনা করছি। এসব আলোচনায় নির্বাচনসহ নানা বিষয়েই কথা হচ্ছে।’
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মুস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে নানা তৎপরতা চলবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমরা যারা স্বৈরাচার হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে ছিলাম, তারা সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা প্রস্তাব দিয়েছি।’