বাঙালির ব্রেন
19 April 2019, Friday
গতকালের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় একটা খবর দেখলাম। শূকরের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পরে মৃতের মস্তিষ্ক বা ব্রেনকে বিজ্ঞানীরা আংশিকভাবে জীবন্ত করতে পেরেছেন। এই খবরকে বলা হচ্ছে যুগান্তকারী এবং সাংঘাতিক। শকিং। হায় হায় কী হবে এখন?
আমি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লিখি না। কিন্তু এই ধরনের একটা সায়েন্স ফিকশন তো লিখে ফেলাই যায়, আমি মারা যাওয়ার পর, মানে আমার হৃদ্যন্ত্র থেমে যাওয়ার পর, আমার নাড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমার ব্রেন চালু করে ফেলা হলো ব্যাটারি-ট্যাটারি দিয়ে। তারপর আমার স্মৃতি সব কম্পিউটারে কপি করা হলো। আমার ব্রেন ব্যবহার করে কাজকর্মও চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আমি নেই, কিন্তু আমার ব্রেন রয়ে গেছে।
আমরা জানি, স্টিফেন হকিং কথা বলতে পারতেন না। তখন শুধু চোখের পাতা ফেলে তিনি কথা বলতেন। সেটা কম্পিউটার বলে দিত। তারপর তাঁর চোখের পাতা নড়ার ক্ষমতাও চলে যায়। তখন তাঁর মাথার সঙ্গে কম্পিউটার লাগিয়ে দেওয়া হয়। তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি ভাবেন, আর কম্পিউটার সে ভাবনা পড়ে ফেলে উত্তর দেয়। এই অবস্থাতেই তিনি বই লিখতেন। সেমিনারে বক্তৃতা দিতেন। এমনকি সেমিনারে প্রশ্নোত্তর পর্বেও অংশ নিতেন। কাজেই ব্রেনের ভাষা যে কম্পিউটার পড়তে পারে, তা পুরোনো ব্যাপার। কিন্তু মরে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর মৃতের মস্তিষ্ক চালু করা আরেক ব্যাপার। আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা মৃত শূকরের মগজ নিয়ে এই যুগান্তকারী পরীক্ষা করে ফেলেছেন, খবরে প্রকাশ।
Eprothom Aloএই গবেষণার বৈজ্ঞানিক দিক আছে, নৈতিক দিক আছে। মানুষের রোগে-শোকে চিকিৎসায় এই ধরনের গবেষণা সুদূরপ্রসারী সুফল দিতে পারে।
সেসবই গুরুতর কথা। শুক্রবারের ছুটির দিনে গদ্যকার্টুন কেউ সিরিয়াস কথা শোনার জন্য পড়ে না। কাজেই হালকা কথা বলি। আর আমার মতো মানুষ, যাদের আপার চেম্বার খালি, তাদের পক্ষে জ্ঞানের কথা, বিজ্ঞানের কথা না বলতে যাওয়াই বুদ্ধিমানের লক্ষণ। সমস্যা হলো, যার মগজ নাই, তার পক্ষে বুদ্ধিমান হওয়া সোনার পাথরবাটির মতো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রঙ্গ-রসিকতার পরিচয় পাই মৈত্রেয়ী দেবীর লেখা মংপুতে রবীন্দ্রনাথ বইয়ে। একদিন মৈত্রেয়ী একটা বাটিতে করে রান্না করা মগজ নিয়ে হাজির হলেন রবিবাবুর সামনে। রবীন্দ্রনাথ বললেন, কী এনেছ। ব্রেন। ভালো করেছ। আচ্ছা কী করে বুঝলে, ব্রেন জিনিসটারই আমার অভাব!
উন্নত দেশের এই সব আজব পরীক্ষা-নিরীক্ষা গবেষণার কথা বলে আমরা কী করব। আমরা বরং মগজ ভুনা খাব।
আচ্ছা, এই খবরটা কি আপনারা পড়েছেন? প্রথম আলোর ১৭ এপ্রিল ২০১৯-এর খবর। খুলনা, যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচ জেলায় গ্যাস সরবরাহের জন্য গত চারটি সরকার ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু ১৪ বছরেও ওই এলাকায় গ্যাস যায়নি। এখন গ্যাস সরবরাহের প্রকল্পই বাদ দেওয়া হয়েছে। খবরের চুম্বক অংশ:
• পাঁচ জেলায় গ্যাস দিতে ‘অবাস্তব’ দুটি প্রকল্প
• প্রকল্পের কাজ চলেছে ৪ সরকারের আমলজুড়ে
• প্রথমে ৮৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সঞ্চালন লাইন
• পরে আরও ৬০০ কোটি টাকার বিতরণ প্রকল্প
• পাঁচ জেলায় বিতরণের মতো পর্যাপ্ত গ্যাস নেই
গ্যাস সরবরাহের জন্য সব করা হয়েছে, শুধু গ্যাস নেই। গ্যাস পাওয়ার আশু সম্ভাবনা নেই। কিছু কি বোঝা গেল? এখন বলুন, যাঁরা এই প্রকল্প করেছেন, তাঁরা কি বুদ্ধি আপনার আমার চেয়ে কম রাখেন?
না। তাঁরা আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। আপনার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান।
আপনারা কি এটা জানেন, ঢাকার একটা ফ্লাইওভার বানানোর পর খেয়াল হলো, এই নকশাটা আমেরিকান। মানে রাস্তার ডান পাশ দিয়ে চলাচলকারী গাড়ির জন্য। ততক্ষণে বানানো হয়ে গেছে। সংশোধনের আর কোনো উপায় নেই। ওটা ওই রকমই চলছে।
রূপকথার বাঁদর কুমিরকে বলেছিল, বাঁদরের কলিজা থাকে গাছের মগডালে।
আচ্ছা আমাদের ব্রেন কোথায় থাকে? আমাদের ব্রেন থাকে প্রকল্পগুলোর বাজেটের অঙ্কে। এই ধরনের প্রকল্প হলে দেশের মানুষের কিছু লাভ তো হয়ই। টাকা হাতবদল হয়। অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার হয়।
সমস্যা হলো, এই টাকা ঋণের টাকা। আমাদের শোধ করতে হবে।
আমাদের আকণ্ঠ ঋণে নিমজ্জিত করার বিনিময়ে কিছু মানুষ ভালো থাকে। বিদেশে তাদের বাড়ি হয়। দেশে তাদের ছেলেমেয়েরা স্পোর্টস কারে চড়ে।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন