|
ইকতেদার আহমেদ
|
|
আঞ্চলিক জোট সাকের্র সম্ভাবনা
13 June 2024, Thursday
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকরা ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে বাংলার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে তাদের শাসনের সূচনা করলেও পুরো ভারতবর্ষ তাদের দখলে আনতে এক শ’ বছর সময় লেগে যায়। ব্রিটিশ শাসনাধীন থাকাবস্থায় অখণ্ড ভারতবর্ষের নাগরিকরা কোনো ধরনের বাধা বা প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই ভারতবর্ষের এক অঞ্চল থেকে অপর অঞ্চলে যেতে পারতেন। ব্রিটিশদের আগমনের আগে প্রায় ছয় শ’ বছর ধরে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে এ অঞ্চলটি মুসলিম শাসকরা শাসন করেন। এসব মুসলিম শাসক এ অঞ্চলে ভারতবর্ষের বাইরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছিলেন। ভারতবর্ষ মুসলিমদের শাসনাধীন থাকাবস্থায় এ অঞ্চলের মানুষের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো ধরনের বাধা-নিষেধ ছিল না। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ও মুসলিমদের শাসনের আগে এ অঞ্চল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজারা শাসন করেন; তবে তাদের শাসনামলে এককভাবে কোনো রাজা পুরো অঞ্চলের ওপর সাম্রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হননি।
ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ত্যাগ করার সময় ভারতবর্ষের অখণ্ডতাকে ক্ষুণ্ন করে হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ জনসংখ্যা অধ্যুষিত অঞ্চলকে স্বাধীনতা দিয়ে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা- এ তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশদের ত্যাগের কিছুকাল পর থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকদের অপর স্বাধীন রাষ্ট্রে ভ্রমণের ব্যাপারে বিধি-নিষেধ আরোপিত হয় এবং এ বিধি-নিষেধের ফলে এ অঞ্চলের একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের অপর রাষ্ট্র ভ্রমণে ভিসা গ্রহণের আবশ্যকতা দেখা দেয় যা অব্যাহত আছে।
১৯৮৫ সালে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্কের আনুষ্ঠানিক যাত্রাকালে ভারত উপমহাদেশের সাতটি রাষ্ট্র যথা- ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে আফগানিস্তান সার্কের অন্তর্ভুক্ত হয়। সার্কভুক্ত আটটি রাষ্ট্রের মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ এ দু’টি দ্বীপরাষ্ট্র। অপর দিকে নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তান এ তিনটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র।
সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কিন্তু তার জীবদ্দশায় তিনি সার্কের প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে পারেননি। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমান দূরদর্শী ছিলেন এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল যে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে আমাদের এ অঞ্চলেরও সমরূপ উন্নয়ন সম্ভব যদি এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করে কাক্সিক্ষত স্তরে নিয়ে যাওয়া যায়।
আঞ্চলিক জোটের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বর্তমানে বিশ্বের যেসব অঞ্চল সমৃদ্ধি অর্জন করেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো- ঊঊট, অঝঊঅঘ, এঈঈ প্রভৃৃতি। এ তিনটি আঞ্চলিক জোটভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকরা জোটের অন্তর্ভুক্ত এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে চাইলে কোনো ধরনের ভিসা গ্রহণ আবশ্যক হয় না। এসব অঞ্চলের নাগরিকরা নিজ নিজ অঞ্চলে বাধাহীনভাবে সড়ক, রেল, নৌ বা আকাশপথে এক দেশ থেকে অপর দেশে যেতে পারেন। এমনকি এসব অঞ্চলের একজন নাগরিক ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে এক দেশ থেকে অপর দেশ ভ্রমণ করতে পারেন। এসব অঞ্চলভিত্তিক জোটসমূহ নিজেদের নিজ নিজ অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য আঞ্চলিক বাণিজ্যকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি এসব অঞ্চলের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে।
সার্ক প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ অঞ্চলটিকে পৃথিবীর অন্যতম একটি সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত করা। কিন্তু সার্ক প্রতিষ্ঠার পর প্রায় ৩৯ বছর অতিবাহিত হতে চললেও পরিলক্ষিত হয় যে, এখনো সে লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অনেক পথ পাড়ি দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
সার্কের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভারত আয়তন ও লোকসংখ্যার দিক থেকে সর্ববৃহৎ। ভারতের পরের অবস্থান পাকিস্তানের। সার্ক প্রতিষ্ঠার আগে ভারত ও পাকিস্তান তিনটি সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৭১ সালে সর্বশেষ যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল এর পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্ম ঘটে।
পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের অধিক সার্ক অঞ্চলে বসবাস করে। জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় নিলে এ অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল। সাম্প্রতিক সময়ে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো কৃষিতে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। এ অঞ্চলের শিল্পোন্নয়ন আশাব্যঞ্জক হলেও এ পথে আরো উন্নয়নের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সার্ক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিধি এখনো সীমিত। এ পরিধিকে বিস্তৃত করা গেলে সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলো নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে থেকেই অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধনে সক্ষম হবে।
সার্ক প্রতিষ্ঠার পর যদিও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল যে, এক দেশের নাগরিকরা বিনা ভিসায় অপর দেশ ভ্রমণ করতে পারবে এবং ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়াসহ একটি দেশ অপর দেশকে প্রয়োজন অনুযায়ী ট্রানজিট সুবিধা দেবে; কিন্তু সে লক্ষ্য এখনো অর্জন করা যায়নি। আর নিকটভবিষ্যতে যে অর্জন করা যাবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করার সম্ভাবনাও খুব একটা উজ্জ্বল নয়।
সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নেপাল ও ভুটান পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে ভারত দ্বারা বেষ্টিত। এ দু’টি রাষ্ট্র উত্তর দিক থেকে চীন দ্বারা বেষ্টিত হলেও সে দিকের সম্পূর্ণ সীমানা দুর্গম পাহাড়ি পথের অন্তর্ভুক্ত। তাই সে দিক দিয়ে যোগাযোগ বলতে গেলে অনেকটা দুর্ভেদ্য। নেপাল ও ভুটান এ দু’টি দেশ বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এ দু’টি দেশ দীর্ঘ দিন ধরে সার্কের আঞ্চলিক কাঠামোর মধ্যে থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা এ দু’টি সামুদ্রিক বন্দর দিয়ে ভারত হয়ে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার জন্য দাবি করে এলেও তা বাস্তবায়নে ধীর গতি সার্কের চেতনাকে মলিন করে দিচ্ছে।
ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যকে সেভেন সিস্টার্স বলা হয়। এ সাতটি রাজ্য চতুর্দিক অপর রাষ্ট্রের স্থলভাগ দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় চিকেন নেক করিডোর নামক একটি সরু পথ দিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে এ সাতটি রাজ্য যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। এ পথ দিয়ে যোগাযোগ সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। ভারত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে এ সাতটি রাজ্যের সাথে সড়ক, রেল ও নৌপথে ট্রানজিট স্থাপনে আগ্রহী। নৌপথে ট্রানজিটটি চালু থাকলেও বিভিন্ন জায়গায় নদীর নাব্য স্বল্প হওয়ার কারণে তা বছরব্যাপী ফলদায়ক নয়। অপর দিকে সড়ক ও রেলপথে ট্রানজিট দিতে গেলে যে অবকাঠামোর প্রয়োজন তা বাংলাদেশ এখনো গড়ে তোলতে পারেনি।
ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ৫৪টি অভিন্ন নদী বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এ নদীগুলোর অধিকাংশ থেকে একতরফাভাবে উজানে ভারত পানি প্রত্যাহার করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও কৃষিতে সেচকাজসহ অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর নাব্য রক্ষায় কাজে লাগাচ্ছে। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশ প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে এবং সার্কের চেতনা কখনো এক প্রতিবেশী রাষ্ট্র কর্তৃক অপর প্রতিবেশীর জন্য প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি অনুমোদন করে না।
ভারতের তুলনায় সার্কভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্র ক্ষুদ্র হওয়ায় সার্কের চেতনাকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষাপূর্বক ভারত সবসময় সার্কভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতি বড় ভাইসুলভ আচরণ দেখিয়ে আসছে। ভারতের এ আচরণের কারণে সার্ক এক দিকে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হচ্ছে, অপর দিকে সার্কভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিপন্ন হচ্ছে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সাথে ভারতের সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ থাকলেও ট্রানজিট সুবিধা না থাকায় ট্রানশিপমেন্টের মাধ্যমে বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে। এ তিনটি দেশের নাগরিকদের যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ভিসার আবশ্যকতা থাকায় যোগাযোগ খুব একটা সহজসাধ্য নয়। একজন ভারতীয় নাগরিকের জন্য বাংলদেশ ও পাকিস্তানের ভিসা গ্রহণপূর্বক এ দু’টি দেশ ভ্রমণ যতটুকু সহজসাধ্য এ দু’টি দেশের নাগরিকদের জন্য ভারতের ভিসা গ্রহণপূর্বক সে দেশ ভ্রমণ ততটুকু সহজসাধ্য নয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সাথে নেপাল ও ভুটানের যে বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে ট্রানজিটের অনুপস্থিতিতে তা ট্রানশিপমেন্টের মাধ্যমে সমাধা করা হচ্ছে। এতে করে উভয় রাষ্ট্রের আমদানি ও রফতানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে আঞ্চলিক যোগাযোগের মধ্যে শুধু সড়ক, রেল, নৌ ও বিমান যোগাযোগ অন্তর্ভুক্ত নয়। এর বাইরে এক দেশের মধ্য দিয়ে অপর দেশে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও তেল সরবরাহ করা হচ্ছে, এক দেশের মুদ্রা অপর দেশে বিনিময়যোগ্য অথবা জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা চালু রয়েছে এবং একই সিমকার্ড ব্যবহার করে স্বল্প খরচে জোটভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকরা অতি সহজে অন্য দেশের নাগরিকদের সাথে কথা বলতে পারেন।
ভারতের অর্থনীতি দ্রুত বিকাশমান। ভারতের পাশাপাশি উপমহাদেশটির অন্যান্য দেশের অর্থনীতিও বিকাশমান। আঞ্চলিক সহযোগিতার পরিধির আওতায় যদি সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ট্রানজিট সুবিধা উন্মুক্ত করে দেয়া যায়, ভিসা প্রথার বিলোপ সাধন করা যায়, এক দেশের মুদ্রা অপর দেশে সহজে বিনিময়যোগ্য করা যায় অথবা অভিন্ন মুদ্রা চালু করা যায়, ব্যক্তিগত গাড়িতে এক দেশ থেকে অপর দেশ ভ্রমণের সুবিধা চালু করা যায়, এক দেশ থেকে অপর দেশে বিদ্যুৎ, গ্যাস, তেল ও পানির প্রবাহ সহজলভ্য করা যায়, একই সিমকার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে এক দেশ থেকে অন্য দেশে সহজে ও স্বল্প খরচে কথা বলা যায় এবং বাণিজ্যের পরিধি সর্বোচ্চ মাত্রায় উন্নীত করা যায় তবেই আঞ্চলিক জোট হিসেবে সার্ক পৃথিবীর অপরাপর আঞ্চলিক জোটের মতো সমৃদ্ধ জোটে পরিণত হতে পারবে। আর এর জন্য প্রয়োজন সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সর্বোচ্চ মাত্রা প্রদর্শন এবং সুযোগ ও সহযোগিতার সর্বোত্তম ব্যবহার।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন