আফগান মেলোড্রামা : অবশেষে...
23 February 2022, Wednesday
আফগানিস্তান নিয়ে লিখতে গেলে আবার লিখতে হবে ‘পুরনো ক্যাঁচাল’ - সেই তালেবান, আশরাফ গনি সরকার, যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য, মানবাধিকার প্রভৃতি। তবে বাস্তবতা হলো, দেরিতে হলেও আমেরিকার মন গলছে অন্তত আফগান ইস্যুতে। তাদের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংকসহ পশ্চিমা জগৎ আফগান দেশে ‘মানবিক’ ত্রাণ দিতে যাচ্ছে। অর্থাৎ এতদিন তাদের নিজের কার্যক্রম যে, ‘অমানবিক’ বা নিষ্ঠুর ছিল, পক্ষান্তরে এটা স্বীকার করে নেয়া হলো। তা হলে কেন এত বিলম্ব? এক দিকে গণতন্ত্র, অন্য দিকে মানবাধিকারের অবমাননা। তালেবান তো এখন আফগান রাষ্ট্রের বাস্তবতা। তা স্বীকার না করে অন্যদের উপায় কী? আফগান জাতিকে কেউ কষ্টে ফেলার কোনো মানে হয় না। এটা বহু আগেই ভেবে দেখা উচিত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। তা হলে চরম শীতে কারো দুর্ভোগ ঘটত না। তালেবানও কারো সমালোচনার সুযোগ পেত না। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য হতো প্রশংসিত সবার কাছে। তালেবানের দুর্ভোগ ঘটাতে গিয়ে আমরা যেন পুরো আফগানিস্তানের দুর্ভোগ ঘটিয়ে না ফেলি।
গত শনিবারের খবর। শিরোনাম - ‘তালেবানের সহায়তা চায় যুক্তরাষ্ট্র।’ আঁতকে ওঠার মতো ব্যাপার! তালেবান ‘ভয়াবহ সন্ত্রাসী’ এবং ‘কট্টর মৌলবাদী চক্র’। তাদের প্রতি প্রথমে কথিত ‘সদয়’ হয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে না করতেই আমেরিকা এদের কাছেই উল্টো সাহায্য চাইছে। কথায় বলে Nothing is unfair in love and politics. তাহলে শেক্সপিয়ারের এ কথাই সঠিক। মার্কিন মহাশক্তির কাছে তাদের ‘জাতীয় স্বার্থ’-এর চেয়ে বড় কিছু নেই। এ জন্য তারা তালেবানকে গালাগালি ও গলাগলি একসাথে চালাতে পারে; মাথায় হাত বুলিয়ে সাথে সাথে গলায় ছোরা ধরতেও বাধা নেই তাদের। এ জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন ‘American first’ আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন ওয়াদা করেন আমেরিকার ‘সুদিন’ ফিরিয়ে আনার জন্য। তাদের কথা হলো, রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু-মিত্র নেই; জাতীয় স্বার্থই প্রধান।
আফগানিস্তান থেকে সৈন্য দল সরিয়ে নিলেও এখনো আফগান ইস্যু আমেরিকার বিরাট মাথাব্যথার হেতু। এ যেন ‘ম্যায় তো কমলি কো ছোড় দিয়া, লেকিন ও তো মুঝ্কো ছোড়তা নেহি - আমি কম্বল ফেলে দিয়েছি; কিন্তু কম্বল আমাকে ছাড়ে না।’ ঘটনা হলো, এক লোক বন্যার পরে নদীর পাড় থেকে দেখে, প্রচণ্ড স্রোতে কম্বলের মতো কিছু একটা নদীর পানিতে ভেসে যাচ্ছে। আসলে সেটি ছিল একটা জীবন্ত ভালুক যদিও তা লোকটা বুঝতে পারেনি। সে কম্বলের লোভে ভোম্বলের বা বোকার মতো কাজ করল। নদীর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তা ধরে যত টানে, ততই ‘বেয়াড়া’ ভল্লুক নাছোড়বান্দা। অবশেষে না পেরে লোকটি ক্ষান্ত হয়ে সেটিকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু ততক্ষণে ভালুকটি তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার প্রয়াস পাচ্ছে। তখন সে নিরুপায় হয়ে এ কথা বলেছিল।
আফগানিস্তানে তালেবানের চেয়ে অনেক বড় বিপদ, বহু বেশি ভয়ঙ্কর হলো, আইএস-আলকায়েদা প্রমুখ উগ্রবাদী গোষ্ঠী। এখন তারা তালেবান প্রশাসনের জন্যও মাথাব্যথার বিরাট কারণ। তাদের ভয়াবহ সন্ত্রাসী তাণ্ডবে সবাই দিশাহারা ও আতঙ্কিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন তাই ‘ইসলামিক’ স্টেট খোরাসান (আইএসকে)-এর মোকাবেলায় আফগানিস্তানের তালেবান শাসক মহলের সাহায্য চাচ্ছে।
ওয়াশিংটনে এক নিউজ বিফ্রিংয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন জানায়, ‘তালেবানের সহযোগিতা নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের নিজেদের মধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। আইএসকের প্রধান গাফিরি এবং সহযোগীদের ধরার কাজে তালেবানরাও অংশ নিতে পারবে।’ উল্লেখ্য, এ জন্য গত ৯ ফেব্রুয়ারি ১০ মিলিয়ন ডলার প্রাইজ হিসেবে ঘোষিত হলো। মার্কিন প্রশাসনের বক্তব্য, তালেবানের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে এবং ২০২০ সালে (ট্রাম্প আমলে) করা ‘দোহাচুক্তি’র দিকে অগ্রসর হওয়ার প্ল্যান আছে।
উল্লেখ্য, দোহা নগরীতে কাতারের রাজধানী। পাশ্চাত্যপন্থী আরব দেশে আছে মার্কিন সেনাঘাঁটি। দোহাতেই তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদারসহ কয়েকজনের সাথে ঐতিহাসিক চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র স্বাক্ষর করে যার বলে তালেবানকে আর এখন ‘সন্ত্রাসী’ বলা যায় না আগের মতো। স্মর্তব্য, দীর্ঘ দিন আমেরিকা তাদের ‘সন্ত্রাসী দুর্বৃত্ত’ বলেই জেনে ও অভিহিত করে এসেছে। এখন কাবুলের সরকারি মসনদে সমাসীন তালেবানই। তারা নির্বাচিত না হলেও জনগণ বাধা দেয়নি তাদের।
এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন চাচ্ছে, তালেবান যেন নিশ্চিত করে যে, আফগানিস্তানকে কখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর মিত্রদের বিপক্ষে ব্যবহার করা হবে না অথবা এ দেশ ‘সন্ত্রাসের আখড়া’রূপে যেন অপব্যবহৃত না হয়। আমেরিকান কর্মকর্তাদের কথা হলো, ‘তালেবানরা কী অঙ্গীকার করেছিল, যা তাদেরকে পূরণ করতে হবে, তা নিজেদেরই বুঝতে হবে। এখন তারা আইএস-এর মোকাবেলা করছে যে ইস্যুতে আমরা ওদের সাথে অনেকবার আলোচনা করেছি। আইএস-এর হুমকি মোকাবেলার সক্ষমতা নিয়ে আমরা কথা বলেছি তাদের সাথে।’
এ সংগঠন সম্পর্কে তথ্য দিলে তাদের পুরস্কৃত করার নিশ্চয়তা দিয়ে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এখন দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। আইএসকে প্রধান গাফারির অবস্থান এবং ২৬ আগস্টের হামলার ব্যাপার। এসব বিষয়ে আমরা সবাইকে উৎসাহ জোগাব।’ এ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী থেকে ‘বিশ্বজনীন জোট’ বিবৃতি প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়, ‘আইএসকে সংগঠনটি নির্মূল করতে যাবতীয় উপকরণ ব্যবহার করা হবে। ওদের হুমকির বিলুপ্তি না হওয়া নাগাদ আমরা পিছু হটছি না।’ প্রশ্ন হলো, ‘এ জন্য কি আবার মার্কিন সেনা বা ন্যাটো জোট আফগানিস্তানে আসছে? তারা কি পুনরায় যুদ্ধে লিপ্ত হবে?
সাবেক আফগান রাষ্ট্রপ্রধান হামিদ কারজাই তালেবানদের ‘ঘোর বিরোধী’ হিসেবে পরিচিত। তালেবানকে হটিয়ে আমেরিকা তাকেই কাবুলের মসনদে বসায়। সেই কারজাই এখন তালেবান সম্পর্কে নমনীয়। এমনকি, তিনি আমেরিকায় আটকা পড়া আফগান সেন্ট্রাল রিজার্ভের ৭০০ কোটি ডলার ফিরিয়ে দিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জোসেফ বাইডেনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এ সম্পদের অর্ধেক আফগানিস্তানে মানবিক ত্রাণের জন্য ব্যয় করে বাকি অর্ধেক ‘৯/১১’ হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পরিবার-পরিজনকে প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। তা পুনরায় বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে কারজাই বলেন, ‘এ তহবিল সরকারের নয় কোনো দেশের; বরং এটা আফগান জনগণের। তাই এর পুরোটাই আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ফেরত দেয়াই সমীচীন।’
স্মর্তব্য, গত ১১ ফেব্রুয়ারি বাইডেনের এক নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছে, ‘সাড়ে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রাপ্য আফগানিস্তানের জনসাধারণের। আর বাকি অর্থ নাইন ইলেভেনে (২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় যারা ক্ষতির শিকার, তাদের স্বজনরা পাবেন।’ কিন্তু হোয়াইট হাউজের এ আদেশে খুশি হয়নি একাধিক রাষ্ট্র। এ দিকে সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের সাফ কথা, ওসামা বিন লাদেনকে বিদেশীরাই আনে আফগানিস্তানে; কিন্তু এটা আফগানরা করেনি। বিন লাদেন যে দেশ থেকে এসেছিলেন, সে দেশেই মারা গেছেন। তবুও আফগানদের আজো মাশুল দিতে হচ্ছে বিন লাদেনের কাজের জন্য।’ কারজাই বলেছেন, ‘আমেরিকার জব্দকৃত আফগান অর্থ আফগান জাতির ভবিষ্যৎ স্বার্থে জমা থাকবে। এটা দৈনন্দিন ব্যয়ের জন্য নির্ধারিত নয়।’
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন