ছেলেটার বয়স তখন কত হবে, এই বারো কি চৌদ্দ? পরনে একটা ময়লা হাফ প্যান্ট, গায়ে ছেঁড়ামতো হাফ শার্ট। একাত্তরের ডিসেম্বরে সেবার ভালোই শীত পড়েছিল কুমিল্লায়। তখন অবশ্য সারা দেশেই শীতকালে শীত পড়ত, লোকে সাধ্যমতো শীতের জামা-কাপড় দিত গায়ে। এখন বদলে গেছে আবহাওয়া, বদলে গেছে দেশ। ওই শীতে ছেলেটার গায়ে অবশ্য রংচটে শার্টটি ছাড়া আর কিছু ছিল না।
ডিসি অফিস থেকে বের হয়ে এসপি অফিসের পাশ দিয়ে নাতিপ্রশস্ত যে রাস্তাটি ধরে রোজ জিপে করে যাতায়াত করতাম, সেদিনও ওই রাস্তা দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। বেলা তখন প্রায় তিনটা। অফিস থেকে উঠি উঠি করেও উঠতে পারছিলাম না নানা ঝামেলায়। এদিকে ক্ষিদেয় তখন নাড়িভুঁড়ি হজম হওয়ার জোগাড়। হঠাৎ গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। সামনে তাকিয়ে দেখি, গুঁড়ো দুধের বস্তা বোঝাই একটা পিক-আপ রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, আর কয়েকটি শিশু-কিশোর বস্তাগুলো খাবলে-খুবলে দ্রুত দুধ চুরিতে ব্যস্ত। ওদের কারো হাতে বাজার করার চটের ব্যাগ, কারো হাতে গামছা। ওগুলো ভরছে তারা রিলিফের দুধ দিয়ে। পিক-আপের ড্রাইভার-হেলপার বোধহয় সামনের সিটে বসা। পেছনে কী হচ্ছে তারা দেখতে পাচ্ছে না।
দৃশ্যটি দেখেই রক্ত চড়ে গেল মাথায়। তখন কুমিল্লায় আমি ছিলাম এডিশন্যাল ডেপুটি কমিশনার (জেনারেল)। ডিসির দায়িত্বেও ছিলাম আমি। অন্যসব জেলার মতো সরকারের এক ঘোষণায় ডিসি-এসপি দায়িত্ব ছেড়ে ঢাকা রওনা দেন ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ। তখন কুমিল্লা জেলায় এডিসির পদ ছিল মাত্র দু’টি। অন্য এডিসি জনাব শফিকউদ্দিন আহমদ (সাবেক ইপিসিএস) ছিলেন রাজস্বের দায়িত্বে। বাদবাকি সব কাজ, ম্যাজিস্ট্রেসি, আইন-শৃঙ্খলা, উন্নয়ন, সমন্বয়, রিলিফ, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন ইত্যাদি সবকিছু দেখতে হতো আমাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই প্রবীণ সহকর্মী শফিকউদ্দিন সাহেব দীর্ঘদিন ধরে দুরারোগ্য আর্থরাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ছিলেন শয্যাশায়ী। ফলে রাজস্ব বিভাগের অতিরিক্ত দায়িত্বও পালন করছিলাম আমি।
এমন সময় ডিসি জনাব নূরুন্নবী চৌধুরী ও তাঁর সঙ্গে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সতীর্থ বন্ধু এসপি এএসএম শাহজাহান একই দিনে একই গাড়িতে করে চাঁদপুর হয়ে ঢাকা চলে যাওয়ায় আমি পড়লাম সখাত সলিলে। সেই সকাল সাতটা-আটটা থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত শুধু ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা। একাত্তরের ডিসেম্বরে তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নিধিরাম সর্দার প্রশাসনের জন্য এ ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। একদিকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, খাদ্য সঙ্কট, জ্বালানি সঙ্কট, একশ্রেণীর সুযোগসন্ধানী দুর্বৃত্তের লুটপাট-দখলবাজি-রাহাজানিতে মেতে ওঠা, আরেক দিকে ভারত-প্রত্যাগত সহায়-সম্বলহীন অগণিত মানুষের আশ্রয়শিবিরে আহার-বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা, তাঁদের নানাবিধ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা ইত্যাদি হাজারটা জানা-অজানা দায়িত্বের চাপে আমার তখন মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। এমনসব কাজও তখন করতে হয়েছে যা ছিল কল্পনারও বাইরে।
একটা উদাহরণ দেই। রাত আটটার দিকে অফিসে বসে একদিন কাজ করছি, এমন সময় খবর এল, রিলিফ-বোঝাই একটা প্লেন এসে ল্যান্ড করেছে কুমিল্লা এরোড্রামে। মাল খালাস করে প্লেনটিকে এখনই ফিরে যেতে হবে ঢাকায়। পাইলটের হাতে সময় নেই মোটেই। অথচ মাল খালাসের কাজ নাকি হচ্ছে মন্থর গতিতে। পাইলট রাগ করে রিলিফের মাল নিয়েই ফিরে যেতে চাচ্ছেন ঢাকা। এরোড্রামে যে দু’চারজন কর্মচারী রিলিফের কাজ করছিলেন তাদের সঙ্গেও নাকি রাগারাগি করেছেন পাইলট। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমার সামনে উপবিষ্ট রিলিফের দায়িত্বে নিয়োজিত অত্যন্ত দক্ষ, নিষ্ঠাবান ও করিৎকর্মা প্রৌঢ় অফিসার ইসলাম সাহেবকে (দুঃখিত, পুরো নামটি এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না) সঙ্গে নিয়ে ছুটলাম এরোড্রামে।
কুমিল্লা এরোড্রাম কাছেই, শহরের দক্ষিণ প্রান্তে লাকসাম রোডের লাগোয়া। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আমরা। গিয়ে দেখি, আমাদের কর্মচারী ও শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জটলা করছে। আর পাইলট প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখনই ঢাকা ফিরে যাওয়ার। যা বুঝলাম তাতে মনে হলো, আসলে দুই পক্ষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। পাইলট ভেবেছেন, এরা ফাঁকিবাজ, ইচ্ছা করে দেরি করছে, আর আমাদের লোকেরা বলছে, তাদের লোকবল কম, তাই মাল খালাসে সময় লাগছে। তখন রাত হয়ে গেছে, চট করে আরও শ্রমিক পাওয়া যাবে না। দুই পক্ষকে বিষয়টি বুঝিয়ে আমি আবার কাজ শুরু করালাম। শুধু তাই না, আমি, ইসলাম সাহেব ও আমার ড্রাইভার চান মিয়াও হাত লাগালাম কম্বলের গাঁইট নামাতে। আমার দেখাদেখি পাইলট ও তাঁর সহকর্মীও যোগ দিলেন। হঠাৎ একটি গাঁইট-বাঁধার টিনের পাতে আমার হাতের তালু কেটে দরদর করে রক্ত ঝরতে লাগল। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল ব্যান্ডেজ বেঁধে রক্ত বন্ধ করতে। আমি বললাম, ব্যান্ডেজ লাগবে না, রুমাল বেঁধে দিচ্ছি। তারপর হাসতে হাসতে যোগ করলাম, ‘রক্ত যখন দিয়েছি আরও দেবো’।
তখন এমনই তুঙ্গে ছিল আমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা। আমার সহকর্মী ইসলাম সাহেব, টি এ চৌধুরী, (তোফায়েল আহমদ চৌধুরী), সদর (দক্ষিণ) এসডিও মইনুদ্দিন আহমদ প্রমুখ সবাইকে নিয়ে সুন্দর একটি টিম গঠন করেছিলাম। সবার মধ্যে একটা দারুণ কর্মোদ্যম, উন্মাদনা, একটা ত্যাগী মনোভাব লক্ষ্য করেছি তখন। সবাই জানতেন, সদ্যস্বাধীন দেশে আমাদের সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ, একটা শূন্য অবস্থান থেকে মাথা তুলে দাঁড়াবার চ্যালেঞ্জ। সব প্রতিকূলতাকে জয় করে প্রশাসনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ... এখন মনে হয়, আমরা বোধ হয় সেই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলাম।
তা সেই কষ্টের রিলিফ-সামগ্রী চোখের সামনে চুরি হচ্ছে, আর আমি হা করে তাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব? অসম্ভব। এক লাফে জিপ থেকে নামতে নামতে ড্রাইভার চান মিয়াকে বললাম, ধরো বদমাসগুলোকে। একটাকেও পালাতে দেবে না। আমাদের দেখে দুধ-টুধ ফেলে ছুটে পালাল ওই কিশোররা। কিন্তু একজন ধরা পড়ল। এবং ধরা পড়ল আমারই হাতে। তার চুলের মুঠি ধরে কষে লাগালাম এক চড়। ‘বল্, বদমাসের বাচ্চা বদমাস, আর কোনোদিন রিলিফের মাল চুরি করবি?’ রাগে-উত্তেজনায় আমি তখন রীতিমতো কাঁপছি। মার খেয়ে ছেলেটি ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিল। তার কান্না দেখে আমার মন গল্ল না। লাগালাম আরও কয়েকটা চড়-থাপ্পড়। ততক্ষণে পার্শ্ববর্তী এসপি অফিস থেকে দু’জন সিপাই এসে হাজির অকুস্থলে। বললাম, এই ছোকরাকে থানায় নিয়ে গিয়ে রিলিফের দুধ চুরির মামলা দিন। বাদী আমি। সিপাইরা ধরে নিয়ে গেল ওকে। সে তখন আরও জোরে জোরে কাঁদছে ভেউ ভেউ করে। সেই কান্না একটুও বিচলিত করল না আমাকে।
॥২॥
তারপর? একাত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোর পর আমরা সুখে-দুঃখে পেরিয়ে এসেছি অনেকগুলি বছর। বাংলাদেশের বয়স এখন ৪৫। বাংলাদেশ এখন আর এককালের ‘তলাহীন ঝুড়ি’ নয়। এখন, মাশাল্লাহ, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বাংলাদেশের উন্নতির মরাই উপচে পড়ছে সমৃদ্ধির শস্যদানা। এখন আর রিলিফের প্লেন আসে না এদেশের কোনো বিমানবন্দরে, টোকাই ছেলেরা দুধ চুরিও করে না পিক-আপ ভ্যান থেকে (এখন অবশ্য তারা ব্যস্ত আরও বড় বড় কায়-কারবারে!)।
সেদিন ওই ছেলেটিকে মেরেছিলাম দুধের বস্তা ফুটো করে গুঁড়ো দুধ চুরি করার জন্য। হয়তো ওই অতি স্বল্প পরিমাণ চোরাই মাল কোনো চায়ের দোকানে বিক্রি করে সে পেত সামান্য ক’টি টাকা, যার প্রত্যাশায় বসে আছে বস্তিতে বসবাসরত তার হতদরিদ্র পরিবার। সেদিন জীবনের এই কঠিন বাস্তব দিকটা আমার কাছে ধরা পড়েনি, আমার দু’চোখে তখন শুধু এক স্বপ্নের মায়া-অঞ্জন : লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই প্রাণের দেশে কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবো না আমরা; আমরা গড়ে তুলব সত্য, সুন্দর ও ন্যায়নীতির ওপর ভিত্তি করে এক স্বপ্নের দেশ। সে দেশের প্রশাসন হবে সম্পূর্ণ কলুষমুক্ত এক গণমুখী প্রশাসন। ...
সেদিন চোখের সামনে দিয়ে পিঁপড়েটা যেতে পারেনি, তাকে পিষে মেরে ফেলার জন্য সে কী অস্থিরতা আমার।
কিন্তু তারপর? তারপর কত শত হাতি-ঘোড়া দৃপ্ত পদভরে, বৃংহণধ্বনি আর হ্রেষারবের নিনাদ তুলতে তুলতে চলে গেল আমাদের অসহায় দৃষ্টির সম্মুখ দিয়ে। এখনও যাচ্ছে। আমরা কিছুই করতে পারি না, বা করি না। আমাদের এই সীমাহীন ক্লীবত্বের জন্য কি জাতি আমাদের ক্ষমা করবে? জনগণের কত হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ আত্মসাৎ করে যারা বছরের পর বছর নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্তে সুখনিদ্রা দিচ্ছে, বৃষস্কন্ধে কয়েক টন ফুলের মালা ঝুলিয়ে জনসভায় সততা, নৈতিকতার ওপর বক্তৃতা করে ফেনা তুলছে মুখে, তাদের দিকে তাকালেই আমার মনে পড়ে যায় ওই কিশোরটির কথা, যে শুধু পেটের দায়ে একাত্তরের ডিসেম্বরের এক ক্লান্ত অপরাহ্নে গুঁড়ো দুধের বস্তা থেকে দুধ চুরি করতে প্রবৃত্ত হয়েছিল।
আর আমি তাকে বেধড়ক পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলাম আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মহান আদর্শ বুকে নিয়ে! ... ডিসেম্বর এলেই নতুন করে মনে পড়ে যায় সেই বালকটির কথা। জানি না সে এখন কোথায় আছে, কেমন আছে। নাকি সে গহীন অরণ্যে প্রতিনিয়ত ঝরে পড়া লক্ষ কোটি ঝরাপাতার মতো অলক্ষ্যে কবে কোথায় ঝরে পড়েছে, আর পরপারে বসে আমাকে দেখে শুধু হাসছে করুণার হাসি, আর বলছে : কী স্যার, এখন আর দুধচোরাদের ধরার জন্য স্থানকালপাত্র ভুলে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে যান না? রোজ যারা গোটা দেশটাকে চুরি করে ফোকলা করছে তারা আপনাদের চোখে কি ধুলিপড়া দিয়ে রেখেছে যে আপনারা তাদের দেখেও দেখেন না? সত্যি, আপনারা সবাই একেকজন বিরাট বীরপুরুষ ‘বীরমহিলা’ বটে। বলিহারি আপনাদের দেশপ্রেম!
না বাবা, আমি মোটেই কোনো বীরপুরুষ নই, আমার দেশপ্রেমও ভীরু কবুতরছানার মতো, সাত আসমান দূরে উড়তে থাকা বাজপাখির ডাক ভেসে এলেই ভয়ে খোড়লে ঢুকে পড়তে চায় সে। কী করব বাপ, একাত্তরে খানসেনারা সবাইকে মেরে ফেলে যাওয়ার পর আমরা জানতে পারলাম গ্রামের পলিতকেশ বুড়ো থুত্থুড়ো ‘ইনসাফ’ দাদুকেও তারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আমার সেদিনের ‘অপরাধের’ জন্য যদি পারিস, তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস, বাবা।
॥৩॥
ক্ষমা চাওয়ার আছে আরেকজনের কাছেও। সেই ঘটনাও ঘটেছিল স্বাধীনতার পর ওই কুমিল্লাতেই। ওটা ছিল মার্চ ’৭২ সালের ঘটনা। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হিসেবে কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যানও ছিলাম আমি। স্বাধীনতার পর পৌরসভার আইন উপদেষ্টার পদ খালি হলো। পাকিস্তানি আমলে ওইসব পদে সাধারণত সরকারপন্থী কোনো আইনজীবীকে নিয়োগ দেওয়া হতো। যোগ্যতার চেয়ে বেশি ওই ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয়, সরকারের প্রতি আনুগত্য, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সখ্য ইত্যাদিই বেশি বিচার করা হতো। আমি পৌরসভার তৎকালীন সচিব, অত্যন্ত দক্ষ ও বিচক্ষণ কর্মচারী, মিনহাজউদ্দিন সাহেবকে ডেকে বললাম, এবার আমরা যথার্থ যোগ্য, সৎ ও সুনামের অধিকারী একজনকে এই পদে নিয়োগ দেবো, কোনো রাজনৈতিক বিবেচনায় বা ‘আমাদের নিজেদের লোক’ কাউকে আইন উপদেষ্টা বানাব না। এরপর আমার নির্দেশমতো প্রার্থীদের কাছ থেকে দরখাস্ত চেয়ে স্থানীয় সাপ্তাহিক ‘আমোদ’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো।
ইতিমধ্যে অযাচিতভাবে বেশ কয়েকটি দরখাস্ত এসেছিল আমার কাছে। এর মধ্যে স্থানীয় কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতার সুপারিশসম্বলিত দরখাস্তও ছিল। এগুলো উপেক্ষা করে আমি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে দিলাম দরখাস্ত চেয়ে। ব্যস, আর যাবে কোথায়। বিজ্ঞাপন তো নয়, যেন মৌচাকে ঢিল। সুপারিশকারীরা রীতিমতো খেপে গেলেন রাজনৈতিকভাবে পরিচিত তাঁদের পছন্দের কাউকে নিয়োগ না দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়াতে।
সবচেয়ে বেশি কূপিত হলেন ওই সময় যিনি কুমিল্লা জেলার স্বঘোষিত প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ছিলেন তিনি। পেশায় আইনজীবী ওই ভদ্রলোক এমনিতে একজন অমায়িক ও সৎ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সমীকরণও ভালোই ছিল। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনটি দেখেই তিনি আমাকে সাত সকালে ফোন করে দারুণ ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানালেন। তাঁর মূল বক্তব্য, আমি কেন তাঁর সুপারিশকৃত ব্যক্তিকে নিয়োগ না দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলাম। প্রচ্ছন্নভাবে বেশ হুমকি-ধমকিও দিলেন টেলিফোনে। এমনকি এর পরিণাম যে আমার জন্য শুভ হবে না সে ইঙ্গিতও দিলেন। প্রায় চল্লিশ মিনিটের ওই ফোনালাপে এক পর্যায়ে আমি বলতে বাধ্য হলাম, পাকিস্তানি সেনাদের হাতে যখন মরিনি তখন কপালে আপনাদের হাতে মৃত্যু লেখা থাকলে না হয় মরব। এভাবে বেশ উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের পর শেষ হলো আমাদের কথোপকথন। তবে হ্যাঁ, উল্লেখ্য, আমরা এই ফোনালাপের মধ্যে কখনওই ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করিনি।
ভদ্রলোক হয়তো ভেবেছিলেন এরপর আমি ওই বিজ্ঞাপন বাতিল ঘোষণা করব, অথবা আমার অফিসকে বলব তাঁর সুপারিশকৃত ব্যক্তির নামে নিয়োগপত্র জারি করতে। কিন্তু আমি এর কোনোটাই করলাম না, আমার সিদ্ধান্তে অনড় রইলাম।
কিন্তু ওই নেতা- যাঁকে আমি এখনও অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য, তাঁর সততা ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য- বসে থাকলেন না। তিনি আমার বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘ অভিযোগপত্র লিখে বসলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। তাতে একজন সরকারি কর্মচারীর চরিত্রহননের জন্য যে যে উপাদান থাকা দরকার তার সবই ছিল। চিঠিটির একটি কপি দিয়েছিলেন কুমিল্লার ওই সময়ের ডিসি, সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি)-এর আমার এক বছরের জুনিয়র, ১৯৬৭ ব্যাচের মুজিবনগরফেরত অফিসার কাজী রকিবউদ্দিনকে। এবং মজার ব্যাপার হলো, আমাকেও একটি কপি দিয়েছিলেন। বোধ হয় ভয় দেখানোর জন্য এবং ওই প্রক্রিয়ায় আমার সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে তাঁর প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য। চিঠি পড়ে রকিব ও আমি দু’জনেই একচোট হেসেছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে লেখা তাঁর অভিযোগপত্রটির সদগতি কীভাবে হয়েছিল জানি না।
এখন মনে হয়, ওই প্রবীণ রাজনীতিবিদের সুপারিশ গ্রহণ না করে, তাঁর ‘ইগো’কে আঘাত করে তাঁর সঙ্গে ফোনে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা না বললেই হতো। হাঁ, এখন মনে হয়, তখন মনে হয়নি। কারণ এরপর থেকে তো দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, প্রশাসন চলেছে এক অদ্ভুত জংধরা নিয়মে যা সাধারণ মানুষের ধারে-কাছেও নেই। ‘এক সাগর রক্ত’ তাকে ধুয়ে-মুছে সামান্যই পরিষ্কার করতে পেরেছে। বরং এতে যুক্ত হয়েছে দলীয়করণ নামক একটি আত্মঘাতী ভাইরাস। সেই বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ, আলহামদুলিল্লাহ, এখনও বেঁচে আছেন। প্রার্থনা করি, আল্লাহ তাঁকে শতায়ু করুন, সুস্বাস্থ্য দান করুন। বাহাত্তরের মার্চের সেই সকালের দীর্ঘ ফোনালাপের অসৌজন্যমূলক ও দুর্বিনীত অংশের জন্য আমি দুঃখিত, তাঁর কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
আর সৃষ্টিকর্তার কাছে বরাবরের মতো রাখছি সেই অনাদ্যন্ত প্রশ্ন : যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,/তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
মোফাজ্জল করিম : কবি, সাবেক সচিব ও সাবেক রাষ্ট্রদূত
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন