তুরস্কের স্থানীয় নির্বাচনের বার্তা
03 April 2024, Wednesday
তুরস্কের আলোচিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের দল একে পার্টি প্রধান বিরোধী দল সিএইচপির কাছে হেরে গেছে। গত ৩১ মার্চ দেশের ৮১টি প্রদেশজুড়ে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় নির্দলীয় পদ ছাড়াও এক হাজার ২৮২ জন প্রাদেশিক এবং ২১ হাজার একজন পৌর কাউন্সিলরসহ মোট ৩০টি মেট্রোপলিটন ও এক হাজার ৩৬৩ জেলা পৌর মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন এবার।
২০২৩ সালের সংসদীয় ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নয় মাস পরে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট ও দ্রুত ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি সত্ত্বেও বিরোধী ন্যাশন জোট রাষ্ট্রপতি রজব তৈয়ব এরদোগানের শাসক পিপলস জোটের কাছে পরাজিত হয়। এ পরাজয়ের পরে, প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) এবং গুড পার্টি কার্যকরভাবে সব মেয়র পদের জন্য পৃথক প্রার্থীদের নিয়ে নির্বাচনে যায়। আর এটি ছিল প্রথম দেশব্যাপী নির্বাচন যা সিএইচপির নতুন নেতা ওজগুর ওজেল দায়িত্ব নেয়ার পর অনুষ্ঠিত হলো। তিনি ২০২৩ সালের নভেম্বরে তার পূর্বসূরি কামাল কিলিকদারোগলুকে সফলভাবে চ্যালেঞ্জ করে দলের প্রধান হন।
বিরোধী দলের অপ্রত্যাশিত বিজয়
এবারের স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল বিরোধী সিএইচপির জন্য এক অপ্রত্যাশিত বড় বিজয় ছিল। দলটি জোট ছাড়া নির্বাচন করেই তার বেশির ভাগ মেট্রোপলিটন মেয়র পদ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। সিএইচপির ইস্তাম্বুলে প্রার্থী একরেম ইমামোলু ৫১ শতাংশ ভোট নিয়ে পুনঃনির্বাচিত হন আর আঙ্কারার প্রার্থী মনসুর ইয়াভাস ৬১ শতাংশ ভোট পেয়ে পুনরায় মেয়র নির্বাচিত হন। উভয় মেয়রই তাদের নিজ নিজ মেট্রোপলিটন কাউন্সিলে তাদের আগের মেয়াদের তুলনায় বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা জিতেছেন। এর বাইরে দেশটির আরো তিনটি বৃহৎ মহানগরীতে জয়ী হয় সিএইচপি। বুর্সা, বালিকেসির, মানিসা, কুটাহা, আদিয়ামান, আমাস্যা, কিরিক্কালে এবং ডেনিজলিসহ বিগত দুই দশক ধরে সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলগুলোতে সিএইচপি অনেক অপ্রত্যাশিত জয় পেয়েছে। সামগ্রিকভাবে, সিএইচপি তুরস্কের ৮১টি প্রাদেশিক রাজধানীর মধ্যে ৩৫টিতে জিতেছে, যেখানে পিপলস অ্যালায়েন্স জয়ী হয়েছে ২৪টিতে।
২০০১ সালে ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি) প্রতিষ্ঠার পর এটিই প্রথম জাতীয় নির্বাচন যেখানে দলটি প্রথম হতে পারেনি। সারা দেশে একে পার্টির ৩৫.৫ শতাংশ ভোটের তুলনায় সিএইচপি ৩৭.৫ শতাংশ ভোট জিতেছে। সামগ্রিকভাবে খারাপ ফলের পরও পিপলস অ্যালায়েন্স বিরোধীদের বিরুদ্ধে ঐতিহ্যগতভাবে বিরোধী-পক্ষে থাকা কয়েকটি মেয়র পদে জয়লাভ করেছে।
ছোট মধ্য-ডান বিরোধী গুড পাার্টি সারা দেশে খারাপ পারফর্ম করে পপুলার ভোটে ষষ্ঠ স্থানে নেমে গেছে। অন্যদিকে, ইসলামপন্থী রক্ষণশীল নিউ ওয়েলফেয়ার পার্টি (ওয়াইআরপি) প্রথমবারের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচন করে ৬ শতাংশের বেশি ভোট নিয়ে তৃতীয় স্থানে চলে এসেছে। দলটি একে পার্টির রক্ষণশীল এলাকায় অনেক পৌরসভায় জিতেছে। কুর্দিপন্থী ডিইএম পার্টি তাদের ভোটের অংশে সামান্য উন্নতি করেছে। একে পার্টির জুনিয়র অ্যালায়েন্স পার্টনার ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টি (এমএইচপি), অনেক পপুলার ভোট হারিয়েছে কিন্তু আগের নির্বাচনে জিতেছে এমন অনেক পৌরসভার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে।
এরদোগানের ‘নির্বাচনী বিপত্তি’ স্বীকার
প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ থেকে তার সমর্থকদের উদ্দেশে দেয়া বক্তৃতায় এরদোগান এবারের ফলকে ‘নির্বাচনী ধাক্কা’ বলে স্বীকার করে বলেছেন যে, তার দল তুরস্কের বিভিন্ন অংশে কাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জন করতে পারেনি। তিনি আরো বলেছেন যে, জনগণ সরকারকে একটি ‘বার্তা’ প্রদান করেছে এবং ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তার দল ‘সাহসী’ আত্ম-সমালোচনায় যুক্ত হয়ে এই বার্তাটি বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নেবে।
এরদোগান গত বছর উপস্থাপিত অর্থনৈতিক কর্মসূচির সাথে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যার লক্ষ্য মুদ্রাস্ফীতি মোকাবেলা করা। এবারের ভোটটিকে এরদোগানের জনপ্রিয়তার একটি পরিমাপ হিসাবে দেখা হয়েছিল কারণ তিনি পাঁচ বছর আগে নির্বাচনে বিরোধীদের কাছে হেরে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ শহুরে এলাকার নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলেন।
পর্যবেক্ষকদের মতে, ২০১৯ সালে আঙ্কারা এবং ইস্তাম্বুলে সিএইচপির বিজয় এরদোগানের অপরাজেয়তার আভাকে ভেঙে দেয়। ৭০ বছর বয়সী তুর্কি রাষ্ট্রপতির প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র ছিল ১৬ মিলিয়ন জনসংখ্যার শহর এই ইস্তাম্বুল, যেখানে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বেড়ে উঠেছিলেন এবং ১৯৯৪ সালে মেয়র হিসাবে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন। ইস্তাম্বুলের এবারের ফলাফলটি বিরোধীদের জন্য উৎসাহ হিসাবে এসেছিল, যা গত বছরের রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচনে এরদোগান ও ক্ষমতাসীন ইসলামপন্থী জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির কাছে পরাজয়ের পরে একটি বেদনাদায়ক আঘাত দিয়েছিল।
সিএইচপি নতুন নেতা ওজগুর ওজেল সমর্থকদের একটি সমাবেশে বলেছেন, ভোটাররা তুরস্কে একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা তুরস্কে ২২ বছর ধরে টিকে থাকা চিত্রটি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং আমাদের দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক আবহাওয়ার দরজা খুলে দিয়েছে।
কেন এই বিপর্যয়কর ফলাফল
ইস্তাম্বুলভিত্তিক এডাম রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক সিনান উলগেন বলেছেন, ক্ষমতাসীন দলকে কঠিন অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে শাস্তি দিতে ভোটারদের ইচ্ছার কারণে স্থানীয় নির্বাচনে এই ‘আশ্চর্যজনক ফলাফল’ হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার অনেক তুর্কি পরিবারকে মৌলিক পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন করেছে। উলগেন যোগ করেছেন যে, একেপি সমর্থকদের অনেকে ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে থাকাই বেছে নিয়েছে অথবা অন্য দলকে ভোট দিয়েছে।
এবার প্রায় ৬ কোটি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে ১০ লাখেরও বেশি নতুন ভোটার ছিল। তবে আগের বার স্থানীয় নির্বাচনে যেখানে অংশগ্রহণের হার ছিল ৮৭ শতাংশ, সেখানে এবার ভোট দিয়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ। আর নতুন ভোটারদের কম সংখ্যকই সরকারি দলের বাতি প্রতীকে ভোট দিয়েছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান স্থানীয় নির্বাচনে তার দলের পরাজয়ের কথা স্বীকার করে বলেছেন যে, ভোটটি তার ক্ষমতাসীন দলের জন্য দুই দশকের মধ্যে একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ গঠন করেছে। এই টার্নিং পয়েন্ট তৈরির সম্ভাবনা ৯ মাস আগের সাধারণ নির্বাচনেও স্পষ্ট হয়েছিল। সে সময় তিনি অর্থনীতির গতি ঘোরানোর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা কার্যকর করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। মূল্যস্ফীতি ৬৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, এক ডলারের জন্য ৩২ লিরার বেশি গুনতে হচ্ছে এখন। এক বছরেই ডলারের দাম ১৯ লিরা থেকে ৩২ লিরা ছাড়িয়ে গেছে। সেই সাথে সুদহার পার হয়ে গেছে ৫০ শতাংশ।
এরদোগানের দলের বিপর্যয়ের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণটি ছিল গাজায় গণহত্যা বন্ধে কার্যকর কোনো ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থতা। এক্ষেত্রে তার উচ্চারিত কথামালার সাথে বাস্তব পদক্ষেপের মিল পাননি দেশের মানুষ। দেশ বিদেশের মানুষ এরদোগানের মতো নেতার কাছ থেকে যে ধরনের কাজ আশা করেন সেটি পাওয়া যায়নি গাজা ইস্যুতে। বরং তিনি তার ভোট বলয়ে ইসরাইলের সাথে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছেদ করার দাবিতে সাড়া দেননি। মানুষ মনে করেছে, এরদোগান চূড়ান্ত পর্যায়ে ন্যাটোর পশ্চিমা নেতাদের ক্রোধকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেছেন। এটি যে রক্ষণশীল ভোটরদের জন্য হতাশার কারণ ছিল, তার একটি সঙ্কেত পাওয়া যায় ইস্তাম্বুলে এরদোগানের সর্বশেষ নির্বাচনী জনসভায়। এর আগে গাজায় ইসরাইলের হামলার প্রতিবাদে সেখানে আয়োজিত সমাবেশে ১৫ লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল। কিন্তু এবারের নির্বাচনী সভাবেশে ছয় লাখের বেশি মানুষ সমবেত হয়নি। ইস্তাম্বুলে যেখানে ৫৫ শতাংশ ভোটার রক্ষণশীল সেখানে একে পার্টির প্রার্থীর ভোট ৪০ শতাংশের কোটায়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ও এরদোগান এর চেয়ে ৯ ভাগ বেশি ভোট পেয়েছিলেন।
বিরোধী সিএইচপি যেখানে কট্টর সেক্যুলার নেতৃত্ব থেকে রক্ষণশীলতার দিকে ঝুঁকে এক ইমামের ছেলে ইমামুলুকে ইস্তাম্বুলের মেয়র বানিয়েছে সেখানে এরদোগানের চার পাশে সেক্যুলার মানসিকতার লোকদের ভিড় বেড়েছে। ইস্তাম্বুলে যাকে তিনি মেয়র মনোনয়ন দিয়েছেন তিনি কামাল আতাতুর্কের আদর্শে দেশ গড়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। এর পাশাপাশি বিগত নির্বাচনে একেপিকে সমর্থনকারী নিউ রাফা পার্টির কাছে যখন এরদোগানের নেতৃত্বের ব্যাপারে দ্বিমুখিতার অভিযোগ শুনেছে তখন অনেক রক্ষণশীল ভোটার এরদোগানের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
এছাড়া অনেক সময় মনে হয়, এরদোগান তার উত্থানের যে পটভূমি তার সাথে শেষের দিকের বছরগুলোতে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি করেছেন। যদিও এরদোগানের সমর্থনের বলয় তৈরি করেছে ইসলামিস্টরা। তিনি নিজেও ইমাম হাতিম স্কুলের ছাত্র ছিলেন। আদর্শগতভাবে সাইয়েদ বদিউজ্জামান নুরসি এবং রাজনৈতিকভাবে নাজমুদ্দিন আরবাকানের রেফা পার্টি এরদোগানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি করেছে। আর ছাত্র অঙ্গন, বুদ্ধিবৃত্তিক ও অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে গুলেন আন্দোলন এরদোগানের ক্ষমতায় আসার সময় গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ছিল। ক্ষমতার উত্তরাধিকার ও কর্তৃত্ব প্রশ্নে এরদোগানের সাথে ফতেহ উল্লাহ গুলেনের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এরদোগান গুলেনের নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে এমনভাবে খড়গহস্ত হন যে, তিনি গুলেন মুভমেন্টকে একটি টেরোরিস্ট আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত করেন। ২০১৬ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর এটি চরম একটি রূপ লাভ করে। গুলেনিস্টদের প্রভাব সমাজের গভীর থেকে উৎপাটনের জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়। অথচ তুরস্কের সমাজের গভীরে সেক্যুলারিজমের প্রভাব মুছে দেয়া বিশেষত সেনাবাহিনীতে ইসলামিস্টদের প্রভাব বিস্তারে গুলেন আন্দোলনের ব্যাপক অবদান ছিল। গুলেনিস্ট দমনের কারণে এ ক্ষেত্রে একটি শূন্যতা তৈরি হয়। সেই শূন্যতা পূরণের জন্য এরদোগান মিসর থেকে সিসির দমন পীড়নে তুরস্কে আশ্রয় নেয়া মুসলিম ব্রাদারহুডের সহায়তা নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিসরের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে সেখান থেকে তিনি সরে আসেন। এর ফলে ছাত্র যুবকদের মধ্যে ইসলামী আদর্শের ভিত দুর্বল হয়ে যায়।
অন্যদিকে এরদোগান দুই দশকের বেশি ক্ষমতায় থাকলেও শিক্ষাব্যবস্থার আদর্শিক অভিমুখ পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেননি। এর ফলে ছাত্র ও যুবকদের মধ্যে সেক্যুলারিস্ট একটি প্রজন্ম তৈরি হয়। এটি এরদোগান ও তার একে পার্টির জন্য বিপত্তি তৈরি করে। নতুন ভোটারদের বৃহদংশ এরদোগানের বিরুদ্ধে ভোট দিচ্ছে বারবার।
এরদোগান তার ভোট বলয়ের অন্যতম ভিত্তি, সিনিয়র ভোটারদের সমর্থন এবার ব্যাপকভাবে হারিয়েছেন। ইব্রাহিম কারাগুল এটিকে একেপির বিপর্যয়ের একটি মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। ৬৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতির কারণে অবসরভোগী ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক দুর্দশা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এই শ্রেণীকে বিপত্তি থেকে রক্ষার জন্য এরদোগান কার্যকর কিছু করেননি। ফলে তাদের বড় একটি অংশ এবার ভোট দিতে যায়নি। কারাগুলের মতে, এবার প্রদত্ত ভোটের হার ১০ ভাগ কমার পেছনে এটি একটি বড় কারণ।
একে পার্টির এবারের বিপর্যয়ের আরেকটি কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হচ্ছে, ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্রদের দূরে ঠেলে দেয়া। ২০০১ সালে একে পার্টি যখন করা হয় তখনকার অনেক প্রতিষ্ঠাতা সহযোগী এখন আর এরদোগানের সাথে নেই। একেপির যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল বারবার চেষ্টা করার পরও দলে তাকে বড় কোনো ভূমিকায় স্বাগত জানানো হয়নি। এরদোগান সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী ও গুলঘনিষ্ঠ আলি বাবাকান দল থেকে বের হয়ে ভিন্ন দল তৈরি করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমদ দাউতুগ্লু একেপি থেকে বের হয়ে ফিউচার পার্টি গঠন করেছেন। এমনকি সর্বশেষ নির্বাচনে এরদোগানকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে সমর্থনকারী ফাতিহ এরবাকানকে দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে তার দলকে ছাড় দেয়ার প্রস্তাব নাকচ করে। এসবের কারণে এরদোগান ক্রমাগতভাবে রক্ষণশীল ইসলামিস্ট বলয়ের সাথে একটি দূরত্ব তৈরি করে তার ভোট ভিত্তিকে বিভাজনে ভূমিকা রেখেছেন। এর মূল্য এবার অনেক বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
সর্বশেষ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এরদোগানের প্রতি জনগণের আস্থায় চিড় ধরিয়েছে বলে মনে হয়। একেপির সাফল্যের মূল ভিত্তি ছিল কাজ। জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাওয়ার এ শক্তি দুই দশকের ক্ষমতার মেয়াদে, কিছুটা ভোঁতা হয়ে গেছে। এক সময় এরদোগান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তো জনগণ বিশ্বাস করত, তিনি সেটি করবেন। প্রতিশ্রুতি অনুসারে তুর্কি অর্থনীতিকে আমূল পরিবর্তন করেছেন এরদোগান। কিন্তু এখন তার সেই কারিশমা দুর্বল হয়ে গেছে। তিনি অনেক ক্ষেত্রেই ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। আর নীতিতে অটল অবিচলও থাকতে পারছেন না। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এরদোগানের অস্থিরতা বেশ ক্ষতির কারণ হয়েছে। লিরার অবনমন এবং নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা কোনোভাবেই ঠেকাতে পারছেন না তিনি। অনেকে মনে করছেন, এই অক্ষমতা অব্যাহত থাকলে ২০২৮ সালে এরদোগানের বিদায় দলের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই ঘটতে পারে।
এরপরও এরদোগানে অনেক প্রত্যাশা
এরদোগানের ব্যর্থতার চেয়ে এখন পর্যন্ত সাফল্যের ফিরিস্তি অনেক বেশি দীর্ঘ। এরদোগানের নেতৃত্ব তুরস্ককে একটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত করেছে। সামরিক শিল্পে তুরস্ক পাশ্চাত্যের এখন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হতে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় তুর্কি প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। তুর্কি রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সৃষ্ট ঐক্য তুরস্ককে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার ভিত্তি তৈরি করছে। ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পরও এরদোগান একটি বহুমুখী বিশ্ব গড়ার উদ্যোগে ভেতর থেকে ভূমিকা রাখছেন। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঐক্যের বন্ধন তৈরিতেও তার বিশেষ উদ্যোগ রয়েছে।
এরদোগান যদি বিপর্যয়কে সত্যি সত্যি টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে বিবেচনা করে তুরস্কের আবারো ঘুরে দাঁড়ানোর একটি ভিত তৈরি করতে পারেন তাহলে তুর্কি জাতি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র তৈরির স্বপ্ন পূরণে ভূমিকা রাখতে পারলে রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও এরদোগান স্মরণীয় হয়ে থাকবেন দেশে বিদেশে। এতে তিনি কতটা সফল
হবেন, সেটি তার আগামী দিনের কাজই ঠিক করে দেবে।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন