বাংলাদেশে সবকিছু এখন পাইকারি হারে ঘটছে। শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন দমনে পাইকারি বল প্রয়োগ করা হয়েছে। পাইকারি গোলাগুলিতে ২০০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে; বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। পাইকারি হারে কোল খালি হয়েছে অনেক মায়ের। পুলিশ ও ছাত্রলীগেও আহত কম নয়। অন্তত তিনজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। আন্দোলনের মধ্যে পাইকারিভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ধ্বংস ঘটেছে। এখন চলছে পাইকারি হারে গ্রেপ্তার। মামলা হয়েছে অজ্ঞাতনামা ৬০ হাজার নাগরিকের বিরুদ্ধে।
লাশগুলো তরুণদের, লাশগুলোর গায়ে বিভিন্ন রকমের বুলেটের চিহ্ন– রাবার বুলেট, বারুদ বুলেট ইত্যাদি। লাশগুলো আগামীর বাংলাদেশের। একটা পুরো প্রজন্মের বুকে যে ক্ষতচিহ্ন তৈরি হলো, তার দাগ থেকে যাবে দীর্ঘদিন। শুধু তরুণ প্রজন্ম নয়, যারা নাকি কিশোর-কিশোরী, তারাও এতটা আবেগে উদ্বেল হয়নি কখনও। ওরা সবাই মোটামুটি ডিজিটাল বিশ্বায়নের সন্তান। দিন-দুনিয়ার খবর রাখে। কোনো বিভেদের জালে এরা ধরা দেয় না। এদের সহজেই কোনো মিথ্যা বুঝে বশ মানানো যাবে না। হিন্দু-মুসলিম, আধুনিক ও রক্ষণশীল, ধনীর দুলাল ও গরিবের সন্তান সব এক কাতারে এখন। অসহায় শিক্ষার্থীদের মৃত্যুদৃশ্য চাক্ষুষ করেছে যে কোটি কোটি মানুষ, তারা এই দুঃসহ স্মৃতি, এই জ্বালা ধরানো শোক থেকে সহসা মুক্তি পাবে না। সুতরাং শান্তি সুদূরপরাহত।
Video Player is loading.
Pause
Mute
Remaining Time -10:03
Close PlayerUnibots.com
চলমান জ্বলন্ত অশান্তির কারণগুলো রহস্যের চাদরে ঢাকা। সরকার যদি কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবির চেয়ে বেশি হারে কোটা বাতিল করবে, তাহলে কেন তিরস্কার-টিটকারি করা হলো? সবই যদি মেনে নেওয়া হবে, তাহলে কেন এত দেরি করা হলো, কেন এত রক্তপাতের আয়োজন হলো? এত রক্তপাতের পরে কি আর বিশ্বাস করা যায় যে, সরকার গোড়া থেকেই ছাত্রসমাজের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল?
দ্বিতীয় প্রশ্নটা স্পর্শকাতর। এ রকম গণবিস্ফোরণের পরিস্থিতি যে তৈরি হয়ে ছিল, মানুষের বুকে যে এত রাগ ও ঘৃণা জমা ছিল, তা কেন সরকারের কোনো সংস্থাই জানতে পারেনি? তাহলে কি নবারুণ ভট্টাচার্যের ওই কথাটাই সত্যি যে, কখন কোথায় বিস্ফোরণ ঘটবে তা জানতে রাষ্ট্রের বাকি আছে। যদি জানতই, তবে হুঁশিয়ার হয়নি কেন?
এখন দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন এবং ছাত্র-জনতাসহ সকলেই ঝুঁকিতে? ভেতরে-বাইরে বাংলাদেশটাই যদি বিপন্ন, জড়িত সকল পক্ষই যদি নাস্তানাবুদ, তাহলে লাভ হলো কার? হাওয়ার ওপর তাওয়া ভেজে গেল কে?
এত নিখুঁতভাবে বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলো– মেট্রোরেল, এক্সপ্রেস হাইওয়েতে বিধ্বংসী আক্রমণ কারা করল? যে বিএনপি-জামায়াত গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে কিছুই করতে পারেনি, তারা হঠাৎ করে এত সক্ষমতা অর্জন করে ফেলল যে, রাষ্ট্রই তাদের কাছে কাবু হয়ে গেল? যে বিএনপি গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার প্রেস ক্লাবে জমায়েত ও বায়তুল মোকাররমে গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি দিয়েও ৫ মিনিটের বেশি দাঁড়াতেই পারল না, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অভিযোগ মোতাবেক, তারা কী করে সারাদেশে আগুন জ্বালিয়ে ফেলল? নাকি ভিনগ্রহ থেকে এলিয়েনরা সত্যি সত্যিই এসেছিল? কোথাও থেকে যখন পরিষ্কার উত্তর মিলছে না, তখন এলিয়েন কিংবা ভূতে বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় কী?
আন্দোলন হয় প্রকাশ্যে, ষড়যন্ত্র হয় গোপনে। প্রকাশ্য আন্দোলনকে কেন ষড়যন্ত্র বলা হচ্ছিল? তাহলে কি ২০১৮ সালের প্রথম কোটা সংস্কার আন্দোলনও ষড়যন্ত্র ছিল?
কোটা সংস্কার আন্দোলন, তা দমন এবং তাকে ঘিরে ‘নাশকতা’ বিরল কিছু নজির প্রতিষ্ঠা করেছে: ১. এই প্রথম নির্দলীয়, অরাজনৈতিক এবং স্বল্প পরিচিত ছাত্রনেতাদের ডাকে দেশজুড়ে অভূতপূর্ব ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ চলেছে। ২. এই প্রথম বিক্ষোভ দমনে হেলিকপ্টার ব্যবহৃত হয়েছে। ৩. স্বাধীন বাংলাদেশে এর আগে কখনও এমন অচলাবস্থা হয়নি। ৪. বেসামরিক সরকারের নির্দেশে এমন দীর্ঘ কারফিউ আগে কখনও দেখা যায়নি। ৫. রাজনৈতিক দলগুলোর এতটা দিশাহীন চেহারাও আগে দেখা যায়নি।
পাশাপাশি কিছু জ্বলন্ত প্রশ্নের গায়ে হাত দেওয়াই যাচ্ছে না। যেমন, ১. মাত্র তিন-চার দিনে রাজপথে এত বেশি লাশ আগে কখনও পড়েছে? ২. এমন ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউটে বাংলাদেশ আর কখনও পড়েছে? ৩. রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ, সরকারের ভবিষ্যৎ এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে এত অনিশ্চয়তা কি গত চার দশকে দেখা গিয়েছিল? এত বিকল্পহীনতার আশঙ্কাও আগে কখনও দানা বাঁধেনি।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়ানো পাথরকে থামানো যায় না, তা থামে একদম নিচে পাহাড়ের পাদদেশের সমতল মাটিতে। সেই সমতলে গিয়ে কবে যে আমরা দাঁড়াতে পারব, বলতে পারি না।
এই বিষয়ে সবাই একমত হবেন যে, তরুণদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পরে বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের ডামাডোলে প্রাণ ঝরেছিল হাজারো তরুণের। এরশাদশাহির আমলেও রাজপথে অজস্র তরুণের রক্ত ঝরেছে। রক্তের সেই হোলি খেলা এখনও থামেনি। ইতিহাসের যে দেবতা বাংলাদেশের ওপর ছায়া ফেলে রেখেছেন, তিনি মনে হয় রক্ত ছাড়া আর কিছু পান করেন না।
এই দেশ মৃত্যুবাদী দেশ। এই দেশকে যদি জীবনবাদী করতে হয়, তাহলে সবার আগে তরুণ প্রাণের নিশ্চয়তা আনতে হবে, তরুণদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তরুণ সন্তানেরা নিরাপদ মানে তাদের পরিবার নিরাপদ। তরুণেরা চাকরি পেলে পরিবার হেসে ওঠে। তরুণেরা মর্যাদা পেলে দেশের ইজ্জত বাড়ে।
সবাই এখন যার যার পছন্দমাফিক ‘ভিলেইন’ খুঁজছে। যে শত্রু ‘চেনা’ তাকেই কুপোকাত করতে চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে অচেনা এক গতিপথে। এর শেষে কী আছে কেউ জানে না। যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। আমাদের প্রত্যেকেরই এখন নিজ নিজ আমলনামা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করা উচিত, কার কতটা দায় ছিল।
ভেবে দেখা দরকার এত লাশের ভার কে বইতে পারে? বাংলাদেশ বইতে পারবে না। সরকার কি পারবে? পারবে কি পারবে না, তা সামনের দিনে স্পষ্ট হবে। লাশগুলি যদি কথা বলতে পারত? তাহলে হয়তো পুরো সত্যটা জানাজানি হতো। লাশ কথা না বললেও কবর কথা বলে। চুনারুঘাটের রেমা কালেঙ্গা সংরক্ষিত বনের ভেতর টিলার ওপর মুক্তিযুদ্ধের এক শহীদের কবর দেখেছিলাম। সেই গহিন অরণ্যের শহীদটিকেও মানুষ মনে রেখেছে। একসময় ঢাকাসহ বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ২০২৪-এর জুলাইয়ের শহীদদের কবর ঘিরে শহীদ মিনার গড়ে উঠবে। সেই মিনারগুলি কথা বলবে।
একটা কাহিনি বলে শেষ করি। বিশ্বের মধ্যে নামজাদা এক শিল্পী ছিলেন স্পেনের পাবলো পিকাসো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি প্যারিসে আটকা পড়েন। ফ্রান্স তখন জার্মান দখলদারির অধীন; প্যারিসেই স্টুডিও ভাড়া করে দিনরাত ছবি আঁকেন পিকাসো। সেখানেই আঁকা হয় স্পেনের গুয়ের্নিকা শহরে ফ্যাসিস্টদের গণহত্যার প্রতিবাদে আঁকা বিশাল তৈলচিত্রটি। সেই ছবিতে দেখা যায় হত্যা-নির্যাতন ও কান্নার নারকীয় বাস্তবতা। তো, সেই ছবিটা যখন আঁকা চলছে, তখন এক জার্মান সেনা কর্মকর্তা সেখানে পরিদর্শনে আসেন। ঘুরে ঘুরে গুয়ের্নিকার দৃশ্যগুলো দেখছিলেন তিনি। একটা পর্যায়ে পিকাসোকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘কার কাজ এটা?’ পিকাসো বললেন, ‘তোমাদের।’
জার্মান অফিসার আসলে জানতে চেয়েছিলেন ছবিটা কার আঁকা। হেঁয়ালি করে পিকাসো শিল্পীর নাম অর্থাৎ নিজের নাম না বলে জানিয়ে দিলেন গুয়ের্নিকা শহরের ওই বাস্তবের ঘটনার হোতাদের নাম। অফিসার তার পরে চুপ হয়ে গিয়েছিলেন।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক; সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক,
উৎসঃ সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন