Image description

২০০৭ সালে এটিএম আমিন ছিলেন সিটিআইবির পরিচালকের দায়িত্বে। সে সময় ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিন সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা তার ওপরে ব্যাপক মাত্রায় নির্ভর করতেন।

 

জেনারেল (অব.) মইন ইউ আহমেদ সেনাপ্রধান থাকাকালে তার ডানহাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন সামরিক গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) অধীন কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (সিটিআইবি) তৎকালীন পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন ‘কিংস পার্টি’ (রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত দল) গঠনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটাতে ব্যস্ত ছিল, সে সময় তাদের সে প্রয়াসের মূল উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে অন্যতম প্রধান ভূমিকায় ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন। এর অংশ হিসেবে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি (আইডিপি) গঠনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করাতে বলেছিলেন তিনি। যদিও শেষ পর্যন্ত এ দল গঠনের প্রয়াস খুব একটা সফল হয়নি।

পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই পদোন্নতি পেয়ে এটিএম আমিন আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর কিছুদিন তিনি এ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এটিএম আমিন আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালক থাকাকালে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার কয়েক মাস পরই তার অতীতের কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা সরকার তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায়। এর সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপট থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যান এক সময়ের প্রতাপশালী এ সেনা কর্মকর্তা।

২০০৭ সালে এটিএম আমিন ছিলেন সিটিআইবির পরিচালকের দায়িত্বে। সে সময় ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিন সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা তার ওপরে ব্যাপক মাত্রায় নির্ভর করতেন। ওই সময় রাজনীতি থেকে মাইনাস-টু ফর্মুলার অংশ হিসেবে কিংস পার্টি গঠন বা বড় দুই রাজনৈতিক দলের সংস্কারপন্থীদের নির্বাচনে জয়লাভ করানোর জোর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিল এক-এগারোর সরকার। এক্ষেত্রেও অন্যতম প্রধান কুশীলবের ভূমিকায় ছিলেন এটিএম আমিন। আবার দেশে এক সময় ধর্মীয় উগ্রতা ও জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটার পেছনেও তাকেও অনেকাংশে দায়ী মনে করা হয়।

 

এটিএম আমিন ২০০৭ সালের জুনে বিএনপির দুই সংস্কারবাদী নেতা সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসূফ এবং তার ভাই সাবেক সংসদ সদস্য চৌধুরী আকমল ইবনে ইউসূফের সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন। সেখানে বলা হয়, ‘খালেদা জিয়ার বিশ্বস্তরা বয়কট করলেও সংস্কারবাদীদের নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করতে হবে। সংস্কারবাদী এবং তাদের সমমনাদের নির্বাচনের জয় নিশ্চিত করা হবে।’

 

পরে বিএনপির এ দুই সংস্কারবাদীর মধ্যে একজন জানান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিনের এক কাজিনের কাছ থেকে একটি ফোনকল পেয়েছিলেন তিনি। তার কাছে সংস্কারবাদীদের তালিকা ওই ফোনকলে জানতে চাওয়া হয়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অন্য সংস্কারবাদীরাও একই বিষয়ে ডিজিএফআইয়ের কাছ থেকে ফোনকল পেয়েছিলেন।

সে সময় খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির মামলার আইনজীবী ছিলেন মোহাম্মদ নওশাদ জমির। তারেক রহমানের সমর্থনে কোনো কথা প্রকাশ্যে না বলার জন্য ব্রিগেডিয়ার আমিনের পক্ষ থেকে তলব করা হয়েছিল তাকে।

রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সামরিক সচিব ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আমিনুল করীম। এক-এগারোর সরকারের কিংস পার্টি গঠনের প্রয়াসে মেজর জেনারেল এটিএম আমিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বলে বণিক বার্তাকে জানান তিনি। তার ভাষ্যমতে, ‘তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ মেজর জেনারেল আমিনের ওপর নির্ভর করতেন। খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সঙ্গে মইন ইউ আহমেদের যোগাযোগই হতো এটিএম আমিনের মাধ্যমে। শোনা যায়, সে সময় কিংস পার্টি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আমিন। কোরেশী এবং ইব্রাহিম সাহেবকে দিয়ে কিংস পার্টি গঠনের কথা সেনাবাহিনী থাকাকালীন সময়েই শুনেছিলাম। সে সময় ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির (আইডিপি) কথা না শুনলেও পরবর্তী সময়ে এ দলটি গঠনের প্রচেষ্টায় এটিএম আমিনের কথা শুনেছিলাম।’

মেজর জেনারেল এটিএম আমিনের ওপর মইন ইউ আহমেদের নির্ভরশীলতার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমিন ছিল ভীষণ মেধাবী ও সাহসী। যেকোনো কাজ দিলে খুব দ্রুতই তা করে দিত। তার এসব গুণ দিয়ে এক সময় মইন ইউ আহমেদের খুব কাছের মানুষে পরিণত হয়।’

হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি-বি) একাংশকে দিয়ে আইডিপি গঠনে মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিনের প্রয়াস সে সময় কূটনৈতিক তৎপরতার কেন্দ্রেও চলে গিয়েছিল। ২০০৮ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন কয়েক সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক চলাকালে জেমস মরিয়ার্টি জানান, এর আগে ৩০ অক্টোবর ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিচার্ড বাউচারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার একটি বৈঠক হয়। সেখানে শেখ হাসিনা হুজি-বি সংশ্লিষ্টদের দিয়ে আইডিপি গঠনের প্রসঙ্গটি তোলেন। তিনি জানান, এটিএম আমিন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে রাজনৈতিক দল হিসেবে আইডিপির নিবন্ধনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আদায়ের প্রয়াস চালানোর অনুরোধ জানিয়েছেন। যদিও শেখ হাসিনা সেখানে আরো দাবি করেন, তাকে ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যাচেষ্টার কয়েকটি ঘটনার সঙ্গে আইডিপি সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা ছিল। এ কারণে নির্বাচন কমিশন বা মার্কিন সরকারের কাছে আইডিপির বিষয়টি নিয়ে কথা বলার বিষয়ে তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন। একই সঙ্গে শেখ হাসিনা তাকে আটকে রাখা অবস্থায় বিষয়টি নিয়ে দরকষাকষির জন্য ব্ল্যাকমেইল করার জন্য এটিএম আমিনের বিরুদ্ধে উষ্মাও প্রকাশ করেন। হাসিনা সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, বিষয়টি নিয়ে এটিএম আমিন হয়তো নিজ উদ্যোগেই দৌড়ঝাঁপ করছেন এবং হয়তো তা নিজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অগোচরেই করছেন।

আইডিপি গঠন নিয়ে এটিএম আমিনের সঙ্গে এক আলোচনায় হুজি-বির সদস্যদের নিয়ে আইডিপি গঠনের বিষয়টিতে অনুযোগ প্রকাশ করেছিলেন জেমস মরিয়ার্টি। সে সময় শুরুতে এটিএম আমিন হুজি-বির সাবেক সদস্যদের রাজনীতির মূলস্রোতে নিয়ে আসার পক্ষে কিছুক্ষণ বক্তব্য রাখেন। পরে বিষয়টি নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিজ দেশের সরকারের উদ্বেগ জোরগলায় প্রকাশ করলে এটিএম আমিন বলেন, তাদের ওপর সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার কড়া নজর রয়েছে। আবার একই সঙ্গে বিষয়টিতে সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তার কথাও স্বীকার করেন তিনি।

এর আগে ২০০৭ সালের ১৯ জুলাই এক মার্কিন কূটনৈতিককে আমিন বলেছিলেন, ‘হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী বাংলাদেশকে (হুজি-বি) তারাই অনুপ্রবেশ করান। একই সঙ্গে তারা মার্কিন স্বার্থের ওপর আঘাত হানতে পারে বলে মনে হচ্ছে না।’

শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক মাস পর মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন ২০০৯ সালের ১৭ মে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। তখনই দুবাইয়ে চলে যান বলে শোনা যায়। তার অবস্থান বা বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কেউ স্পষ্ট করে বলতে না পারলেও এখনো মধ্যপ্রাচ্যে আছেন বলে কথিত রয়েছে।