চীনই বাংলাদেশকে বড় রকমের সাহায্য করতে পারে
24 September 2014, Wednesday
ইতিহাসের চাকা অতি দ্রুত ঘুরছে। কেউ কি কখনো কল্পনা করতে পেরেছিল ইউক্রেনের অংশ ক্রিমিয়া রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে, কেউ কি কখনো চিন্তা করতে পেরেছিল ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বিরাট একটা অংশের জনগণ ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়ে এখন স্বায়ত্তশাসনের নামে প্রায় স্বাধীনতা অর্জন করতে চলেছে। এই সবই সম্ভব হয়েছে রাশিয়ার রুখে দাঁড়ানোর কারণে। যে রাশিয়া শেষ হয়ে গেছে বলে অনেকে ভাবত, হঠাৎ দেখা গেল সেই রাশিয়াই প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে পশ্চিমের বিরুদ্ধে জয়ী হচ্ছে। নতুন করে জানান দেওয়া ক্ষমতাধর রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মতো সাহস যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপের ন্যাটো সামরিক জোটের নেই। তবে ন্যাটো সামরিক জোট আজও যুদ্ধের খোঁজে ব্যস্ত। তারাই বোমা মেরে লিবিয়ার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। তারাই মিথ্যা গল্প ফেঁদে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। তারাই সোমালিয়ায় আজও প্রঙ্ িযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইরাকে আইএস দমনের নামে তারা আবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে যুদ্ধে হেরে চলে যেতে চেয়েও যেন যেতে চাচ্ছে না। সন্ত্রাস দমনে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ একত্র হয়েছে। সেই সন্ত্রাসের সৃষ্টি করেছে আবার তারা নিজেরাই। লিবিয়া-ইরাক-আফগানিস্তানে যে কথিত সন্ত্রাসের সাম্রাজ্য তৈরি হতে চলেছে, তার সৃষ্টি হলো কিভাবে? আধুনিক ইরাককে বুশ গং ধ্বংস না করলে কি সেখানে তাদের ভাষায় অতি ভয়ংকর আইএসের উত্থান হতো? কারা শিয়া-সুনি্ন বিরোধকে উসকে দিচ্ছে? মানুষ এই সবই জানে এবং বোঝে। সে জন্য আজকে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা কিছু বললে বিশ্ব উল্টো বোঝে। বিশ্ব এও বোঝে যে ন্যাটো জোটের যুদ্ধক্ষেত্র দরকার। তাই তারা বিশ্বব্যাপী সফট টার্গেট খুঁজে বেড়ায়। দুর্বল মুসলিম জনপদগুলো আপাতত সে সফট টার্গেট। যাক, বিশ্বজোট যুদ্ধের মাধ্যমে যেমন গত বছরের মোড়গুলো একের পর এক অতিক্রম করেছে, অন্যদিকে অর্থনীতির ক্ষেত্রেও বিশ্ব এক বিরাট পরিবর্তন লক্ষ করেছে। অর্থনীতির কেন্দ্র এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপে কেন্দ্রীভূত নয়, অন্যত্র কেন্দ্রগুলো ছড়িয়ে পড়ছে। আগের সুপ্ত কেন্দ্রগুলো গা-ঝাড়া দিয়ে ওপরে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। কেউ কি আশির দশকে কিংবা পরের দশকেও চিন্তা করতে পেরেছিল মাও-পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে চীনের অর্থনীতির আকার যুক্তরাষ্ট্রের
চীনই বাংলাদেশকে বড় রকমের সাহায্য করতে পারে
অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে? অনেক পণ্ডিত এখন থেকে এক দশক আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ২০২১ নাগাদ চীনের অর্থনীতি হবে বিশ্বে এক নম্বরের অর্থনীতি। কিন্তু চীনকে এক নম্বর হওয়ার জন্য ২০২১ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি, ২০১৫ সালের মধ্যেই চীনের অর্থনীতি এক নম্বর হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছে এর মধ্যেই চীনের অর্থনীতি এক নম্বর হয়ে গেছে। এক নম্বর হোক বা দুই নম্বরের হোক, চীন বিশ্বব্যাপী একটা সাড়া ফেলে দিয়েছে। চীনের প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্ট যেখানেই যান না কেন বিলিয়নস অব ডলারের বাণিজ্যের ও বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন। চীন ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দেয় না। বাস্তবেও করে দেখায়। গত দুই দশকে চীন আফ্রিকা মহাদেশে কয়েক শ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
আজকে যে আফ্রিকার প্রবৃদ্ধির হার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্ব গড়ের অনেক ওপরে তার মূলে রয়েছে চীনা বিনিয়োগ। চীন হলো আফ্রিকার খনিজসম্পদের ভালো ক্রেতা। কিন্তু চীন বলে দিয়েছে তারা শুধু আফ্রিকার সম্পদ কিনবে না, তারা আফ্রিকার অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে বড় রকমের অবদান রাখবে। চীনারা আফ্রিকায় বিনিয়োগ ও বাণিজ্য নিয়ে প্রবেশ করার আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ আফ্রিকার খনিজসম্পদের একমাত্র ক্রেতা ছিল। কিন্তু সত্য হলো, যত দিন এই শক্তিগুলো আফ্রিকান সম্পদের ক্রেতা ছিল, তত দিন আফ্রিকা অর্থনৈতিকভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। আর আজ চীনের সঙ্গে আফ্রিকার বাণিজ্য হলো সর্ববৃহৎ। চীনের প্রেসিডেন্ট প্রতিবছর আফ্রিকার সরকারপ্রধানদের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করেন, প্রতিশ্রুতি দেন আরো অনেক অনেক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সুবিধার। চীনের এই কৌশল দেখে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত তারা দৌড়ে অবতীর্ণ হয়েছে আফ্রিকাকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে। তবে আফ্রিকানদের বিশ্বাস হলো চীনাদের প্রতি। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন চুক্তি এবং প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের অনুকূলে চলে যায়। যুদ্ধে বিজয়ী দেশগুলো বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্থপতি হলো এবং পরে তারা তদারকি সংস্থা আইএমএফ (IMF) গঠন করল। সেই আইএমএফের ভোটিং পদ্ধতি এমনভাবে গ্রহণ করা হলো যে কোনো সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের একার 'না' ভোটই যথেষ্ট। অথচ বিশ্বকে সেই আইএমএফের মাধ্যমে মার্কিন ডলারকে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য করা হলো। আইএমএফ যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তদারক করছে, সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে। আজকে চীন-ভারত-ব্রাজিল-রাশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা উদীয়মান বৃহৎ অর্থনৈতিক স্থান দখল করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তারা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোতে বড় হয়েও সেই পুরনো আইএমএফের খবরদারি ব্যবস্থার মধ্য থেকে কাজ করতে হচ্ছে, যে ব্যবস্থা পরিবর্তন করার জন্য এই দেশগুলোর কোনো ক্ষমতা নেই। শেষ পর্যন্ত চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে উদীয়মান পাঁচটি বৃহৎ অর্থনীতি একত্র হয়ে এই বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশ তদারকি সংস্থাBRICS ব্যাংক গঠন করার পক্ষে পদক্ষেপ নেয়। BRICS (Brazil, Russia, India, China, South Africa) ব্যাংক প্রকৃত অর্থে কেমন রূপ ধারণ করবে, তার ওপর নির্ভর করবে বিশ্বের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোতে এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক লেনদেনে কোনো রকমের বড় পরিবর্তন আসছে কি না সেই ব্যাপারগুলো। তবে পাঁচ উদীয়মান বৃহৎ অর্থনীতির সেই উদ্যোগ সম্পূর্ণ সফল হোক বা না হোক, বিশ্ব কিন্তু অর্থনৈতিক লেনদেনে অতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে চীন তার মুদ্রাকে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে অনেক দেশকে গ্রহণ করাতে সক্ষম হয়েছে। সামনে মার্কিন ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্য আর থাকবে না, এ ব্যাপারে সবাই এখন নিশ্চিত।
চীন নিজ উদ্যোগে এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে আরেকটি উন্নয়ন ব্যাংক স্থাপন করতে যাচ্ছে, যে ব্যাংক হবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (ADB) সমান্তরাল বা বিকল্প। উল্লেখ্য যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র জাপান। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ওপর পলিসিগত প্রভাব বিস্তার করতে চীনও অক্ষম। অন্য দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয় হলো চীন তার পুরনো শত্রুতাকে পেছনে ফেলে সামনে এগোতে চাচ্ছে। মাত্র কয়েক বছর আগেও কি আমরা কল্পনা করতে পেরেছিলাম যে ভারত হবে চীনের এক নম্বরের বাণিজ্য অংশীদার! আমরা কি এও ভাবতে পেরেছিলাম যে চীনের প্রেসিডেন্ট এসে নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে বলবেন চীন ভারতকে বড় রকমের সাহায্য করতে প্রস্তুত। সই করলেন ২০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য চুক্তি। এখন ভারত মহাখুশি। মোদির অনুরোধে চীন বিতর্কিত সীমান্ত এলাকা থেকে সেনা সরাতেও রাজি হয়েছে। ছোট্ট শ্রীলঙ্কা আজকে চীনা সহায়তা পেয়ে ধন্য। তাদের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে অর্থায়ন করছে চীন। তাদের রাস্তা নির্মাণ, অন্য অবকাঠামো নির্মাণে চীন এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশকেও চীন অনেক কিছু দিতে চাচ্ছে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এর অন্যতম। আমরা মনে করি চীনের প্রস্তাবগুলো বাংলাদেশ সরকারের অতি দ্রুত বিবেচনা করা উচিত। চীনের সামর্থ্য আছে, চীনের ইচ্ছা আছে। সুতরাং চীন হতে পারে আমাদের ক্ষেত্রে দুই হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অংশীদার।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন