নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপর চারজন নির্বাচন কমিশনার সমন্বয়ে এ কমিশন গঠিত। কমিশনারগণ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্যতীত ক’জন নির্বাচন কমিশনার সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে সে বিষয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্ববর্তী কোনো সুস্পষ্ট ধারণা দেয়া ছিল না। তবে অতীতে দেখা গেছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্যতীত সর্বোচ্চ চারজন ও সর্বনিম্ন একজন নির্বাচন কমিশনার সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সংস্থা এবং নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার বিষয়ে সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কেবল এ সংবিধান ও আইনের অধীন হবে।
নির্বাচন কমিশন কী ধরনের দায়িত্ব পালন করবে সে বিষয়ে সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদের (১) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধায়ন, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং নির্বাচন কমিশন এ সংবিধান ও আইনানুযায়ী
(ক) রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন;
(খ) সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন;
(গ) সংসদের নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করবেন এবং
(ঘ) রাষ্ট্রপতি পদের এবং সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার-তালিকা প্রস্তুত করবেন।
উপরে বর্ণিত অনুচ্ছেদের (২) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, উপরিউক্ত দফাসমূহ নির্ধারিত দায়িত্বসমূহের অতিরিক্ত যে রূপ দায়িত্ব এ সংবিধান বা অন্য কোনো আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে, নির্বাচন কমিশন সে রূপ দায়িত্বও পালন করবেন।
নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ বিষয়ে সংবিধানে বলা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হতে পারেন, সেরূপ পদ্ধতি ও কারণ ব্যতীত কোনো নির্বাচন কমিশনারকে অপসারণ করা যাবে না।
উল্লেখ্য যে, সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারককে অপসারণ করতে হলে প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের পরবর্তী দু’জন কর্মে প্রবীণ বিচারক সমন্বয়ে একটি কাউন্সিল গঠন করা হয় এবং ওই কাউন্সিল একজন বিচারকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যরে অথবা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ তদন্ত করত রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরিত প্রতিবেদনে তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত উল্লিখিত হলে রাষ্ট্রপতি অভিযুক্ত বিচারককে অপসারণের নির্দেশ দিয়ে থাকেন। নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ পদ্ধতি সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অনুরূপ হওয়ার কারণে একজন নির্বাচন কমিশনারের স্বাধীনভাবে কাজ করার বিষয়ে এটি অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর এ যাবৎকাল অনুষ্ঠিত সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বেতার ও টেলিভিশন ভাষণের মাধ্যমে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে দেশবাসীকে অবহিত করেছেন। এ তারিখ ঘোষণার বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনের সাথে সরকারের কোনো আলোচনা হয়ে থাকলেও তা প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পূর্ববর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার অপর দু’জন কমিশনার সমন্বয়ে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণের বিষয়ে একাধিকবার তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে গিয়ে বৈঠক করেছেন এবং তা দেশবাসী বিভিন্ন টেলিভিশন, বেতার ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে পরিবেশিত খবর দ্বারা জানতে পেরেছেন।
সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণের বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপর নির্বাচন কমিশনার সমন্বয়ে রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সাথে নির্বাচন কমিশনের প্রকাশ্য বৈঠক নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান প্রদত্ত স্বাধীনতার পরিপন্থী।
অতীতে নবম সংসদ নির্বাচন-পূর্ববর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপর দু’জন নির্বাচন কমিশনার সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ বিষয়ে রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সাথে প্রকাশ্য বৈঠকে মিলিত হয়ে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করেছেন।
সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নির্বাচন কমিশনের অন্যতম সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং এ দায়িত্বটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার অপর নির্বাচন কমিশনারদের সাথে আলোচনা না করে এককভাবে পালন করতে পারেন না। আসন্ন সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণের বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অদ্যাবধি এমন কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি।
সংসদ ভেঙে যাওয়া ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদের কোনো সদস্য পদ শূন্য হলে পদটি শূন্য হওয়ার নব্বই দিনের মধ্যে ওই শূন্য পদ পূর্ণ করার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান রয়েছে এবং এ ক্ষেত্রেও তারিখ নির্ধারণে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের একক কোনো ক্ষমতা নেই। যদিও কোনো দৈব-দুর্বিপাকের কারণে উপরোক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে সম্ভব না হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এককভাবে ওই মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ প্রদান করতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রেও অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এককভাবে সিদ্ধান্ত নেননি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে অতীতে সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত উভয় ধরনের ব্যক্তিবর্গের আগমন ঘটেছিল। সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার পদে আসীন হতে পারেন কি না এ বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এ বিতর্কের অবসান হয়নি। এ বিষয়ে পরবর্তী কোনো এক সংখ্যায় লিখব এ আশায় আপাতত নিবৃত থাকলাম।
বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার সরকারের একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব অপর দিকে চারজন নির্বাচন কমিশনারের মধ্যে একজন অধস্তন বিচার বিভাগের জেলা জজ পদমর্যাদার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, অপর তিনজনের দু’জন প্রশাসন ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা এবং অপরজন সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার কর্মকর্তা।
নির্বাচন কমিশনের অতীত ইতিহাস থেকে দেখা যায় অধিকাংশ প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার নিষ্কলুষভাবে নির্বাচন কমিশন থেকে বিদায় নিতে পারেননি। বর্তমান কমিশনের ক্ষেত্রে কী হবে তা অনাগত ভবিষ্যৎ বলতে পারে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত এবং একটি নির্বাচনকে অর্থবহ করতে হলে যেরূপ ক্ষমতা প্রয়োজন আমাদের সংবিধান সেরূপ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে প্রদান করেছে। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক যথার্থভাবে এ ক্ষমতার প্রয়োগের ওপরই নির্বাচন কমিশনের সার্থকতা নির্ভর করে।
নির্বাচন কমিশনকে তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব যথার্থভাবে পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীর প্রয়োজন হবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করবেন এ কথাগুলো সংবিধানের সপ্তম ভাগের ১২০ অনুচ্ছেদে স্পষ্টত উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া একই ভাগের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হবে।
সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা ছাড়াও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৯১ ধারায় নির্বাচন কমিশনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা বিষয়ে কিছু সহজাত ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। ওই সহজাত ক্ষমতা সঠিকভাবে প্রয়োগ করে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন কমিশন একজন প্রার্থীর নির্বাচনসংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ বন্ধ রাখতে পারেন। উল্লেখ্য যে, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে একজন প্রার্থীকে একটি নির্বাচনী এলাকার বিপরীতে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত হওয়ায় নির্বাচিত প্রার্থী ঘোষণা করা হয় এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক এরূপ ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত একজন নির্বাচিত প্রার্থী সংসদ সদস্য হিসেবে বিবেচিত হন না। সম্প্রতি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এ সংশোধনী আনার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে একটি নির্বাচনী এলাকার নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন নিজের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ন রেখে যদি এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাহলে একটি নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা প্রয়োগ প্রশ্নবিদ্ধ হবে না। কিন্তু নির্বাচন কমিশন যদি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার মতো ফলাফল ঘোষণার সময় কোনোরূপ শৈথিল্য বা অস্বচ্ছতা প্রদর্শন করে তবে তা দেশবাসীকে হতাশ করবে।
আমরা আশা করব আসন্ন চতুর্দশ সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার বিষয়ে নির্বাচন কমিশন তার সাংবিধানিক ক্ষমতা যথাযথভাবে প্রয়োগ করে দেশবাসীর আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে। অনুরূপ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার বিষয়েও যদি নির্বাচন কমিশন তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সক্ষম হয় তাতে নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা এবং সার্বিকভাবে দেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা সুসংহত হবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক