
মিনার রশিদ
আপনাদের হয়তো স্মরণে আছে যে ডাক্তার শামরুখ মাহজাবিনের অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে ২০১৪ সালের নভেম্বরে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। এই অভাগা মেয়েটি ছিলেন আওয়ামী লীগের জনৈক সংসদ সদস্যের পুত্রবধূ। বলা হয়েছিল, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু সারকামসটেন্সিয়াল এভিডেন্স দেখে ভিকটিমের বাবা-মাসহ সারা দেশবাসীর সন্দেহÑএটি একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ছিল । ঘটনা নিয়ে মামলা হলেও এ নিয়ে আদালত বা পুলিশের চূড়ান্ত রিপোর্টে স্পষ্ট তদন্ত ও ফলাফল প্রকাশ পায়নি ।
একই ধরনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও আরেক বিতর্কিত এমপি নিক্সনের স্ত্রীর। মাহজাবিনের বাবা সাহস করে মামলা করলেও নিক্সনের সেই শ্বশুরগোষ্ঠী সাহসই করেনি। শেখ হাসিনার বেয়াইন এবং পুতুলের শাশুড়িও শেখ হাসিনার প্রথম টার্মে আত্মহত্যা করেছিলেন বলে প্রচার করা হয়। এসব নিয়েও খুব খোঁচাখুঁচি করা হয়নি।
মাহজাবিনের অসহায় বাবা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। বিশ্বসেরা এই অভিনেত্রী দরদমিশ্রিত ধমক দিয়ে মাহজাবিনের বাবাকে বলেছিলেন, ‘বাবা হয়ে মেয়েকে এমন একটা কুৎসিত, জঘন্য পরিবারে বিয়ে দিলেন কীভাবে?’
অথচ ভুক্তভোগী বাবার প্রশ্ন করার সাহস ছিল না—‘আগে বলুন, আপনি কীভাবে সেই জঘন্য পরিবারের ঘরের লোককে এমপি বানালেন? এটি একটি বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হতে পারত যে প্রশ্নটি কেউ করেনি। দস্যুরানির জমানায় সেই সাহস কারো ছিল না।
শেখ মুজিব যখন তার মেয়েকে বিয়ে দেন, তখন সম্ভাব্য তরুণ নেতাদের কেউ কেউ পাণিপ্রার্থী ছিলেন। কিন্তু নেতা নিজের মেয়েকে সেই রাজনৈতিক নেতাদের হাতে তুলে দিতে রাজি হলেন না। বিয়ে দিলেন ইউনিভার্সিটির এক সেরা ছাত্রের হাতে। এটাই আমাদের রাজনীতির ট্র্যাজেডি। যাদের মন্ত্রী-এমপি বানাই, তাদের কাছে নিজের আদরের মেয়েকে সোপর্দ করতে সাহস করি না। আবার যাদের হাতে নিজের মেয়েকে তুলে দিই, তাদের এমপি-মন্ত্রী হিসেবে যথাযথ জ্ঞান করি না।
পশ্চিমা বিশ্ব ভালো নেতা পায় আর আমরা কেন তা পাই নাÑসেটাও অনেকের জিজ্ঞাসা।
যেকোনো সমাজে ওপরতলার মানুষগুলোই সমাজকে নেতৃত্ব দেয়। আমাদের সাধারণ মানুষ নীতিনৈতিকতা কিছুটা আঁকড়ে থাকলেও ওপরতলার মানুষের অধিকাংশই নীতিনৈতিকতা-বিবর্জিত ও ভোগসর্বস্ব প্রাণীর মতো। পশ্চিমা বিশ্বে বিষয়টি পুরো উল্টো। উন্নতবিশ্বের এলিট শ্রেণিতে পারিবারিক ও নৈতিক শৃঙ্খলা ওয়ার্কিং ক্লাসের চেয়ে বেশি। এটাকে বলে এরা পারিবারিক মূল্যবোধ, যা আসে মূলত ধর্মবোধ থেকেই।
আমরা অনেক সময়েই পশ্চিমা সমাজকে নিজেদের আদর্শ রূপে বিবেচনা করি। তাদের রাজনৈতিক দর্শন, সামাজিক রীতিনীতি, এমনকি তাদের জীবনযাপন ও সংস্কৃতিকেও আমরা অনায়াসে অনুসরণ করি। পশ্চিমে কোনো ধারণা বা লাইফস্টাইল জনপ্রিয় বা গ্রহণযোগ্য হলে আমরা প্রায় নিশ্চিত ধরে নিই সেটাই ‘সঠিক’ এবং আমাদের সমাজেও তা অন্ধভাবে গ্রহণ করার প্রবণতা রয়েছে।
পশ্চিমাদের নিয়ে বড় ট্রাবলটি হলো, ওরা নিজেদের জন্য যেটা পছন্দ করে, তা অন্যদের বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের জন্য পছন্দ করে না। ওরা নিজেদের জন্য গণতন্ত্র পছন্দ করে কিন্তু মুসলিম বিশ্ব গণতান্ত্রিক হোক সেটা ওরা চায় না। নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষাকে চার্চের হাতে তুলে দিলেও একই জিনিস মুসলিম বিশ্বে পছন্দ করে না।
ফলে আমরা নিজেদের মেয়েদের জন্য যোগ্য পাত্র বাছাই করতে পারলেও, নেতাদের নিজেদের পছন্দমতো বাছাই করতে পারি না।
আমাদের ইন্টেলেকচুয়ালদের অনেকেই শক খাবেন যদি একটু অনুসন্ধান করে দেখেন যে পশ্চিমা সমাজে প্রাথমিক শিক্ষায় চার্চের প্রভাব কতটুকু!
পশ্চিমা দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় চার্চের ভূমিকা
নৈতিকতা ও ঐশ্বরিক জবাবদিহির বোধ সৃষ্টি চার্চের বা ধর্মের প্রধান কাজ। পশ্চিমা দেশগুলোয় এই বোধ গঠনের প্রাথমিক পর্যায়টি শুরু হয় ছোটবেলা থেকেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তাদের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত্তি ছিল এবং আজও অনেকাংশে আছে চার্চ বা ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার হাতে। এর মাধ্যমে শিশুমনে একটি ঊর্ধ্বতন সত্তা (ঈশ্বর) ও চূড়ান্ত জবাবদিহির ধারণা দৃঢ়ভাবে গেঁথে দেওয়া হয়। এই ধারা শুধু প্রাচীন বা মধ্যযুগেই নয়, বরং আধুনিক সমাজে এখনো কার্যকর রয়েছে।
ইতিহাসে চার্চভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা
পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষা-ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মধ্যযুগীয় ইউরোপে শিক্ষার একমাত্র কেন্দ্র ছিল গির্জা বা চার্চ। যাজক বা ধর্মীয় নেতারা তখন শিক্ষাদান করতেন এবং ধর্মগ্রন্থ (বাইবেল)-ভিত্তিক পাঠ্যসূচি অনুসরণ করতেন। এই প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল শুধু সাক্ষরতা নয়; বরং শিশুকে একজন নৈতিক, সৎ এবং ঈশ্বরভীরু নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।
উদাহরণ
চার্চ অব ইংল্যান্ড ১৮১১ সালে ‘National Society for Promoting Religious Education’ প্রতিষ্ঠা করে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল—সব শিশুকে খ্রিষ্টীয় নৈতিকতা ও ঈশ্বরে বিশ্বাসভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা।
স্কটল্যান্ড : The Education Act of 1696 অনুযায়ী, প্রতিটি প্যারিসে (স্থানীয় গির্জা এলাকাভিত্তিক অঞ্চল) বাধ্যতামূলকভাবে বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়, যেগুলো পরিচালিত হতো Kirk (Presbyterian Church) দ্বারা। এই বিদ্যালয়গুলোয় ঈশ্বরের সামনে সব কাজের জবাবদিহি—এই বিশ্বাস প্রতিটি শিশুর মধ্যে প্রবিষ্ট করা হতো।
চার্চভিত্তিক বিদ্যালয়গুলোর মূল শিক্ষা ছিল নৈতিকতা গঠনের ওপর। শিশুদের শেখানো হতো
‘God is watching you.’ (ঈশ্বর সবকিছু দেখছেন)
‘You are accountable for your actions.’ (তোমার প্রতিটি কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে)
‘Honesty, humility, compassion, forgiveness are divine virtues.’ (সততা, বিনয়, সহমর্মিতা ও ক্ষমাশীলতা হলো ঈশ্বরীয় গুণ)
এই শিক্ষার ফলে শিশুমনে একটি নৈতিক অভ্যন্তরীণ রাডার গড়ে ওঠে—যা তাকে সৎ, দায়িত্ববান ও ন্যায়পরায়ণ হতে শেখায়।
আধুনিক বাস্তবতা : Faith-Based Schools এখনো প্রচলিত
আজকের দিনে এসেও পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশে হাজার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, যেগুলো চার্চ দ্বারা স্পন্সরকৃত বা পরিচালিত :
যুক্তরাজ্য : প্রায় ৪,৭০০টি Church of England স্কুল বর্তমানে সক্রিয় (সূত্র : Church of England Education Office)। এগুলোর কারিকুলামে বাইবেল ও খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধের পাশাপাশি আধুনিক পাঠ্যসূচিও থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র : National Catholic Educational Association (NCEA) অনুসারে, ৫,০০০+ ক্যাথলিক প্রাথমিক বিদ্যালয় বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে, যেগুলোয় এখনো ধর্মীয় নৈতিকতা ও ঈশ্বরের সামনে জবাবদিহির শিক্ষা দেওয়া হয়।
অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা : এই দেশগুলোতেও Catholic ও Anglican শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিশুদের মধ্যে God-centered morality ও responsibility শেখাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
একাডেমিক গবেষণা ও বিশ্লেষণ : Kay & Francis (2001) এক গবেষণায় বলেন, ‘Students from faith-based schools exhibit higher levels of social responsibility and moral judgement.’ Jean Piaget এবং Lawrence Kohlberg-এর নৈতিক বিকাশ তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রাথমিক বয়সে যদি কোনো শিশু ‘authority-based moral system’-এর মধ্যে বেড়ে ওঠে, তবে তার নৈতিকতার ভিত্তি দৃঢ় হয়।
আমরা নিজেরাও জানি না, আমাদের কাছে কী মনি-মাণিক্য গচ্ছিত আছে। অদ্ভুত কারণে সমাজের বিরাট অংশ সেই সিন্দুকটিতে হাত দিতেই ভয় পাই। একজন অবশ্য ধর্মের গোড়া কেটে আগায় পানি দিয়ে গেছেন। কখনো মদিনার সনদ অনুযায়ী দেশ শাসনের কথা বলেছেন অথচ সেরা জালেম হিসেবে ইতিহাসে নিজের নামটি খোদাই করে গেছেন। মোনাফেকিন আর জ্ঞান একসঙ্গে থাকতে পারে না। কাজেই দেশের মানুষকে ঠকাতে গিয়ে নিজেই ঠকেছেন, সেটি ধরতে পারেননি।
আসুন, দেশটিকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসি এবং নিজের মেয়েকে যে রকম চরিত্রবান পাত্রের হাতে তুলে দিতে চাই, নিজের দেশটিকে তেমনই চরিত্রবান পাত্রদের হাতে তুলে দিই। এসব নেতানেত্রী বা পাত্রপাত্রী বাছাইয়ে যেন নিচের চারটি বিষয় বিবেচনায় রাখি।
১. নৈতিক ও ধর্মীয় দায়বদ্ধতা (Spiritual and Moral Accountability)
‘আল্লাহ আমাকে দেখছেন’ এ রকম একটা জবাবদিহির অনুভূতি যে কাউকে (দাড়িওয়ালা বা দাড়িবিহীন) এই দুনিয়াতেও একজন উৎকৃষ্ট মানুষ, উৎকৃষ্ট স্বামী এবং উৎকৃষ্ট নেতা বানাতে পারে। এ জন্য বড় মাওলানা, মুফতি হওয়ার প্রয়োজন নেই, একজন সাধারণ মানুষও এই বোধটি আয়ত্ত করতে পারে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিজেই এর একটি বড় নমুনা।
‘আল্লাহ আমাকে সর্বক্ষণ দেখছেন’ এই বিশ্বাসটি মানিট্র্যাপ ও হানিট্র্যাপসহ এই কিসিমের সব বালামুসিবত থেকে রক্ষা করতে পারে। আদর্শ স্বামী ও আদর্শ নেতা হতে এর বিকল্প দেখছি না। নিজের বিবাহিত/বিবাহিতা সঙ্গী/সঙ্গিনীর সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে বা শুনতে যতটুকু মধুর লাগে, পরকীয়ার সঙ্গে শুনতে বা গাইতে এর চেয়ে কম মধুর লাগে না। ‘পরকীয়া বা হানিট্র্যাপ পাপের কাজ, তোমরা এর নিকটেও যেও না’Ñএকমাত্র ধর্ম ছাড়া অন্য কোথাও এটা লেখা নেই।
২. আর্থিক ও ব্যক্তিগত সততা (Financial Integrity and Personal Honesty)
অর্থনৈতিক জীবনে এবং ব্যক্তিগত জীবনে সৎ ও বিশ্বস্ত হতে হবে, এ ব্যাপারে ক্লিন চরিত্রের রেকর্ড থাকতে হবে। ‘পরিচ্ছন্ন রেকর্ড’ ছাড়া কাউকে জাতীয় দায়িত্বে বসানো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
৩. মানসিক ভারসাম্য ও জ্ঞানের পরিপক্বতা (Psychological Maturity & Intellectual Depth)
নেতৃত্বে থাকা মানুষকে সুশিক্ষিত, হিতাহিত জ্ঞানসম্পন্ন, মার্জিত আচরণে অভ্যস্ত এবং মানসিকভাবে স্থিতিশীল হতে হবে। আবেগপ্রবণ, প্রতিশোধপরায়ণ বা চাটুকারপ্রবণ নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত দল ও জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বড় বড় নেতার কথায় এখন দল বিব্রত হচ্ছে। মাঝেমধ্যে সাইকোলজিক্যাল চেক জরুরি।
৪. পরিবার ও নিকটজনের চরিত্র ও জীবনযাপন (Lifestyle Audit of Inner Circle)
নেতৃত্বের স্বচ্ছতা বা তার প্রভাব শুধু একজন ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, পরিবার-ঘনিষ্ঠ অন্যরাও এখানে জড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে নেতানেত্রীর স্পাউজ বা সন্তান-সন্ততির লাইফস্টাইল বা নৈতিক মান চেক করা দরকার। তাই নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ‘Know Your Candidate’-এর পাশাপাশি ‘Know His/Her Surroundings’ চালু করা প্রয়োজন।
কোনোরূপ স্বজনপ্রীতি বা অন্য কোনো প্রীতি থেকে বেরিয়ে ওপরের চারটি ক্রাইটেরিয়া বিবেচনা করলে জাতির ভাগ্যটি বদলে যেতে পারে।
লেখক : কলামিস্ট