
প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস চার দিনের সরকারি সফরে এখন লন্ডনে রয়েছেন। সফরকালে ১২ জুন বৃহস্পতিবার বিকালে তিনি বাকিংহাম প্যালেসে রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে দেখা করবেন। এ সময় তিনি রাজা চার্লসের হাত থেকে সম্মানজনক ‘কিং চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করবেন। গরিবের ব্যাংকার হিসেবে পরিচিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সারা জীবনের কীর্তি বিবেচনায় তাকে এই পুরস্কারে সম্মানিত করা হচ্ছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গেও প্রধান উপদেষ্টার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের কর্মসূচি রয়েছে। পাশাপাশি তিনি যুক্তরাজ্যের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউস আয়োজিত এক সংলাপে অংশ নেবেন।
বাংলাদেশের রাজনীতির এখন সবচেয়ে আগ্রহের বিষয় লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১৩ জুন স্থানীয় সময় সকালে হোটেলে এসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। ড. ইউনূসের সঙ্গে তার এই সাক্ষাৎ কেমন হবে, এটা নিয়েই বাংলাদেশে এখন বেশি কৌতূহল। তবে লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি শেখ রেহানা-কন্যা টিউলিপ সিদ্দিকের দেখা হবে না বলে জানা গেছে। টিউলিপের দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চলমান থাকার কারণে এ সাক্ষাৎ সম্ভব নয় বলে জানা গেছে। এই সফরে ড. ইউনূসের সঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মোমিন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরও রয়েছেন।
লন্ডন সফরে যাওয়ার আগে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঈদুল আজহার আগের দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। ভাষণে তিনি রাজনৈতিক দল ও মানুষের এ মুহূর্তের সবচেয়ে আগ্রহের বিষয় নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আগামী বছরের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত সময়ে নির্বাচনের দিন-তারিখসহ রোডম্যাপ দেবে। আগামী ঈদুল ফিতরের আগে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে গ্রহণযোগ্য জায়গায় সবাই আমরা পৌঁছতে পারব।’
বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করে আসছিল। ফলে এপ্রিলে নির্বাচন ঘোষণায় বিএনপি তাৎক্ষণিক খুশি হতে পারেনি। তারা সংবাদমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় তারা হতাশ এবং এতে জাতির ইচ্ছার প্রতিফলন হয়নি। তবে বিএনপি নির্বাচনের ঘোষিত তারিখ প্রত্যাখ্যান করেনি। অবশ্য এনসিপি, জামায়াতসহ অন্যান্য দল এপ্রিলে নির্বাচনের ব্যাপারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
অনেকের মতে, বিএনপির প্রত্যাশা অনুযায়ী ডিসেম্বর না হলেও ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের সময় ঘোষিত হলে সব রাজনৈতিক দলই খুশি হতো। বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইলেও তারা আশা করেছিল হয়তো সরকার জানুয়ারিতে নির্বাচন দেবে। এর আগে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এবং ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হয়েছে। ওই নির্বাচনগুলো ইতিহাসের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও সুন্দর নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে যে সংসদ গঠিত হয়, সেই সংসদ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল সংসদ হিসেবে মানুষের মনে এখনো জ্বলজ্বল করছে। অন্যদিকে ডিসেম্বরে যে নির্বাচন হয়েছে, তা আওয়ামী লীগের পক্ষেই গেছে। যাই হোক, নির্বাচনের সময় ঘোষিত হয়েছে এবং সময়টি সম্পর্কে বিএনপি ও অন্যান্য দলের অভিযোগের সব ব্যাখ্যা দিয়েছে ড. ইউনূসের সরকার। ঝড়বৃষ্টি, গরম, পাবলিক পরীক্ষা, আবহাওয়া সবকিছুর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও তথ্য সরকারের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়েছে। তবুও নির্বাচনের তারিখ নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি রয়ে গেছে।
এরই মধ্যে লন্ডনে গেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘ ১৭ বছর লন্ডনে নির্বাসনে রয়েছেন। এ সময়ে তিনি দেশে আসতে পারেননি। তার ওপর জুলুম হয়েছে। জুলুমবাজ সরকারের পতন হয়েছে। ওই সরকারের দোষীরা এখন বিচারের সম্মুখীন। তাদের বিচারের কাঠগড়ায় তুলবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জানা গেছে, লন্ডনে তাই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার বিষয়টি দায়িত্ববোধ থেকেই জরুরি এবং রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ বলে মনে করছেন তারেক রহমান। সারা দেশের মানুষ তারেক রহমানের এই সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছেন। ১৩ জুন লন্ডন সময় সকালবেলা ড. ইউনূসের হোটেলে এসে সাক্ষাৎ করবেন তারেক রহমান। তারেক রহমানের বাবা-মা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ড. ইউনূসের সুসম্পর্ক ছিল। ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হওয়ায় খালেদা জিয়া খুশি হন। গত সশস্ত্র বাহিনী দিবসে তিনি সেনানিবাসের অনুষ্ঠানে গেলে ড. ইউনূস তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ভাষণে ড. ইউনূস খালেদা জিয়া সম্পর্কে প্রশংসামূলক বক্তব্য দেন। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে উত্তরাঞ্চলে দুই দিনের এক সফরে গিয়েছিলেন। সেই সফরে তিনি তার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন কুমিল্লা বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান ও অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। ড. ইউনূস তখনো গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেননি। তবে গ্রামীণ জনগণ ও গরিব মানুষের জন্য ড. ইউনূস কাজ করছেন, এ খবর জানতেন রাষ্ট্রপতি জিয়া। তাই তিনি তাকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল সফরে নেন। সেখানে গরিব কৃষক ও খেটে খাওয়া মানুষের সামনে ড. ইউনূসকে দিয়ে বক্তৃতা করিয়েছিলেন। কীভাবে জীবনকে বদলে দেওয়া যায়, কৃষির উন্নতি করা যায় এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়—সেই কথাগুলো অনুষ্ঠানে তুলে ধরেছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়া ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস। (সূত্র : ডিএফপি থেকে প্রকাশিত রাষ্ট্রপতি জিয়ার ভাষণ)
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আমরা সেদিনের কথা ভুলিনি। সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছিল—তার নোবেলজয়ের খবর পেয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া খুবই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে সঙ্গে সঙ্গে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা দিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, পরে মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি যেন ড. ইউনূসের সম্মানে নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করেন। সংসদ ভবনের সামনে সেই নাগরিক সংবর্ধনা হয়েছিল।
লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের সাক্ষাতের পর বাংলাদেশের মানুষ আরো কিছু সুখবর পাবে বলে মনে হয়। রাজনীতিতে যতটুকু অস্বস্তি রয়ে গেছে, আশা করা যায়, তা মিলিয়ে যাবে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সময় আবার নির্ধারিত হলে ভালো, না হলে এপ্রিলেই ক্ষতি কী? আসল কথা একটি সুন্দর নির্বাচন হোক।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তার বড় দায়িত্ব পরিচ্ছন্ন, উৎসবমুখর, শান্তিপূর্ণ ও বিপুলভাবে ভোটারদের অংশগ্রহণের পরিবেশে একটি নির্বাচন করা। সারা জাতি চায় এ ধরনের একটি নির্বাচন, কারণ গত ১৫টি বছর নির্বাচন থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। নির্বাচনের নামে একটির পর একটি শুধু কলঙ্কের একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন ফ্যাসিস্ট হাসিনা। ড. ইউনূস নিজে বলেছেন, স্বাধীনতার পর থেকে দেশের গভীর সংকটগুলোর জন্য ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন দায়ী ছিল। ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ার জন্যই বারবার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল বর্বর ফ্যাসিস্টে পরিণত হয়েছিল। এর সাক্ষী তো আমরা সবাই। আর স্বাধীনতার পরই শুধু নয়, ’৭০-এর নির্বাচনের ফল মেনে না নেওয়ার কারণেই তো স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে, একটি দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। সেটি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। তাই একটি ভালো নির্বাচনের গুরুত্ব কতটা এখান থেকেই বোঝা যায়। এবার সেই নির্বাচনটি হোক, সেটাই আমরা চাই।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমার দেশ