Image description

সৈয়দ আবদাল আহমদ

 

আল্লামা হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী বাংলাদেশের একজন কিংবদন্তি আলেমে দ্বীন ছিলেন। এ দেশের ইসলাম ও মুসলমানদের একজন যোগ্য রাহবার হিসেবে সবার শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন তিনি। আলোচিত ইসলামী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠার পর তিনি এ সংগঠনের মহাসচিব হন। আল্লামা শাহ আহমদ শফি (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর ২০২০ সালে জুনায়েদ বাবুনগরী তার উত্তরসূরি হিসেবে হেফাজতে আমির নির্বাচিত হন।

আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী হাদিসের দরসে হাজার হাজার ছাত্রকে ইলমি নববির শিক্ষাদান করেছেন। তিনি একজন প্রখ্যাত লেখক, ৩০টিরও বেশি গ্রন্থের প্রণেতা। ইসলাম অবমাননার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার কণ্ঠের একজন প্রতিবাদী আলেম। হেফাজতের আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের গণসমাবেশের মঞ্চে উপস্থিত থেকে তিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতায় তৌহিদি জনতাকে উজ্জীবিত করেছেন। কিন্তু তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার শাপলা চত্বরে গণহত্যার পর তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দি করেছেন। শুধু বন্দিই নয়, রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন।

জুনায়েদ বাবুনগরী আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি রিমান্ডে নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছিলেন। পাঠকদের জানার জন্য ‘চিরায়ত শাপলানামা’ থেকে তার সেই জেল জীবনের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি।

জেল জীবনের স্মৃতি বলতে গিয়ে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেছিলেন, আমার প্রথম রিমান্ড ছিল ৯ দিনের। রিমান্ডে নিয়ে যাওয়ার পর ডিবি অফিসে এক বসের কাছে ডাকা হলো। সেখানে র‍্যাবের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলেন। সঙ্গে আরো বেশ কয়েকজন অফিসার। র‌্যাবের অফিসারকে দেখতে একটু চাকমার মতো,তিনি ছিলেন অনেক রাগী। তিনি নিজে বলেছেন- তারা তো প্রথমে আমাকে আসামি বলত। এরপর আলহামদুলিল্লাহ হুজুর হুজুর বলা আরম্ভ করে।

তিনি বলেন, আপনাকে স্টেজে টার্গেট করেছিলাম। অর্ডার ছিল সেখানেই গুলি করা। কিন্তু দুই মিনিটের মধ্যেই আপনি সরে গিয়েছিলেন। এখন কিন্তু ছাড়াছাড়ি নেই। আমি ডিবি অফিসে আপনাকে রাখব না। সেখান থেকে আমাদের র‍্যাবের অফিসে নিয়ে যাব। ডিবির বসের কাছে আমি অনুমতি চাইব। তারা অনুমতি দিলে আপনাকে র‍্যাবের অফিসে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে কী হবে জানেন? আপনাকে প্রথমে ব্যায়াম করাব। পা ওপরের দিকে, মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঘুরাব, এরপর আপনার দুই পা লুলা করে দেব। আমাদের বস ওপরের নির্দেশে এটা করতে বলেছেন। জানেন তো ওপরের নির্দেশ একটু ব্যতিক্রম।

কিন্তু ডিবির বড় কর্মকর্তা র‍্যাবকে বললেন, এই আসামি আমার কাছে থাকবে, এখানে থাকবে। আল্লাহর রহমত আর কি। র‍্যাব নিয়ে গেলে অবস্থা কী হতো সেটা আল্লাহই ভালো জানেন। সেখানে আমার ওপর একটা প্রেশার ছিল। পরে দুজন অফিসার আমাকে বলেছেন, হুজুর! আপনার ওপর বেশি প্রেশার ছিল বামপন্থিদের। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, সেটা কেটে গেছে। বামদের, শাহবাগীদের প্রেশার। তারপর আর কোনো অফিসার তেমন কিছু করেননি। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন অনেক।

তারা আফগানিস্তানের মোল্লা ওমরের সঙ্গে আমার কতবার বৈঠক হলো, খালেদা জিয়ার সঙ্গে কতবার বৈঠক হলো, লেনদেনের সম্পর্ক কী? জিজ্ঞাসা করেছেন। সবকিছু জবাব দিয়েছি আমি। তারপর তারা বলছেন, ‘খালেদা জিয়া কী রকম? আপনি এখন বিশ্রাম নেন, আপনার রিমান্ড শেষ আজকের জন্য। এখান থেকে ওঠার আগে খালেদা জিয়াকে একটু গালি দেন, একটা শব্দ গালি দেন, তারপর চলে যান।’ আমি মুখটা বন্ধ করে সেখান থেকে চলে এসেছি। কেন গালি দেব, গালি দেওয়ার কোনো অর্থ আছে? মুখ বন্ধ করে চলে এসেছি। রিমান্ড ছিল ৯ দিন, এরপর আরো ২২ দিন দিল রিমান্ড। ৯ দিন শেষ হওয়ার পর কোর্টে নিয়ে গেছেন। কোর্টে তো আমার পক্ষে অনেক স্লোগান। এরপর ৯ দিন রিমান্ডের পর আরো ২২ দিন দিল। তখন কিন্তু আমার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। কিন্তু আল্লাহর রহমতে ওই ২২ দিনের পরিবর্তে দেওয়া হলো চার দিন। ৯ দিন আর ৪ দিন মিলিয়ে ১৩ দিন। রিমান্ডে আমাকে কিছু চিকিৎসা করায়।

ইনজেকশন দেয়। তখন কিছু বুঝতে পারছিলাম না যে, সেটা কি ভালো হওয়ার জন্য দিয়েছে, নাকি খারাপ হওয়ার জন্য। আর বাতের ওষুধ দিয়েছে বেশি। এই বাতের ওষুধের কারণে কিডনিতে একটু সমস্যা হয়ে যায়।

রিমান্ডে যিনি অফিসার ছিলেন আল্লাহ তাকে জাজায়ে খায়ের দান করুন। তার চেষ্টায় আর ওপরের অর্ডারে ২২ দিনের রিমান্ডের পরিবর্তে চার দিন করা হয়। এরপর আমাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ছিলাম এক দিন। এক দিন একরাত থাকার পর সেখানকার দায়িত্বশীল জাহেদ আমাকে বললেন, হুজুর আপনি কেন্দ্রীয় কারাগারে কষ্ট পাবেন। আপনাকে আমি গাজীপুরের কাশিমপুরে পাঠিয়ে দেব। সেখানে জেল হাসপাতাল আছে। সেখানে আমাকে নিয়ে গিয়েছে গাড়িতে করে। জেল হাসপাতালে ভর্তি করার পর একটু ভালো লেগেছে। আমার অনেক পরিচিত লোকজন ছিল সেখানে। তারা দেখা করেছে আমার সঙ্গে। আমার চিকিৎসা শুরু হয়ে গেলে ডাক্তাররা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসা করেছিলেন।

এখানে আমার সম্পর্কে বলা হলো-এই রোগী এ হাসপাতালের উপযুক্ত নন। নামান, এখনই নামান। তারপর আমাকে সেখান থেকে নামিয়ে আরেকটা হাসপাতালে নিয়ে যায়। যেখানে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অন্যান্য ফাঁসির আসামিরাও আছেন। সেখানে ৫ নম্বর রুমে আমাকে রেখেছে তিন দিন। শুধু মৃত্যুর যন্ত্রণাটা বাকি ছিল, এত কষ্ট পাচ্ছিলাম আমি। এরপরও জেল হাসপাতালের প্রধান খুব ভালো মানুষ। তিনি বোর্ড বসিয়েছেন, পরামর্শ করে ঠিক করেছেন, এই রোগী যদি এখানে থাকে তাহলে মারা যাবে। সরকারকে জানিয়েছেন। তখন সরকার থেকে অনুমতি নিয়ে ২৬ মে রাতে সরকারি গাড়িতে বারডেম পাঠিয়ে দিয়েছে। বারডেমে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে আমার চিকিৎসা শুরু হয়।

একদিন তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে-আপনাদের ডাকে ৩০-৪০ লাখ মানুষ কীভাবে জমা হলো? কত কোটি টাকা লেগেছে এখানে? আমি তখন বলেছিলাম-আপনাদের নিয়ম আর আমাদের নিয়মে বেশ তফাত আছে। আমরা কাউকে এখানে আসতে বলিনি। মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে-এ রকম ঈমানি আন্দোলন হবে। ফলে সমস্ত মানুষ নিজের উদ্যোগে নিজের খরচে, নিজের গাড়িভাড়া, নিজের খাবার, নিজের টাকা খরচ করে এসেছে ঈমানি দায়িত্ব পালন করার জন্য। আমরা কাউকে আনার জন্য গাড়িও পাঠাইনি, কোনো উদ্যোগও নিইনি। আমরা শুধু প্রচার করেছি, ব্যস মানুষ এসে গেছে। ইনশাআল্লাহ ঈমানি আন্দোলন চলতে থাকবে।

গোয়েন্দা সংস্থার বড় অফিসার-নাম বলতে চাচ্ছি না-আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনারা আবার যদি ডাক দেন তাহলে কত মানুষের সমাবেশ হবে? ‘আমি বললাম, এর চেয়ে আরো দ্বিগুণ হবে।’

বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আপনাদের লেনদেনের সম্পর্ক কী?

বললাম, কসম আল্লাহর, ৫টা টাকাও তাদের থেকে আমরা গ্রহণ করিনি, আমরা কোনো লেনদেন করিনি। তাদের সঙ্গে আমাদের লেনদেনের কোনো সম্পর্ক নেই, সাংগঠনিক কোনো সম্পর্ক নেই। সব খরচ প্রত্যেকে নিজেই বহন করেছে। যেকোনো মুসলমান, ধার্মিক সদস্য হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে থাকতে পারবে, যদি সে ধার্মিক হয়, মুসলমান হয়, রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসে, ইসলাম মানতে চায়।

দলীয় এজেন্ডা নিয়ে নয়, রাজনৈতিকভাবে নয়; বরং অরাজনৈতিকভাবে ঈমানি আন্দোলন হিসেবে, মুসলমান হিসেবে থাকতে হবে আমাদের সঙ্গে। কেউ রোজা রাখে-এটা শুধু আর আমাদের জন্য করে না, বরং ইসলামের জন্য করে। এ আন্দোলন প্রবলভাবে সাড়া ফেলেছে মানুষের ভেতরে। মানুষ শয়তান আর নফসের ধোঁকায় পড়ে নামাজ না পড়তে পারে, রোজা না রাখতে পারে; কিন্তু আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুলের মহব্বত এদেশের মুসলমানদের ভেতরে প্রোথিত আছে।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, আমার দেশ