
মাসুম খলিলী
গণমাধ্যমের মালিকানায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছে গণমাধ্যম কমিশন। এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতে গণমাধ্যমে কালো টাকার অনুপ্রবেশ নিরুৎসাহিত হবে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে প্রতি বছর তার আর্থিক হিসাব উন্মুক্ত করতে হবে, যাতে তার আয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়। এর একটি প্রক্রিয়া বের করা সম্ভব হলে সুপারিশটি ফলপ্রসূ হতে পারে। তবে মালিকানা পুনর্বিন্যাস ইস্যুতে আরো ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়
গণমাধ্যম সংস্কারের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি পৃথক কমিশন গঠন করে এই খাতে পুনর্গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। গণমাধ্যমের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিত্বশীল বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত কমিশন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন পেশ করেছে। এই প্রতিবেদনে গণমাধ্যম বিশ্বব্যাপী যে এক ধরনের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে তার স্বীকৃতি পাওয়া যায়। একই সাথে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বিরাজ করা বিভিন্ন সমস্যার ওপর আলোকপাত করে বাস্তবভিত্তিক কিছু সুপারিশও করা হয়েছে তাতে।
তবে একই সাথে সুপারিশমালার অনেকগুলো বাস্তবায়নযোগ্য না হয়ে নিতান্তই আইডিয়ালিস্টিক বলে মনে হয়েছে। আবার কোনো কোনো সুপারিশে মনে হয়েছে এই শিল্পের গভীর অনেক বিষয়কে কমিশনের সদস্যরা বিবেচনায় নিতে পারেননি। আজকের লেখায় আমরা বিশেষভাবে গণমাধ্যমের মালিকানাসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা সীমিত রাখব।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন তার সুপারিশের শুরুতে একটি জনমত জরিপকে তার পুরো প্রতিবেদনের ভিত্তি হিসাবে নিয়েছে বলে মনে হয়। চলতি বছরের প্রারম্ভিক দুই মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাধ্যমে পরিচালিত জরিপটি ছিল গণমাধ্যমের পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে প্রথম সমীক্ষা। এতে দেখা যায়, প্রতি ১০০ জনের ৬৮ জনই গণমাধ্যমকে স্বাধীন দেখতে চান। নিরপেক্ষ বা পক্ষপাতহীন গণমাধ্যমের প্রত্যাশা ৬০ ভাগ মানুষের। এ ছাড়াও মানুষ সরকারি, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রভাবমুক্ত, বস্তুনিষ্ঠ, সাধারণ মানুষের চাহিদা পূরণে সক্ষম, হলুদ সাংবাদিকতামুক্ত গণমাধ্যম চান। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের শতকরা ৩৮ জন এ কথাও মনে করেন যে, দেশের গণমাধ্যম স্বাধীন নয়।
দেশের গণমাধ্যম কেন স্বাধীন নয় এই প্রশ্নের একাধিক উত্তরের সুবাদে ৭৯ ভাগ মানুষ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন, ৭২ ভাগ সরকারি হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন এবং ৫০ ভাগ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন। সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত স্বার্থ, মালিকের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন অনেকে।
কমিশনের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, বাংলাদেশে গণমাধ্যম জগতে কেউ কেউ উন্নতি করলেও সামগ্রিকভাবে স্বাধীন গণমাধ্যমের বিকাশ ঘটেনি। অতীতের কোনো সরকারই সুস্থধারার গণমাধ্যম বিকাশের পথ সুগম করেনি, তবে গত দেড় দশকে বিচ্যুতির মাত্রা অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশে স্বাধীন, বস্তুনিষ্ঠ, দায়িত্বশীল ও শক্তিশালী গণমাধ্যম বিকাশের পথে প্রধান বাধাগুলোকে কমিশন আইনগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক এই তিন ভাগে দেখেছে। মালিকানার সঙ্কট, সরকারি নীতিসহায়তার অভাবও ধরা পড়েছে কমিশনের পর্যবেক্ষণে।
কমিশনের মতে, গণমাধ্যমের সমস্যা উত্তরণে আর্থিক সাফল্য এবং বিশ্বাসযোগ্য ও দায়িত্বশীল তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হলে মালিকানার কাঠামোয়ও পরিবর্তন আনতে হবে। মানুষের বস্তুনিষ্ঠ তথ্য পরিবেশনের দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের মালিকানার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
কমিশনের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, গত তিন দশকে গণমাধ্যমের যে ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে, তা মূলত বেসরকারি খাতের মাধ্যমেই হয়েছে। তবে গণমাধ্যমে বিনিয়োগের উৎস নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি। ফলস্বরূপ, গণমাধ্যমে প্রবলভাবে রাজনৈতিক প্রভাব পড়েছে। অনেক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নিজেদের ব্যবসাকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য গণমাধ্যমকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং সরকারি দলের সমর্থনে সংবাদ পরিবেশনের জন্য সম্পাদকীয় নীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছেন। একই গোষ্ঠীর মালিকানায় একাধিক সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও ও অনলাইন পরিচালিত হয়েছে, যার মাধ্যমে গণমাধ্যমে গোষ্ঠীগত প্রভাব কেন্দ্রীভূত করার প্রচেষ্টা দেখা গেছে। এতে গণমাধ্যমে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে, সামগ্রিকভাবে গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা কমেছে এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক ভিত্তিও দুর্বল হয়েছে।
এই উপলব্ধি থেকে কমিশন গণমাধ্যমের মালিকানায় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হিস্যায় লাগাম টানতে হবে বলে উল্লেখ করেছে। একক মালিকানায় স্বেচ্ছাচারের যে অবকাশ থাকে, তা বন্ধ করতে মাঝারি ও বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারমুখী করা এবং উদ্যোক্তা পরিচালক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের শেয়ার ধারণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো সীমা বেঁধে দেয়াই যুক্তিযুক্ত বলে উল্লেখ করেছে।
কমিশন আরো বলেছে, একই মালিকানায় একাধিক সংবাদমাধ্যম রেখে গণমাধ্যম কেন্দ্রীভূত করার প্রবণতা রোধ করার উদ্যোগ নিয়েছে বিভিন্ন দেশ। গণমাধ্যমে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি ও মানুষের নিরপেক্ষ তথ্য পাওয়া নিশ্চিত করতে হলে ‘ওয়ান হাউজ ওয়ান মিডিয়া’র পথে এগোতে হবে। গণমাধ্যমকে ব্যবসাসফল ও টেকসই করার ক্ষেত্রে একক মালিকানার চেয়ে যৌথ মালিকানার সাফল্যের দৃষ্টান্ত রয়েছে মর্মে উল্লেখ করে কমিশন তাতে সাফল্যের অন্যতম শর্ত সম্পাদকীয় স্বাধীনতা বজায় থাকে বলে জানিয়েছে।
গণমাধ্যম কমিশন তার প্রতিবেদনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী কথা বলেছে। একদিকে গণমাধ্যমের আর্থিক সঙ্কট প্রসঙ্গে বলেছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পূর্বশর্ত হচ্ছে আর্থিক স্বাবলম্বিতা বা সচ্ছলতা। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের গণমাধ্যম কখনোই সম্পূর্ণরূপে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ছিল না। বিজ্ঞাপনের সীমিত বাজারে এখন প্রথাগত ও ডিজিটাল মিডিয়ার তীব্র প্রতিযোগিতা। মুদ্রিত সংবাদপত্রের বিক্রি দ্রুত কমছে, দর্শক-শ্রোতা হারাচ্ছে সম্প্রচারমাধ্যম। পাল্লা দিয়ে বিজ্ঞাপনের আয়ও কমছে। অনলাইনে পত্রিকার পাঠক বাড়লেও আয় বাড়েনি। গণমাধ্যমের কর্ণধারদের অনেকে জানিয়েছেন, বর্তমানে কোনো সংবাদমাধ্যমই লাভজনক নয়। এক-দুই দশক ধরে নিজের আয়ে সাফল্যের সাথে চলা এবং প্রসার লাভ করা পত্রিকাগুলোও এখন ব্যয় সঙ্কোচন করছে। একই অবস্থা বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেলের। একই সাথে বলা হয়েছে, সংবাদপত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করলেও প্রযোজ্য নীতিসহায়তা দেয় না সরকার। বরং করপোরেট ট্যাক্সের উচ্চহার (২৭.৫%) এ শিল্পকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এর অর্থ হলো গণমাধ্যম এখনো লাভজনক শিল্প হিসাবে দাঁড়াতে পারছে না। অন্যান্য শিল্পে যেখানে উৎপাদনকৃত পণ্য বিক্রি করে পণ্যের উৎপাদন খরচ ও মুনাফা তুলে আনা হয় সেখানে গণমাধ্যম শিল্প এর ব্যতিক্রম। গণমাধ্যমের মধ্যে সংবাদপত্র বিক্রি করে এর খরচের একটি অংশ তুলে আনা সম্ভব হয়। বাকিটা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয় করতে হয়। রেডিও টিভিতে আয়ের একমাত্র উৎস হলো বিজ্ঞাপন। আর আনুষ্ঠানিক গণমাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞাপনের আয় কমে যাচ্ছে। দেড় দশক আগের সাথে তুলনা করা হলে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন রাজস্ব প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে ধারণা করা হয়।
এই অবস্থায় প্রভাবমুক্ত তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে কমিশনের সুপারিশ অনুসারে এক হাউজে একটি গণমাধ্যমের নীতি গ্রহণ করা হলে সাংবাদিক কর্মচারীদের ওয়েজবোর্ড অনুসারে বেতনভাতা দেয়া সচল গণমাধ্যমের এক-তৃতীয়াংশও টিকে থাকবে কি না সন্দেহ।
বাংলাদেশের বাস্তবতা অনুসারে সংবাদপত্র লাভজনক শিল্প হিসাবে কোনো সময় যেহেতু সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি, তাই করপোরেট হাউজগুলো তাদের অন্য লাভজনক শিল্পের সাথে লোকসানি গণমাধ্যম শিল্পকে এক করে অন্য ইউনিটের লাভ দিয়ে এর ভর্তুকির সংস্থান করে। যেটি একক গণমাধ্যম শিল্পের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। এ ছাড়া গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের আয় হিসাবে কাজ করে। এ অবস্থায় করপোরেট হাউজ পরিচালিত গণমাধ্যম সীমিত করা হলে সেখানে কর্মসংস্থান মারাত্মকভাবে সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে।
সংস্কার কমিশন বাংলাদেশে গণমাধ্যমকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার বাধ্যবাধকতা আরোপের সুপারিশ করে বলেছে, উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ বড় গণমাধ্যম কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির কারণে কোম্পানির উদ্যোক্তা বা ব্যবস্থাপকদের শেয়ারহোল্ডারদের কাছে অন্তত জবাবদিহি করতে হয়।
অথচ সংস্কার কমিশনই উল্লেখ করেছে, ঐতিহাসিক কাল থেকে গণমাধ্যম বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ছিল না। আর পুঁজিবাজারে কোনো প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে যেতে হলে সেটি ডিরেক্ট লিস্টিং বা বুক বিল্ডিং যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন দুই-তিন বছর লাভজনকভাবে চলছে এবং সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি হয়েছে এমন স্টেটমেন্ট জমা দিতে হয়। এই শর্ত পূরণ করে নতুন কোনো গণমাধ্যম তো নয়ই, বাংলাদেশে চালু কয়টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারবে সেটি অনুমান করা খুব কঠিন নয়। আমার জানা মতে, একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত হওয়ার আবেদন জমা দেয়ার পর এক যুগেও তার নিষ্পত্তি করতে পারেনি। উন্নত বিশ্বের গণমাধ্যমের দৃষ্টান্ত সামনে রেখে বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনা না করে বাধ্যবাধকতা আরোপ এখানকার গণমাধ্যমকে মারাত্মক সঙ্কোচনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন তথ্যের আমানত আর ব্যাংকের আমানতকে সমার্থক হিসাবে তুলনা করে বলেছে, ব্যাংকের আমানতকে জনগণের আমানত বিবেচনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তি বাধ্যতামূলক করা হলেও আমাদের দেশে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তেমনটি করা হয়নি। ব্যাংকিং খাতে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালক পারিবারিকভাবে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারে না এবং কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে একই সময়ে পরিবারের তিনজনের বেশি পরিচালক থাকতে পারেন না। কিন্তু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এ ক্ষেত্রে তাই পরিবর্তন প্রয়োজন।
কিভাবে তথ্যের আমানত আর ব্যাংকের আমানতের তুলনা এ ক্ষেত্রে করা হলো তা বোধগম্য নয়। ব্যাংকের যারা পরিচালনাকারী মালিক তারা ব্যাংকের মোট আমানতের তুলনায় অতি সামান্য অংশের বিনিয়োগকারী। অথচ তারা পুরো আমানতের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বিনিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। ফলে ব্যাংক পরিচালনায় একই পরিবার বা গ্রুপের অংশগ্রহণ সীমিত করার বাস্তব যুক্তি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের সাথে কোনোভাবেই ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তুলনা চলে না।
এ ধরনের তুলনা করে ব্যাংকের ব্যবস্থা গণমাধ্যমে প্রয়োগ করার সুপারিশ করেছে গণমাধ্যম কমিশন। কমিশন বলেছে, প্রথম পর্যায়ে মাঝারি ও বৃহৎ মিডিয়া কোম্পানিগুলোকে সর্বসাধারণের জন্য শেয়ার ছাড়া ও স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয়া সমীচীন। উদ্যোক্তা পরিচালক ও ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শেয়ার ধারণের সীমা ২৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত করা ও প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে শেয়ারবণ্টন বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। কর্মীদের শেয়ার ধারণের সর্বোচ্চ সীমা ৫ শতাংশেই সীমিত রাখতে হবে, যাতে উদ্যোক্তারা কর্মীদের সাথে মিলে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারেন।
কমিশন ছোট আকারের মিডিয়া কোম্পানিতে কর্মীদের শেয়ার দেয়া বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেছে। অথচ বাস্তবতা হলো একে তো মিডিয়া সাধারণভাবে লাভজনক নয় বলে কমিশনই উল্লেখ করেছে তার উপর কর্মীদের শেয়ার দেয়া বাধ্যতামূলক করা হলে উদ্যোক্তারা সাধারণভাবে এতে আসতে চাইবে না। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম কমিশনের সুপারিশ প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ধারণার মতো মনে হতে পারে যা বাস্তবে ঘটার কোনো সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে না।
গণমাধ্যম কমিশন একই কোম্পানি/গোষ্ঠী/ব্যক্তি/পরিবার/উদ্যোক্তা যাতে একই সাথে একাধিক মাধ্যমের মালিক হতে না পারেন, সে জন্য যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিশ্বের বহু দেশে ক্রস-ওনারশিপ (টেলিভিশনের মালিক সংবাদপত্রের মালিক হতে পারেন না বা সংবাদপত্রের মালিক টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক হতে পারেন না) নিষিদ্ধ করার কথা উল্লেখ করে সেটি বাংলাদেশে চালুর সুপারিশ করেছে। কমিশন বলেছে অচিরেই অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি এবং ক্রস-ওনারশিপ নিষিদ্ধ করে অর্ডিন্যান্স জারি করা যায় এবং যেসব ক্ষেত্রে এটি বিদ্যমান, সেগুলোয় পরিবর্তন আনার নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তাদের ব্যবসা পুনর্গঠনের লক্ষ্য ঠিক করে দেয়া প্রয়োজন। যারা একই সঙ্গে টেলিভিশন ও পত্রিকার মালিক তারা যে কোনো একটি গণমাধ্যম রেখে অন্যগুলোর মালিকানা বিক্রির মাধ্যমে হস্তান্তর করে দিতে পারেন। অথবা দু’টি মিডিয়ার (টেলিভিশন ও পত্রিকা) সাংবাদিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে একত্র করে আরো শক্তিশালী ও বড় আকারের একটি মিডিয়া (টেলিভিশন অথবা দৈনিক পত্রিকা) পরিচালনা করতে পারেন।
কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হলে অনেক সংবাদপত্র বা টিভি বন্ধ করে দিতে হবে। এই সুপারিশ মালিকানা বিকেন্দ্রীকরণ হবার কারণে মত নিয়ন্ত্রণে একতরফা কিছু সৃষ্টিতে বাধা তৈরিতে ইতিবাচক হলেও এটি অনেক দেশেই সফল হয়নি। কমিশনের প্রতিবেদনে ভারতের উদাহরণ উল্লেখ করা হয়েছে অথচ সেখানে বিখ্যাত মোদি ঘনিষ্ঠ আদানি গ্রুপ বহু সংখ্যক মিডিয়ার মালিক ও নিয়ন্ত্রণকারী।
কমিশন বলেছে, গণমাধ্যমে সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ বিনষ্ট করে এমন ব্যবস্থার অবসান হওয়া দরকার। একক মালিকানায় একই ভাষায় একাধিক দৈনিক পত্রিকা বা একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করে। একই সাবান একাধিক মোড়কে বাজারজাত করা যেমন বাজারের প্রতিযোগিতাকে নষ্ট করে, একই মালিকানায় একই ভাষায় একাধিক দৈনিক পত্রিকাও গণমাধ্যমের প্রতিযোগিতাকে নষ্ট করে এবং পাঠক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
বাস্তবতা হলো, সাবান আর গণমাধ্যম এক নয়। এটি প্রমাণের জন্য একই গ্রুপের দুটি পত্রিকা কালের কণ্ঠ ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের কথা উল্লেখ করা যায়। এমনকি ট্রান্সকম গ্রুপের দুটি পত্রিকা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কোনোভাবে একই ধরনের নয়। এসব পত্রিকা মোটেই অভিন্নভাবে বের হয় না। দুয়েকটি সিন্ডিকেট রিপোর্ট ছাড়া এগুলোর মধ্যে কোনো মিল থাকে না।
গণমাধ্যমের মালিকানায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছে গণমাধ্যম কমিশন। এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতে গণমাধ্যমে কালো টাকার অনুপ্রবেশ নিরুৎসাহিত হবে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে প্রতি বছর তার আর্থিক হিসাব উন্মুক্ত করতে হবে, যাতে তার আয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়। এর একটি প্রক্রিয়া বের করা সম্ভব হলে সুপারিশটি ফলপ্রসূ হতে পারে। তবে মালিকানা পুনর্বিন্যাস ইস্যুতে আরো ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়।