Image description

অর্থ সংকটে বন্ধ হয়ে যাওয়া বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানি ‘বেক্সিমকো টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল ডিভিশন’ (বেক্সটেক্স) লিজ নিয়ে পুনরায় চালু করতে যাচ্ছে জাপান-বাংলাদেশি ইথিক্যাল ফ্যাশন ও সাসটেইনেবিলিটি ভেঞ্চার রিভাইভাল গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড এবং রিভাইভাল প্রজেক্টস লিমিটেড।

এর ফলে ২৫ হাজারের বেশি শ্রমিক আবার কাজে ফেরার সুযোগ পাবেন জানিয়ে বেক্সিমকো গ্রুপের জনসংযোগের দায়িত্বে থাকা বেঞ্চমার্ক পিআর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, এ বিষয়টিককে “সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থান পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।”

সেখানে বলা হয়, প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি ইকোমিলিও এ প্রকল্পে অর্থায়নে থাকছে।

প্রথম ধাপে রিভাইভাল ও ইকোমিলি ২ কোটি ডলার ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সহায়তা দেবে এবং প্রয়োজনে তা ১০ কোটি ডলার পর্যন্ত বাড়ানো হবে।

লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, আসছে ডিসেম্বর থেকে উৎপাদন শুরু হলে ২০২৭ সালের মধ্যে বছরে ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন সম্ভব হবে বলে আশা করছে রিভাইভাল।

এ বিষয়ে বেক্সিমকো টেক্সটাইলের পাওনাদার জনতা ব্যাংক, বেক্সটেক্স ও রিভাইভাল প্রজেক্টের মধ্যে চলতি মাসেই ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই হওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এই চুক্তির প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতা করছে।

বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস-চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন। গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থ্যানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি গ্রেপ্তার হন।

এর পর থেকে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানিগুলোতে অস্থিরতা শুরু হয়। শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যে বন্ধ রাখা হয় বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬ কারখানা।

বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে ৩২টি কারখানার নাম ঘোষণা থাকলেও বাস্তবে ১৬টির অস্তিত্ব পায় সরকারের তদন্ত কমিটি।

 

সরকারের তরফে বলা হয়, আওয়ামী লীগের আমলে অস্তিত্ব না থাকা ওই ১৬টি কোম্পানির নামে ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছিল। আর সব মিলিয়ে ৩২ কোম্পানির নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া হয় ২৯ হাজার ৯২৫ কোটি টাকার ঋণ।

এসব ঋণ খেলাপী হয়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকেরই ২৩ হাজার কোটি টাকা।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে ‘অস্তিত্ব থাকা’ ১৬টির মধ্যে ১১টি বস্ত্র ও পোশাক খাতের কোম্পানি, যেগুলো লে-অফ ছিল গত জানুয়ারি পর্যন্ত। এরপর সেগুলো আর খোলা হয়নি।

এর মধ্যে সরকারের উদ্যোগে জাপানি কোম্পানি রিভাইভাল গত অগাস্টে বেক্সিমকো টেক্সটাইল লিজ নিয়ে সচল করতে রাজি হয়। বেক্সিমকো গ্রুপও সম্মতি জানিয়ে চিঠি দেয়।

সরকারের পক্ষে বিষয়টি সমন্বয় করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ ব্যাংক, পাওনাদার জনতা ব্যাংক এবং সরকার কয়েকটি সভা করে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা দেওয়ার পথ তৈরি করে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান সে সময় বলেছিলেন, “আমাদের মন্ত্রণলায় মূলত কো-অর্ডিনেশনের কাজটি করছে। আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি কর্মসংস্থান ও ব্যাংক ঋণের দিকটি। প্রতিষ্ঠানটি সচল হলে কিছু কিছু করে হলেও ব্যাংকের টাকা শোধ দিতে পারবে, জানি তাতে অনেক সময় লাগবে।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছিলেন, “বেক্সিমকোর টেক্সটাইল ইউনিট রপ্তানিমুখী। তাদের মেশিন আছে, সেটআপ রেডি। আমরা কর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দিচ্ছি। লিজ নিয়ে চালালেও কিছু লোকের কর্মসংস্থান তো হবে।’’

রোববার বেঞ্চমার্ক পিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “একসময় দেশের টেক্সটাইল শিল্পের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল বেক্সিমকো টেক্সটাইল। তিন দশক সফলভাবে চলার পর ঋণসঙ্কটে পড়ে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়।

“হঠাৎ বন্ধের কারণে হাজারো শ্রমিক চাকরি হারায়, কারখানা-নির্ভর ছোট ব্যবসা ধসে পড়ে এবং আশেপাশের এলাকার অর্থনীতি অস্থির হয়ে পড়ে। রিভাইভালের এই উদ্যোগ সেই বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন পথ তৈরি করছে; কারখানা আবার চালু হবে এবং কর্মীরা ফিরে পাবেন তাদের জীবিকার নিরাপত্তা।”

রিভাইভালের বরাত দিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তারা কারখানাটি পূর্ণাঙ্গভাবে পুনরায় চালু করবে, পুরোনো ব্যবস্থাপনা দলকে ফিরিয়ে আনবে এবং আগের সব কর্মীকে পুনর্বহাল করবে। কারখানার কার্যক্রমের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে জাপান থেকে ‘অভিজ্ঞ’ শীর্ষ কর্মকর্তাদের আনা হবে। পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিকমানের জবাবদিহির জন্য একটি আন্তর্জাতিক অডিট ফার্ম নিয়োগ করা হবে।

“কারখানা চালুর পাশাপাশি রিভাইভাল বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও ফ্যাশন খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আনতে চায়। তারা বেক্সিমকোর আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে আবার সংযোগ স্থাপন করবে এবং নতুন বৈশ্বিক অংশীদারও যুক্ত করবে। শুধু কম খরচে পোশাক উৎপাদন নয়, বরং বাংলাদেশকে সৃজনশীলতা ও ব্র্যান্ড উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই তাদের লক্ষ্য।”

একসময়কার লাভজনক কোম্পানি বেক্সটেক্সের বড় ক্রেতাগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে জারা, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, টারগেট, আমেরিকান ঈগল, পুল অ্যান্ড বিয়ার ও বেস্ট সেলারের মত প্রতিষ্ঠান।

কারখানা চালু হলে প্রথম তিন মাস পরিচালন খরচ বাবদ নতুন অর্থায়ন লাগবে। বন্ধ হওয়ার পরে গত জানুয়ারিতে একদল শ্রমিক ও কর্মাচারিদের নিয়ে হাজির হয়ে সংবাদ সম্মেলনে বেক্সিমকো গ্রুপের হেড অব এডমিন আব্দুল কাউয়ুম বলেছিলেন, ‘‘কারখানা চালু করতে পরিচালন খরচ বাবদ প্রতি মাসে একশ কোটি টাকা লাগবে।”

কারখানা খুলে দেওয়ার পর পরিচালন খরচ বাদ দিলে প্রতি বছরে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব বলে সে সময় তিনি হিসাব দিয়েছিলেন।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “পুনরায় চালুর কাজ ইতোমধ্যে এগিয়ে গেছে। রিভাইভাল প্রজেক্টস লিমিটেড, বেক্সিমকো ও জনতা ব্যাংকের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির খসড়া গত ৮ অক্টোবর জমা দেওয়া হয়েছে। আগামী মঙ্গলবার জনতা ব্যাংকের বোর্ড সভায় এটি পর্যালোচনা হবে এবং চলতি মাসেই চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।”

রিভাইভাল ও ইকোমিলির শীর্ষ কর্মকর্তারা নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকায় এসে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বলে জানানো হয়েছে সেখানে।

রিভাইভালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা হুদা মোহাম্মদ ফয়সালকে উদ্ধৃত করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “এটা শুধু কারখানা চালু করা নয়—হাজারো পরিবারের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ। প্রতিটি ফিরে আসা চাকরি নতুন করে আস্থা এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলবে।”

ইকোমিলির প্রেসিডেন্ট ড. ফারহান এস করিম বলেন, “একজন প্রবাসী বাংলাদেশি হিসেবে দেশের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পুনরায় চালু করতে সহায়তা করতে পেরে আমি গর্বিত। এটি ব্রেইন ড্রেইনের গল্প নয়—এটি ব্রেইন গেইনের গল্প। আমরা একসঙ্গে মানুষের জীবিকা ফেরানোর পাশাপাশি দেশের শিল্পখাতকে নতুন প্রাণ দিতে চাই।”

বেক্সিমকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী বলেন, “সরকারের নির্দেশে বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের টেক্সটাইল বিভাগ সর্বোচ্চ পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ চালিয়ে গেছে। ৪২ হাজার কর্মী ও কর্মকর্তার চাকরি রক্ষা করা এবং প্রতি মাসে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ধরে রাখা ছিল আমাদের প্রধান দায়িত্ব। আর্থিক সংকটের মধ্যেও আমরা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিগুলো সচল রেখেছি, যাতে যে কোনো মুহূর্তে কারখানা চালু করা যায়। রিভাইভালের উদ্যোগে সেটি এখন সম্ভব হচ্ছে।”