বাংলাদেশের বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম তার নিয়ন্ত্রণাধীন আটটি ব্যাংকের মধ্যে চারটি ব্যাংক থেকে ঋণের নামে লুট করেছে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বেনামে নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চারটি ব্যাংক থেকে ঋণ জালিয়াতি করেছে ৯৩ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। যার গোপন নথি বাংলা আউটলুকের কাছে রয়েছে।
এরমধ্যে ইসলামী ব্যাংক থেকে এক লাখ ৫৪৮৩ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ৬১০ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।
আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এস আলম ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নামে-বেনামে এবং প্রভাব বিস্তার করে শিল্পগোষ্ঠীটির নিয়ন্ত্রণাধীন চারটি ব্যাংক থেকে এই পরিমাণ অর্থ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এস আলমের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল।
২০০৯ সাল থেকে শুরু করে ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করেছে আওয়ামী লীগ। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হয়। এরপর পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা এস আলমসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত দুর্নীতি ও আর্থিক অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই ব্যবস্থা নেওয়া আরও জোরদারের তাগিদের মধ্যেই এই তথ্য উঠে এলো।
এর আগে গত অক্টোবরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ধনকুবের ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংকখাত থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। এর মধ্যে কেবল এস আলম-ই অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় এস আলম ব্যাংকগুলো ক্যাপচার করেছে। এর ফলে এসব ব্যাংকগুলোর ভল্টে যে টাকা ছিল তা সব তারা লুটপাট করে পাচার করেছে। এখানে ব্যাংকগুলোর সহায়তা ছিল। যেহেতু তারা দখল করেছে সে কারণে তারা এটাকে জনগণের টাকা মনে করেনি। তারা এস আলমের টাকা মনে করে লুটপাট করেছে।
তিনি বলেন, কোনো সভ্য, গণতান্ত্রিক দেশে এটা হয় না। সরকারের জবাবদিহিতা না থাকার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। অবশ্যই এস আলম যেহেতু পাচার করেছে তারা বেশি দায়ী। কিন্তু তারাতো কারো না কারো সহযোগিতায় এসব টাকা পাচার করেছে। তাদেরকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। যদি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায় তাহলে ভবিষ্যতে অর্থ পাচার বন্ধ হবে।
ইসলামী ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে এক লাখ ৫৪৮৩ কোটি টাকা লুট
এস আলম ইসলামী ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণের মাধ্যমে এক লাখ ৫৪৮৩ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। এরমধ্যে প্রত্যক্ষ অর্থের পরিমাণ ৮৫ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। আর এস আলম গ্রুপ পরোক্ষ অনিয়মিত সুবিধা নিয়েছে ২০ হাজার ৩৮ কোটি টাকা।
পরোক্ষ সুবিধার মধ্যে বিভিন্ন শাখা হতে এস আলম ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ৩৪ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। ব্যাংকের অফসোর ব্যাংকিং ইউনিট হতে ফরেন কারেন্সিতে ঋণ নিয়েছে ১৯ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। অসমন্বিত Inter-Bank Debit Advice (IBDA) থেকে নিয়েছে ৮৬৭৫ কোটি টাকা। এছাড়া শাখা হতে বিভিন্ন বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে এস আলম ঋণ নিয়েছে ২২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা।
এছাড়া ইসলামী ব্যাংকে থেকে পরোক্ষ সুবিধায় এস আলমের অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বানাতে বিনিয়োগ ও অগ্রীম নিয়েছে ৯৭৩৩ কোটি টাকা, অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্লেসমেন্ট হিসেবে বিনিয়োগ ৭০৪ কোটি টাকা, দুটি বন্ডে (Mudaraba Subordinated Bond এবং Mudaraba Perpetual Bond) বিনিয়োগ ৭০৪ কোটি টকা, ইসলামী ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেড কর্তৃক এমটিডিআর হিসেবে বিনিয়োগ ৩৯৬ কোটি টাকা।
এছাড়া কর্মীদের প্রভিডেন্ড ফান্ড (Employees' Providend Fund) এবং কর্মীদের গ্র্যাচুয়িটি ফান্ড (Employees' Gratuity Fund) থেকে মুদারাবা সেভিংস বন্ড হিসেবে বিনিয়োগ ৩৫০ কোটি টাকা, সিএসআর (Corporate Social Responsibility-CSR) এর অর্থ জালিয়াতি ৪১২ কোটি টাকা , অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে বিনিয়োগে ব্যাংকের ক্ষতি ৫০০ কোটি, কম মুনাফা ধার্য করার জন্য ব্যাংকের ক্ষতি ৫৬৫ কোটি এবং আর্থিক সুবিধা গ্রহণের উদ্দেশ্যে মুনাফা মওকুফ ১৭১ কোটি টাকা।
২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক কর্মকর্তার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের এমডিকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করানো হয়। যার মাধ্যমে এস আলমের দখলদারিত্বে চলে যায় ইসলামী ব্যাংক। সেই সময় থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের কর্তৃত্বে ছিল এই গ্রুপটি। জুনে এসে ব্যাংকটির বোর্ড ভেঙে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যার মাধ্যমে এই ব্যাংক থেকে কর্তৃত্ব হারায় এস আলম।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন আটটি ব্যাংকের বোর্ডই ভেঙে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া আরও তিনটি বেসরকারি ব্যাংকসহ মোট ১১টি ব্যাংকের বোর্ড ভাঙে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা লুট
এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন আট ব্যাংকের মধ্যে একটি ছিল ইউনিয়ন ব্যাংক। এই ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণের মাধ্যমে এস আলম নিয়েছে ২৩ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা।
এর মধ্যে এস আলমের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে ২০ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা ঋণে। এছাড়া পরোক্ষভাবে এস আলম নিয়েছে ২৭৪১ কোটি টাকা।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখা থেকে এস আলম তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়েছে ১৩০০ কোটি টাকা। এছাড়া বিভিন্ন বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বের করে নিয়েছে ১৯ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা।
এছাড়া পরোক্ষ মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এস আলম কর্তৃক পরিচালক নিয়োগ ও তার মালিকানাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আভিভা ফিন্যান্স লিমিটেডে (Aviva finance limited) বিনিয়োগসহ মোট আরও দুটি বিনিয়োগের মাধ্যমে মোট ২৭৪১ কোটি টাকা নিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক রিপোর্টে জানা যায়, এস আলম গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ২৪৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার মাধ্যমে এই ঋণগুলো নেওয়া হয়। এসব ঋণের বেশিরভাগেরই কোনো ধরনের জামানত ছিল না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউনিয়ন ব্যাংকের গুরুতর অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও এস আলম গ্রুপ এবং সহযোগী লোকবল দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জড়িত।
ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ থেকে প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, মোট লোকবলের ৭৬.৩৭ শতাংশ কোনো প্রকার পরীক্ষা ছাড়াই চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি নিয়োগ প্রাপ্ত।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ৬১০ কোটি টাকা লুট
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম নিয়েছে ৪৭ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এস আলম গ্রপ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বেনামি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি কর্তৃক লোপাট করা হয়েছে ৩৯ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। যার পুরোটাই তছরূপের উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।
বিএফআইইউয়ের প্রতিবেদনে এসেছে, এস আলম তার নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকগুলো থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে তা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে।
জানা গেছে, কর স্বর্গ ও ভুয়া কোম্পানিগুলোর ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে (বিভিআই) বিতর্কিত বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে।
এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্তকারীদের মতে, গ্রুপটির চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ ২০১১ থেকে ২০২৪ সালের আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রয়োজনীয় অনুমোদন ছাড়াই বিভিআইতে ১৮টি ভুয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সাধারণত অর্থ পাচার করতে এসব কোম্পানি ব্যবহৃত হয়।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা লুট
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক থেকে শিল্পগোষ্ঠীটি নামে বেনামে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়েছে ১৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, স্বনামে এস আলম গ্রুপের অনুকূলে ঋণ নিয়েছে ৮২৯ কোটি টাকা। এছাড়া এস আলম গ্রুপের বেনামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণ নেওয়া হয়েছে ১১ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা।
আর পরোক্ষভাবে অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্লেসমেন্ট হিসেবে বিনিয়োগ ও সিএসআরের অর্থ তছরূপের মাধ্যমে মোট অর্থ নিয়েছে ৪৮৮ কোটি টাকা।
এস আলম গ্রুপের এসব অনিয়মের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মুখপাত্র ও মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, দেশের বড় বড় যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ঋণ অনিয়মের তথ্য রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে অনুসন্ধান চলছে। তাদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান প্রতিবেদন পাওয়া গেলে তারপর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি বলেন, যেহেতু প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে তদন্ত এখন অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে। তাই এখনই বলা যাচ্ছে না, কোন গ্রুপ কি পরিমাণ অর্থ দেশের ব্যাংককিং খাত থেকে লোপাট করেছে।
এদিকে, এস আলমের অর্থ পাচার নিয়ে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে দুদকেও। ২০২৩ সালের ৪ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে এস আলমের অর্থপাচার নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এরপর একই বছরের ১৩ আগস্ট এস আলমের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশে অনুসন্ধানটি থমকে যায়।
সম্প্রতি হাইকোর্টের আদেশ পেয়ে পুনরায় দুদকের অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হয়। দুদকের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ২০ নভেম্বর অনুসন্ধানের জন্য দুদকের উপপরিচালক মো. আবু সাঈদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল পুনরায় গঠন করা হয়েছে।