আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লুটপাট হওয়ার কারণে কিছু ব্যাংক আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এসব ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে জামানতহীন তারল্য সহায়তা বা ঋণ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই এ ধরনের ঋণ দেওয়া বন্ধ করার শর্ত জুড়ে দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফের প্রতিনিধি দলের বৈঠকে তাদের পক্ষ থেকে এমনটা জানানো হয়েছে। চলমান ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির ষষ্ঠ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে দেশের আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন সূচকের অগ্রগতি জানতে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসেছে। পাপাজর্জিওর নেতৃত্বে আসা আইএমএফের এ দল গতকাল থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে বৈঠকে নেতৃত্ব দেন ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার। এ সময় অন্যান্য ডেপুটি গভর্নর ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্বাহী পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। প্রতিনিধি দল ১৩ নভেম্বর বৈঠক শেষ করবে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গত সরকারের আমলে যেসব ব্যাংক লুটপাটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ওই সময় থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় ধার দেওয়া শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেটাকে বলা হয় ‘লেন্ডার অব দ্য লাস্ট রিসোর্ট’। এখন পর্যন্ত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বিশেষ ব্যবস্থায় জামানত ছাড়া প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এভাবে সুবিধা দেওয়ার ঘটনা বিরল। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিতে হলে তাদের কাছে ব্যাংকগুলোকে বিল বা বন্ড জমা রাখতে হয়। তা না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ধার দিতে পারে না। কিন্তু এসব ব্যাংকের কাছে টাকা ধার নেওয়ার জন্য ব্যবহারযোগ্য বিল-বন্ড ছিল না। সে জন্য তারা প্রতিশ্রুতিপত্র (ডিমান্ড প্রমিজরি নোট) প্রদান করে টাকা ধার নিয়েছে। এই প্রতিশ্রুতিপত্রের মাধ্যমে যে কোনো উপায়ে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ব্যাংকগুলো। তবে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাংক মেয়াদ শেষ হলেও টাকা ফেরত দিতে পারেনি।
এমন পরিস্থিতিতে আইএমএফ বলেছে, আনসিকিউড বা জামানতহীন ধার বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দিতে পারবে না। এ প্রথা এখনই বন্ধ করতে হবে। কারণ এটা একটা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো উত্তর দেয়নি।
গতকাল দুপুর ১২টায় ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহারের নেতৃত্বে ওপেনিং মিটিং শুরু হয়। এ সভায় গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও নীতিগত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর দুপুর ২টায় গবেষণা বিভাগের নির্বাহী পরিচালকের নেতৃত্বে রিস্ক বেইজ সুপারভিশন, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা, আমানত উত্তোলনে সীমা এবং পূর্বে আমানত উত্তোলন সীমা আরোপ ও প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা করা হয়। এছাড়া দুপুর ৩টায় তিন ডেপুটি গভর্নরের নেতৃত্বে বৈঠকে তারল্য সংকটের প্রধান উৎস, আমানত ঘনত্ব, ঝুঁকি প্রশাসনমূলক পদক্ষেপ, ব্যাংক রেজুলেশন অডিন্যান্স, পাঁচ ব্যাংক একীভূত প্রক্রিয়ার অগ্রগতি ও ঝুঁকি পর্যালোচনা করা হয়।
আর্থিক সংকট সামাল দিতে ২০২২ সাল থেকে কয়েক দফা আলোচনা শেষে পরের বছরের প্রথম দিকে আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি করে বাংলাদেশ। সবশেষ গত জুনে অর্থ ছাড়ের সময়ে ঋণের আকার বাড়িয়ে করা হয় ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। সে বছর ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে পাওয়া যায় দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার আসে ২০২৪ সালের জুনে। আর চলতি বছরের জুনে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একসঙ্গে মিলিয়ে ১৩৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার হাতে পায় বাংলাদেশ।
এদিকে ষষ্ঠ কিস্তি পাওয়া নিয়ে শঙ্ক তৈরি হয়েছে। ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি ছাড়ের নির্ধারিত সময় আগামী ডিসেম্বর। কিন্তু সামনে জাতীয় নির্বাচন থাকায় এই সময়ের মধ্যে ষষ্ঠ কিস্তি ছাড় নাও হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ঋণের শর্ত হিসেবে যেসব সংস্কার কর্মসূচি রয়েছে, সেগুলো নির্বাচিত সরকারের সময়ও অব্যাহত থাকবে কিনা, তা নিশ্চিত হতে চাইছে সংস্থাটি। ডিসেম্বরের বদলে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলে পরের কিস্তি ছাড় হতে পারে বলে সংবাদমাধ্যমে আভাস দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। সে ক্ষেত্রে ডিসেম্বরে ষষ্ঠ কিস্তি ছাড় না হলে পরে সপ্তমসহ দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে ছাড় হওয়ার আলোচনাও আছে। এর আগে বিনিময় হার ইস্যুতে সমঝোতায় দেরি হওয়ায় চতুর্থ কিস্তির অর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ একসঙ্গে পায় বাংলাদেশ।