Image description

এস আলম গ্রুপের লুটপাটের শিকার গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে বেরিয়ে আসছে নানান অনিয়মের তথ্য। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ২০২৪ সালে ব্যাংকটি পরিচালকদের যাতায়াত খাতেই ব্যয় করেছে প্রায় এক কোটি টাকা। তার আগের বছরও এই ব্যয় ছিল কোটি টাকার ওপরে।

ব্যাংকটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পরিচালকরা ঢাকার বাইরে থাকায় এবং কেউ কেউ বিদেশে থাকায় যাতায়াত খাতে এই অর্থ ব্যয় হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানানো হচ্ছে, মিটিংয়ে অংশগ্রহণের ফি ছাড়া পরিচালকদের অন্য কোনো সম্মানি নেওয়ার সুযোগ নেই। পরিচালকদের যাতায়াত খাতে ব্যাংক কোনো ব্যয় দেখাতে পারে না।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ২০২৪ সালে সমাপ্ত আর্থিক বছরের তথ্য নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। আগামী ২১ সেপ্টেম্বর বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) এই প্রতিবেদন তুলে ধরে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নেওয়া হবে। প্রতিবেদনের একটি কপি ইতোমধ্যে জাগো নিউজের হাতে এসেছে।

 

প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করতে গিয়ে পরিচালকদের পিছনে ব্যাংকটির অস্বাভাবিক অর্থ ব্যয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে পরিচালকদের পিছনে ব্যাংকটির ব্যয় হয়েছে এক কোটি ২৮ লাখ ৪৯ হাজার ৪৮৬ টাকা। এর মধ্যে ফি বাবদ পরিচালকদের দেওয়া হয়েছে ৩৯ লাখ ২৭ হাজার ২শ টাকা। মিটিং বাবদ ব্যয় পাঁচ লাখ ২৪ হাজার ৫২৯ টাকা। আর পরিচালকদের যাতায়াত খরচ দেখানো হয়েছে ৮৩ লাখ ৯৭ হাজার ৭৫৭ টাকা।

আগের বছর অর্থাৎ, ২০২৩ সালে পরিচালকদের পিছনে ব্যাংকটির এক কোটি ২৬ লাখ ৭৮ হাজার ৫২৭ টাকা ব্যয় হয়। এর মধ্যে পরিচালকদের যাতায়াত খাতেই ব্যয় করা হয় এক কোটি ৪ লাখ ১৩ হাজার ৭৬৮ টাকা। এছাড়া ফি বাবদ পরিচালকদের দেওয়া হয় ১৭ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ টাকা এবং মিটিং বাবদ ব্যয় হয় চার লাখ ৮৭ হাজার ১৫৯ টাকা।

২০২৩ ও ২০২৪ সালে পরিচালকদের যাতায়াত খাতে অর্থ ব্যয় হওয়ার কারণ আমাদের পরিচালকরা ঢাকার বাইরে থাকতেন, কেউ কেউ বিদেশে ছিলেন। এ কারণে যাতায়াত খাতে বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে। নিয়মের মধ্যে থেকেই এসব অর্থ ব্যয় করা হয়েছে।- গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের কোম্পানি সচিব মো. মঞ্জুর হোসেন

পরিচালকদের পিছনে অস্বাভাবিক অর্থ ব্যয় করার পাশাপাশি ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) পিছনেও মোটা অংকের অর্থ ব্যয় হয়েছে। ২০২৪ সালে ব্যাংকটির সিইও বেতন-ভাতা বাবদ নিয়েছেন এক কোটি ৬১ লাখ ৩৯ হাজার ৬৮১ টাকা। আগের বছর এই ব্যয় ছিল এক কোটি ৬৪ লাখ ৬২ হাজার ১২৫ টাকা। অর্থাৎ, সিইওর বেতন-ভাতা বাবদ মাসে ব্যাংকটির গড়ে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।

 

শুধু তাই নয়, ব্যাংকটি সমস্যায় পড়লেও সিইও বছরের ব্যবধানে তার মূল বেতন বাড়িয়ে নিয়েছেন। ২০২৩ সালে সিইওকে মূল বেতন বাবদ দেওয়া হয় ৮৩ লাখ ৬০ হাজার ৬২৫ টাকা। অর্থাৎ, মূল বেতন বাবদ মাসে দেওয়া হয় ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৭১৯ টাকা করে। ২০২৪ সালে সিইওর মূল বেতন বাবদ খরচ বেড়ে হয় ৯১ লাখ ১৬ হাজার ৩৭৫ টাকা। অর্থাৎ, মূল বেতন বাবদ মাসে দেওয়া হয়েছে ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৬৯৮ টাকা।

সিইওর পিছনে ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি অন্য কর্মীদের পিছনেও ব্যাংকটির ব্যয় বেড়েছে। ২০২৪ সালে বেতন-ভাতা খাতে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খরচ হয়েছে ২০৫ কোটি ২ লাখ ৫ হাজার ৪৩৩ টাকা। ২০২৩ সালে এ খাতে ব্যয় হয় ১৮০ কোটি ১৫ লাখ ৫৯ হাজার ২০১ টাকা। অর্থাৎ, বছরের ব্যবধানে বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় বেড়েছে ২৫ কোটি টাকা।

পরিচালকদের যাতায়াত খাতে অর্থ ব্যয় করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ এটি করে থাকলে, সেটি অবশ্যই অনিয়ম। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক এ ধরনের অনিয়ম করেছে। শুধু খেলাপি ঋণ এই ব্যাংকগুলোকে মার্জারের দিয়ে নিয়ে গেছে, তা নয়।- বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান

ব্যাংকটির আর্থিক তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২৪ সালে ব্যাংকটির বিনিয়োগ থেকে ৮৪৩ কোটি ১১ হাজার ১৪ টাকা আয় হয়েছে। বিপরীতে আমানতকারীদের মুনাফা দেওয়া হয়েছে এক হাজার ৩৫২ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার ৭৪১ টাকা। ফলে বিনিয়োগজনিত ক্ষতি হয়েছে ৫০৯ কোটি ৬০ লাখ ৯৯ হাজার ৭২৭ টাকা।

এর সঙ্গে অন্য অপারেটিং আয় যোগ করে ব্যাংকটির মোট পরিচালন আয় দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৩৯৮ কোটি ৫৪ লাখ ১৮ হাজার ৬৭ টাকা। পাশাপাশি মোট পরিচালন ব্যয় হয়েছে ৪০৪ কোটি ২৪ লাখ ২১ হাজার ২২৮ টাকা। ফলে ২০২৪ সালে ব্যাংকের প্রভিশন রাখার আগেই লোকসান হয়েছে ৮০২ কোটি ৭৮ লাখ ৩৯ হাজার ২৯৫ টাকা। আর প্রভিশন রাখার পর কর পরবর্তী নিট লোকসান হয়েছে এক হাজার ২৪৬ কোটি ৬১ লাখ ৮২ হাজার ৬৫৫ টাকা।

ঋণের ৯১ শতাংশ খেলাপি

২০২৪ সালে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। বছরটিতে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। খেলাপির হার ৯০ দশমিক ৭২ শতাংশ। এক বছর আগে ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণ ছিল তিন হাজার ২৯৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। খেলাপির হার ছিল ২৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। তার আগে ২০২২ সালে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ, ২০২১ সালে ২ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়।

সম্পদের চেয়ে দায় বেশি

২০২৪ সাল শেষে ব্যাংকটির মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ২২০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। বিপরীতে দায়ের পরিমাণ ২১ হাজার ৩৬৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ২০২৩ সালে ব্যাংকটির ১৭ হাজার ৪২২ কোটি ২০ লাখ টাকা সম্পদের বিপরীতে দায় ছিল ১৮ হাজার ৩২৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা। তবে এর আগে ব্যাংকটির দায়ের চেয়ে সম্পদ বেশি ছিল। ২০২২ সালে ১৫ হাজার ৩৮১ কোটি ৯ লাখ সম্পদের বিপরীতে দায় ছিল ১৪ হাজার ৮৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ২০২১ সালে ১৩ হাজার ২৮১ কোটি ৩ লাখ টাকা সম্পদের বিপরীতে দায় ছিল ১২ হাজার ৫০৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ, বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের তুলনায় দায় বেশি হারে বেড়েছে।

পরিচালকদের যাতায়াত খাতে অস্বাভাবিক অর্থ ব্যয়ের কারণ জানতে চাইলে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের কোম্পানি সচিব মো. মঞ্জুর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০২৩ ও ২০২৪ সালে পরিচালকদের যাতায়াত খাতে অর্থ ব্যয় হওয়ার কারণ আমাদের পরিচালকরা ঢাকার বাইরে থাকতেন, কেউ কেউ বিদেশে ছিলেন। এ কারণে যাতায়াত খাতে বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে। নিয়মের মধ্যে থেকেই এসব অর্থ ব্যয় করা হয়েছে।’

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘মিটিং ফি’র বাইরে পরিচালকদের অন্য কোনো খাতে অর্থ নেওয়ার সুযোগ নেই। মিটিং ফি বাবদ পরিচালকরা সর্বোচ্চ কত টাকা নিতে পারবেন তাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। একটি মিটিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য একজন পরিচালক সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা সম্মানি পাবেন এবং মাসে আটটির বেশি মিটিংয়ের সম্মানি কোনো পরিচালককে দেওয়া যাবে না।’

তিনি বলেন, ‘পরিচালকদের যাতায়াত খাতে অর্থ ব্যয় করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ এটি করে থাকলে, সেটি অবশ্যই অনিয়ম। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক এ ধরনের অনিয়ম করেছে। শুধু খেলাপি ঋণ এই ব্যাংকগুলোকে মার্জারের দিয়ে নিয়ে গেছে, তা নয়। এখানে কোনো ম্যানেজমেন্ট কাঠামো ছিল না। এমন একজনকে এমডি করা হবে, যিনি সব কথার সঙ্গে একমত হবেন। তার নিজস্ব কোনো মতামত নেই। অসংখ্যা পুঞ্জিভূত অনিয়মের ফলফল হলো আজ ব্যাংকগুলো মার্জার হচ্ছে।’

সমস্যায় পড়ার পরও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের এমডির বেতন বাড়ানো হয়েছে এবং তিনি বেতন-ভাতা বাবদ মাসে গড়ে সাড়ে ১৩ লাখ টাকা পান। এটাকে কি আপনারা স্বাভাবিক মনে করেন? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এত টাকা নিতে তিনি কোনোভাবেই পারেন না। তাদের আয়ের সঙ্গে এটা তো কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ না। কিন্তু এগুলো তাদের পর্ষদ থেকেই সব সময় অনুমোদন হয়ে আসছে।’