
রপ্তানি বাণিজ্যে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন, ভারত, ভিয়েতনামসহ কয়েকটি দেশে আমেরিকার পাল্টা শুল্কারোপ বাংলাদেশের জন্য নতুন এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। মূল্য প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ এখন তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানি খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে আগামী পাঁচ বছরে রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এজন্য প্রয়োজন সঠিক নীতি সহায়তা ও জ্বালানি নিরাপত্তায় জরুরি উদ্যোগ।
তবে নতুন করে শিল্পে শ্রম অসন্তোষের মাধ্যমে অস্থিরতা উসকে দেওয়া, জ্বালানি নিরাপত্তায় কার্যকর উদ্যোগের অভাব এবং চট্টগ্রাম বন্দরে বাড়তি চাপ সামাল দেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় বাংলাদেশ আদৌ সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর অবশ্য আশা করছেন, উদ্যোক্তাদের নীতি সহায়তা বাড়িয়ে সামনের যে কোনো সুযোগ ধরতে পাশে থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংক। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম মনিরুজ্জামানও জানান, ট্রাম্পের শুল্কনীতিতে বাংলাদেশের সম্ভাব্য লাভজনক অবস্থান মাথায় রেখে বাণিজ্যিক চাপ মোকাবিলায় রাতারাতি কিছু জরুরি সংস্কার শুরু করা হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে দ্রুত শিল্পে বাড়তি গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহের।
সুযোগের সদ্ব্যবহারে ইপিবির উদ্যোগ
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নতুন সুযোগ কাজে লাগাতে ইতোমধ্যেই উদ্যোগ নিয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। তারা সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে নীতি সহায়তা বাড়িয়ে দ্রুত জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার। ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন আমার দেশকে জানান, আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রায় ১৮ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে আসে। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় ছিল ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার, যেখানে আমেরিকা থেকে এসেছে প্রায় ৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।
ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান জানান, যেসব শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে অথচ মেশিনারিজসহ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে, এগুলো দ্রুত উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা এবং শিল্পে আগামী কয়েক মাস অন্তত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহ করে ক্রেতাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার। এ নিয়ে কাজ করছে ইপিবি। তিনি আরো বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন খরচ এখন পর্যন্ত অনেক কম। এখন নীতি সহায়তা বাড়িয়ে শিল্প কারখানাগুলোকে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করতে পারলে রপ্তানি খাতে বড় সফলতা আসবে।
উৎপাদন ও পরিবহন খরচ সর্বনিম্ন
সস্তা শ্রম ও তুলনামূলক কম পরিবহন খরচের কারণে পোশাক রপ্তানিতে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক একটি আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা গেছে, ১০০টি টি-শার্ট উৎপাদন ও পরিবহনের মোট খরচ বাংলাদেশে মাত্র ৮ দশমিক ৫৫ ডলার, যা বিশ্বের যে কোনো বড় পোশাক উৎপাদক দেশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
তুলনামূলকভাবে পাকিস্তানে একই পরিমাণ টি-শার্ট উৎপাদন ও পরিবহন খরচ পড়ে প্রায় ১১ ডলার, ভারতে ১৩ দশমিক ১৫ ডলার, ভিয়েতনামে ১৫ দশমিক ৮৭ ডলার, চীনে ১৯ দশমিক ৮ ডলার এবং মেক্সিকোতে ২৪ দশমিক ৭৭ ডলার। আর যুক্তরাষ্ট্রে এই খরচ গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১২০ ডলারে। এই পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় প্রায় ৯৩ শতাংশ কম।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশে এই খরচ কম থাকার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে শ্রমিকদের কম মজুরি, দক্ষ শ্রমিক বাহিনী এবং সরকারের পক্ষ থেকে পোশাক খাতকে দেওয়া বিভিন্ন প্রণোদনা। বর্তমানে বাংলাদেশে একটি গার্মেন্টস শ্রমিকের গড় মাসিক মজুরি ১০০ ডলারেরও কম, যা প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
পাশাপাশি, তৈরি পোশাকশিল্পে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শ্রমিকদের সহজলভ্যতা উৎপাদনের গতি ও গুণমান নিশ্চিত করেছে। এছাড়া দেশের পোশাকশিল্পে এখন বেশির ভাগ কাঁচামাল দেশেই উৎপাদিত হওয়ায় আমদানি নির্ভরতা হ্রাস পেয়েছে, ফলে উৎপাদন সময় ও খরচ দুই-ই কমেছে। সরকার রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে তৈরি পোশাকশিল্পে করছাড়, নগদ সহায়তা এবং অবকাঠামোগত সুবিধা দেওয়ায় দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের আগ্রহও বেড়েছে।
বিশ্বের শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলো এখন চীন, মেক্সিকো বা ভিয়েতনামের মতো তুলনামূলক ব্যয়বহুল দেশগুলোর পরিবর্তে বাংলাদেশকে তাদের পণ্য উৎপাদনের গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ যদি প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন এবং শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে, তবে ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে বাজার দখল করা সম্ভব হবে।
আয় বাড়ছে আমেরিকায়
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান আমার দেশকে জানান, আমরা আগামী এক বছর যদি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ পাই তবে আমেরিকার বাজারে একক আধিপত্য ধরে রাখতে পারবে বাংলাদেশ। কয়েক মাস ধরেই আমেরিকায় আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ছে। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে আমাদের বড় প্রতিযোগী চীন ও ভিয়েতনাম এখন চাপের মধ্যে আছে। সেই সঙ্গে ভারত বাড়তি শুল্ক দিয়ে বেশি সুবিধা আদায় করতে পারবে না।
চলতি বছরের জানুয়ারি-জুনে আমেরিকার বাজারে রপ্তানি পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তিনি জানান, এ সময় চীনের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ শতাংশ। ভিয়েতনামের রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮ শতাংশ। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, পাকিস্তানের রপ্তানি বাড়লেও, বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে ছিল। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে সর্বোচ্চ ২৫ দশমিক ১২ শতাংশ। আগের বছরের তুলনায় দেশটিতে আমাদের রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। শুধু ২০২৫ সালের মে মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৫৪৭ দশমিক ৪২ মিলিয়ন ডলার, আর জুন মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭২৩ দশমিক শূন্য ৮ মিলিয়ন ডলারে, যা মাসওয়ারি হিসাবে ৩২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে যদি সরকার উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়ায়।
বিচ্ছিন্ন করতে হবে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ
সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড পিস স্টাডিজ (সিএসপিএস)-এর নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মিজানুর রহমান আমার দেশকে বলেন, আমেরিকার বাজারে আমাদের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তা কাজে লাগাতে জরুরি ভিত্তিতে তিনটি উদ্যোগ নিতে হবে। শিল্পে আগামী কয়েক মাস নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস দিতে হবে। এজন্য গ্যাসের হাজার হাজার অবৈধ সংযোগ এখনই বিচ্ছিন্ন করা উচিত। তিনি মনে করেন, বাসাবাড়িতে ঢালাওভাবে গ্যাস না দিয়ে রেশনিং পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। যেসব শিল্প মালিক হাসিনার পতনের পর পলাতক বা কারাগারে আছেন, তাদের শিল্প ইউনিটগুলো সরকার দায়িত্ব নিয়ে চালু করতে পারে। এতে চাহিদা অনুযায়ী রপ্তানি আদেশ ধরে রাখা সম্ভব হবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির জন্য বন্দরে আলাদা জেটি নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে বন্দরের কিছু জেটি ভারতের জন্য বরাদ্দ ছিল।
তিনি আরো বলেন, ব্যাংক খাতে এখন শুধু অর্থ আদায়ের চাপ চলছে। নতুন ঋণ যেমন দেওয়া হচ্ছে না, তেমনি ৯ মাসের বদলে মাত্র তিন মাসেই উদ্যোক্তাদের খেলাপির তালিকায় ফেলা হচ্ছে। এভাবে রাতারাতি আইন পরিবর্তন করে দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান হয় না। যেহেতু কিছু সুযোগ সামনে এসেছে, সেগুলো আগে কাজে লাগাতে হবে।
উচ্চপর্যায়ের কমিটির প্রস্তাব
বাংলাদেশ নিটওয়্যার শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গ্যাসের সংকট দীর্ঘদিনের। এই সংকট কাটাতে এখনই উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা জরুরি।
তিনি দাবি করেন, বাসাবাড়িতে কয়েক লাখ অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে। এগুলো বিচ্ছিন্ন করলে শিল্পে গ্যাস সংকট অনেকটাই কেটে যাবে। সেই সঙ্গে যেসব কারখানা বন্ধ হয়ে আছে, সেগুলো চালু করে দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে বিগত সরকারের সুবিধাভোগী কেউ থাকলে তাদের কারখানা সরকার বিশেষ ব্যবস্থায় চালু করতে পারে।
তিনি অভিযোগ করেন, পোশাক খাতে নতুন করে শ্রমিক অসন্তোষ উসকে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কিন্তু এ সময় যদি নতুন করে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়, তবে আমেরিকা আমাদের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা ভেস্তে যেতে পারে।
নতুন ক্রেতা আসছে বাংলাদেশে
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি খন্দকার বেলায়েত হোসেন জানান, ইতোমধ্যে বায়াররা বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ শুরু করেছে। তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, ইউটিলিটি সার্ভিসের অবস্থা, উদ্যোক্তাদের আন্তরিকতা এবং বন্দরের সক্ষমতা সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। প্রচলিত বায়াররা আগের তুলনায় অর্ডার বাড়িয়েছে। এখনো বিস্তারিত কিছু বলার সময় আসেনি, তবে বলা যায় রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের সুখবর আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
বেলায়েত আরো বলেন, আমরাও বায়ারদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছি। নতুন কোনো বায়ার এলে তার অতীত ইতিহাস যাচাই করে তবেই অর্ডার নিতে উদ্যোক্তাদের অনুরোধ জানানো হয়েছে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে। কারণ অতীতে বিভিন্ন কারণে অনেক বায়ার বাংলাদেশে এসেছে, যাদের কেউ কেউ অর্ডার দিয়ে পণ্য নেয়নি, আবার কেউ পণ্য প্রস্তুতের পর বড় ডিসকাউন্ট দাবি করে অনেক প্রতিষ্ঠানকে বিপদে ফেলেছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছে উদ্যোক্তাদের।
বিজিএমইএর আরেক সাবেক সহসভাপতি খন্দকার রকিবুল আলম চৌধুরী জানান, সবদিক বিবেচনায় বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম। তাই ভিয়েতনামের উদ্যোক্তারা কী কী সুবিধা ভোগ করছেন, তা বাংলাদেশকে নজরে রাখতে হবে। এখানেই অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। যেমন- বাংলাদেশের যে কোনো ইপিজেড থেকে একটি মেশিনারি নিজের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নিতে চাইলে দাপ্তরিক অনুমতির জন্য অন্তত ১০ কর্মদিবস সময় লাগে। অন্যদিকে, এই সময়ের মধ্যে ভিয়েতনামের যে কোনো প্রতিষ্ঠান চীন থেকে নতুন মেশিনারি আমদানি করতে পারে। যে কোনো এফওসি (ফ্রি অব চার্জ) কনটেইনার বাংলাদেশের জলসীমায় পৌঁছানোর পর বন্দর থেকে ডেলিভারি পেতে সময় লাগে অন্তত সাত থেকে আট দিন। কিন্তু ভিয়েতনামের আমদানিকারকরা মাত্র দুই দিনের মধ্যে সেই কনটেইনার নিজেদের ওয়্যারহাউজে (গুদাম) নিয়ে যেতে পারে।
বন্ড সুবিধার আওতায় পণ্যের ক্ষেত্রে সামান্য একটি এইচএস কোডে ভুল থাকলে দিনের পর দিন ঘুরতে হয় কাস্টমস কর্মকর্তাদের টেবিলে টেবিলে। অথচ চাইলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ রপ্তানির আগেই ভুল সংশোধন করে পণ্য ছাড় করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, এই ছোট ছোট প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারলে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা তাদের অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে ট্রাম্পের শুল্কনীতির সুবিধা সহজেই ধরতে পারবে।
কতটা প্রস্তুত চট্টগ্রাম বন্দর
ট্রাম্পের শুল্কনীতির সুবিধা বাংলাদেশের পক্ষে গেলে আমদানি ও রপ্তানির চাপ অস্বাভাবিকভাবে বাড়বে। কারণ রপ্তানি পণ্যের জন্য অধিকাংশ কাঁচামাল বন্ড সুবিধায় তৃতীয় কোনো দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে বড় ধরনের চাপ পড়বে চট্টগ্রাম বন্দরে।
বন্দর ব্যবহারকারীদের দাবি—বর্তমান অবকাঠামোতেই চলমান সমুদ্র বাণিজ্যের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। এর ওপর অতিরিক্ত চাপ এলে তা সামলানো কঠিন হবে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করছে।
বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম মনিরুজ্জামান জানান, লালদিয়ার চর টার্মিনাল, বে টার্মিনাল ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প চালু হয়েছে। ২০৩০ সালের আগে-পরে সবগুলো বন্দর একসঙ্গে অপারেশনে আসবে।
তবে ট্রাম্পের শুল্কনীতিতে বাংলাদেশের সম্ভাব্য লাভজনক অবস্থান মাথায় রেখে বাণিজ্যিক চাপ মোকাবিলায় রাতারাতি কিছু জরুরি সংস্কার শুরু করা হয়েছে। বন্দরের প্রধান টার্মিনাল এনসিটিকে বেসরকারি অপারেটরদের হাত থেকে সরিয়ে সরাসরি নৌবাহিনীর মাধ্যমে পরিচালনার উদ্যোগের ফলে একটি টার্মিনালেই প্রায় ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এতে বন্দরে জাহাজের টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম কমে এসেছে ১১ থেকে ১৩ ঘণ্টায়। এছাড়া বেশ কিছু পণ্য ডেলিভারির জন্য অফডকে পাঠিয়ে দেওয়ায় বন্দরের ভেতরের জায়গা বেড়েছে। দীর্ঘদিন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে থাকা প্রায় ১০ হাজার অকশনযোগ্য কনটেইনারের নিলাম প্রক্রিয়া শুরু করেছে কাস্টমস। শেডে পড়ে থাকা স্ক্র্যাপ গাড়িগুলোও সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
বন্দরের চেয়ারম্যান আরো বলেন, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পুরোদমে চালু করতে অপারেটর প্রতিষ্ঠানকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এক্স-ওয়াই শেডকেও বন্দরের কাজে লাগানোসহ অপারেশনকে আরো সহজ ও কার্যকর করতে নানা আনুষঙ্গিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তরিকতায় এসব উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়ন হচ্ছে। পরিকল্পনাগুলো সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে বর্তমান অবকাঠামোতেই ঊর্ধ্বমুখী আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের চাপ সামলানো সম্ভব হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক পরিকল্পনা ও প্রশাসন বিভাগের সদস্য জাফর আলম বলেন, বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হলে সংস্কার কার্যক্রমকে দুই ভাগে ভাগ করতে হবে—একটি বন্দরের অভ্যন্তরে, অন্যটি বন্দরের বাইরে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, বন্দরে খালাস হওয়া ৭২ শতাংশ কনটেইনারের গন্তব্য রাজধানী ঢাকা, যা বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে পরিবহন করা হয়। বাকিটা যায় রেল ও নৌপথে। সড়কপথের চাপ কমিয়ে রেল ও নৌপথে কনটেইনার পরিবহন বাড়াতে হবে। এর জন্য পানগাঁও বন্দরকে আরো ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। অফডকের ব্যবহার বৃদ্ধি, এলসিএল পণ্য ডেলিভারি বন্দরের সীমানার বাইরে নিয়ে যাওয়া, অকশনযোগ্য কনটেইনার দ্রুত অপসারণ এবং কাস্টমস কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা থাকলে—বর্তমান অবকাঠামোতেই কমপক্ষে ৩৫ শতাংশ সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত।
আসছে চীনা বিনিয়োগ
চীনা কোম্পানি হান্ডা কোম্পানি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপনের জন্য প্রায় চার কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। এ জন্য গত ৩০ জুলাই বাংলাদেশ বেপজার সঙ্গে জমি ইজার চুক্তি করেছে হান্ডা।
এ ছাড়া চীনের তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান খাইশি গ্রুপ চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করবে। প্রতিষ্ঠানটি চার কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করে অন্তর্বাসসহ অন্যান্য পোশাক উৎপাদনের কারখানা করবে। এ জন্য বেপজার সঙ্গে চুক্তি করেছে খাইশি গ্রুপ।
জানা যায়, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৩৪টি চীনা বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে বেপজা। গত জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত আটটি চীনা প্রতিষ্ঠান শিল্প স্থাপনের লক্ষ্যে বেপজার সঙ্গে চুক্তি করেছে। তাদের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ১৫ কোটি ডলার। এসব কোম্পানি তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ব্যাগ, হালকা প্রকৌশল পণ্য ইত্যাদি উৎপাদন করবে।
রপ্তানি খাতের উদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী এক বছর শিল্প খাত যদি নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সুবিধা পায়, তবে দেশের রপ্তানি আয় কয়েক বছরেই শত বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। এজন্য এখনই সরকারকে নীতি সহায়তা ও প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ কার্যকর করার কথা বলেছেন তারা।