Image description

বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে মার্কিন প্রশাসন। গত ২ এপ্রিল বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের জন্য শুল্কহার হবে ৩৭ শতাংশ। পরে ৮ জুলাই তা কিছুটা কমিয়ে করা হয় ৩৫ শতাংশ। আর ৩১ জুলাই চূড়ান্তভাবে ২০ শতাংশ শুল্কহার নির্ধারণ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে বাংলাদেশ আপাতত খুশি। স্বস্তি এসেছে অনেকটা। তারপরও প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কি জিতল না হারল?

তার আগে জেনে নেওয়া যাক কোন দেশের ওপর কত হারে শুল্কহার আরোপ করা হলো।

কোন দেশের ওপর কত শুল্ক

যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাল্টা শুল্ক আরোপ–সংক্রান্ত যে নির্বাহী আদেশ জারি করেছে, সেখানে কোন দেশের ওপর কত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, তার একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী মোট ৬৯টি দেশ ও অঞ্চল যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কনীতির আওতায় পড়েছে। এর মধ্যে দেশের সংখ্যা ৬৬। তালিকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য দুটি পৃথক হারভিত্তিক শ্রেণি এবং সবচেয়ে ছোট অঞ্চল হিসেবে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জকে অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়েছে।

এখন দেখা যাক শুল্কহার অনুযায়ী কোন দেশ কোন শ্রেণিতে পড়ছে।

১০ শতাংশ শুল্ক: তিনটি দেশের ওপর ১০ শতাংশ হারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। যেমন ব্রাজিল, ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ ও যুক্তরাজ্য।

এর বাইরে তালিকায় যেসব দেশের নাম নেই, তাদের সবার ওপরেই ১০ শতাংশ হারে শুল্কহার ধার্য করা হয়েছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, এসব দেশ তাদের সঙ্গে ন্যায্য বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে।

১৫ শতাংশ শুল্ক: সর্বোচ্চসংখ্যক দেশের ওপর বসানো হয়েছে ১৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক। এ রকম দেশের সংখ্যা ৩৯। যেমন আফগানিস্তান, অ্যাঙ্গোলা, বলিভিয়া, বতসোয়ানা, ক্যামেরুন, চাদ, কোস্টারিকা, আইভরি কোস্ট, কঙ্গো (ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক), ইকুয়েডর, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, ফিজি, ঘানা, গায়ানা, আইসল্যান্ড, ইসরায়েল, জাপান, জর্ডান, লেসোথো, লিচেনস্টাইন, মাদাগাস্কার, মালাউই, মরিশাস, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, নাউরু, নিউজিল্যান্ড, নাইজেরিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, নরওয়ে, পাপুয়া নিউগিনি, দক্ষিণ কোরিয়া, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, তুরস্ক, উগান্ডা, ভানুয়াতু, ভেনেজুয়েলা, জাম্বিয়া এবং জিম্বাবুয়ে।

এ ছাড়া ১৫ শতাংশ শুল্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য প্রযোজ্য হবে। এর একটি ব্যাখ্যা আছে। যেমন যেসব ইউরোপীয় পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই কম শুল্ক (১৫ শতাংশের নিচে) নিচ্ছিল, তাদের ওপর এখন এমনভাবে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, যাতে মোট শুল্কহার হয় ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য প্রযোজ্য শুল্কহার হচ্ছে ১৫ শতাংশ।

১৮ শতাংশ শুল্ক: কেবল একটি দেশের জন্য এই হার আরোপ করা হয়েছে। দেশটি হচ্ছে নিকারাগুয়া।

১৯ শতাংশ শুল্ক: ৬টি দেশ এই শ্রেণিতে রয়েছে। যেমন কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ড।

২০ শতাংশ শুল্ক: বাংলাদেশসহ আরও তিনটি দেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। অন্য তিন দেশ হলো, শ্রীলঙ্কা, তাইওয়ান ও ভিয়েতনাম।

২৫ শতাংশ শুল্ক: এই তালিকায় আছে ৫টি দেশ। যেমন ব্রুনেই, ভারত, কাজাখস্তান, মলদোভা ও তিউনিসিয়া।

৩০ শতাংশ শুল্ক: চারটি দেশের ওপর ৩০ শতাংশ হারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। যেমন আলজেরিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, লিবিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা।

৩৫ শতাংশ শুল্ক: তালিকায় আছে দুটি দেশ। যেমন ইরাক ও সার্বিয়া।

৩৯ শতাংশ শুল্ক: মাত্র একটি দেশ, সুইজারল্যান্ড।

৪০ শতাংশ: মিয়ানমার, লাওস।

৪১ শতাংশ শুল্ক: সিরিয়া।

তাহলে বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্রটা কেমন হলো?

বাংলাদেশ কী পেল

যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৮৪৪ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে দেশটি। এসব পণ্যের ওপর দেশটি শুল্ক আদায় করেছে ১২৭ কোটি ডলার।

ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। ৭ আগস্ট ২০২৫ থেকে এই শুল্ক কার্যকর হচ্ছে। আগের গড় শুল্কহার ছিল ১৫ শতাংশ, নতুন শুল্কসহ গড় হার হবে ৩৫ শতাংশ। তবে পণ্যভেদে শুল্কহার আলাদা হবে। কারণ, মোস্ট ফেডারড নেশন বা এমএফএন অনুযায়ী পণ্যভেদে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব হার শূন্য থেকে ৩৫০ শতাংশ পর্যন্ত।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের গড় কার্যকর শুল্ক ২০২৫ সালের ১ জুন পর্যন্ত ছিল ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ, নতুন শুল্ক কার্যকর হলে তা ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।

পোশাক খাত: ২০২৪ সালে গড় শুল্কহার ছিল ১৬.৭৭ শতাংশ, পাল্টা ২০ শতাংশ শুল্ক যুক্ত হলে নতুন গড় কার্যকর শুল্ক দাঁড়াবে ৩৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ। পোশা ভেদে উদাহরণ হচ্ছে:

  • ম্যানমেইড ফাইবার সোয়েটার: আগের শুল্ক ৩২ শতাংশ, নতুন মোট শুল্ক ৫২ শতাংশ।

  • তুলার সুতা দিয়ে তৈরি সোয়েটার: আগের শুল্ক ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ, নতুন মোট শুল্ক ৩৬ দশমিক ৫০ শতাংশ।

  • সুতার কাপড়ে তৈরি ছেলেদের আন্ডারপ্যান্ট: আগের শুল্ক ৬ শতাংশ, নতুন মোট শুল্ক ২৬ শতাংশ।

  • নিম্নশুল্কবিশিষ্ট পোশাক (যেমন ১ শতাংশ): নতুন মোট শুল্ক হবে ২১ শতাংশ।

  • জুতা: ২০২৪ সালে গড় শুল্কহার ছিল ৮ দশমিক ৫ শতাংশ, পাল্টা শুল্কসহ গড় মোট শুল্ক ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ, পণ্যভেদে শুল্কহার শূন্য থেকে ৫৫ শতাংশ।

  • হ্যাটস ও হেডগিয়ার: আগের গড় শুল্কহার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, পাল্টা শুল্কসহ নতুন গড় হার ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ, পণ্যভেদে শুল্ক শূন্য থেকে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ।

  • চামড়াজাত পণ্য আগের গড় শুল্কহার: ১২ দশমিক ২০ শতাংশ, নতুন গড় হার: ৩২ দশমিক ২০ শতাংশ, পণ্যভেদে হার শূন্য থেকে ২০ শতাংশ।

  • চামড়ার হাতব্যাগ: আগের শুল্ক ৯ শতাংশ, নতুন মোট শুল্ক ৩১ শতাংশ।

এখন প্রশ্ন হলো, মার্কিন প্রশাসন কিসের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন দেশের ওপর ভিন্ন ভিন্ন শুল্ক আরোপ করল।

একটি নির্বাহী আদেশে সই করার পর সেটি দেখাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
একটি নির্বাহী আদেশে সই করার পর সেটি দেখাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পছবি: রয়টার্স

হোয়াইট হাউস কী বলে

ট্রাম্প প্রশাসন কিসের ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্কহার নির্ধারণ করেছে, তার কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছে। এ নিয়ে গত ৩১ জুলাই হোয়াইট হাউস একটি ফ্যাক্টশিট প্রকাশ করেছে। সেখানে প্রথম শুল্ক আরোপ ও পরবর্তী সময়ে নতুন নেওয়া সিদ্ধান্তের পটভূমি জানানো হয়েছে। যেমন হোয়াইট হাউস বলেছে, ‘২ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেন, যুক্তরাষ্ট্র সব দেশের ওপর ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করবে। পাশাপাশি যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাণিজ্যঘাটতি রয়েছে, তাদের ওপর দেশভেদে আরও বেশি হারে শুল্ক আরোপ করা হবে, যা কার্যকর হয়েছে ৯ এপ্রিল।

হোয়াইট হাউসের ভাষায়, ‘এরপর অনেক কিছু ঘটেছে। যেমন:

  • কিছু দেশ ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা চুক্তি করেছে, অথবা তা করতে চলেছে।

  • কিছু দেশ চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছে, তবে প্রেসিডেন্ট মনে করেন, তাদের প্রস্তাব জাতীয় জরুরি পরিস্থিতির সমাধানে যথেষ্ট নয়।

  • কিছু দেশ একেবারেই আলোচনা করেনি।

তারপর হোয়াইট হাউস জানাচ্ছে, ‘এই নতুন তথ্য, প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পরামর্শ এবং অন্যান্য বিষয়ের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট নির্ধারণ করেছেন যে বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্কহার পরিবর্তন করা এখন প্রয়োজন ও যুক্তিসংগত।’

এরপরই কোন দেশের ওপর কত হারে শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে, তা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে হোয়াইট হাইসের ফ্যাক্টশিটের কয়েকটি বাক্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। যেমন এখানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা চুক্তির কথা বলা হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের জন্য কেন বিভিন্ন হারে শুল্ক নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসন ‘পারস্পরিকতা (রেসিপ্রোসিটি)’ নীতির কথা বলেছে। অর্থাৎ যে দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে উচ্চ শুল্ক বা বাধা আরোপ করে, তাদের পণ্যের ওপরও সমপর্যায়ের শুল্ক চাপিয়ে দেওয়া। মূলত কোনো দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত না থেকে ঘাটতি আছে কি না, সেই ভিত্তিতে শুল্কের প্রাথমিক হার নির্ধারিত হয়েছে।

মূলত নির্বাহী আদেশে দুটি স্তর রাখা হয়েছে। যেমন একটি হচ্ছে যাদের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ন্যায্যতার ভিত্তিতে পরিচালিত, তাদের জন্য ১০ শতাংশ শুল্কহার। বাকি সবাই ১৫ শতাংশ বা তার বেশি। অর্থাৎ এসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি আছে, যারা মার্কিন পণ্যে তুলনামূলক উচ্চ শুল্ক আরোপ করে রেখেছে, তাদের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা। ১৫ শতাংশ বা এর চেয়ে শুল্কহার নির্ধারণ করা হয়েছে বিভিন্ন দেশের আচরণ ও আলোচনার অগ্রগতির ভিত্তিতে। কারও কারও মতে, আসলে প্রতিটি দেশ নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে মুহূর্তে যা উপযুক্ত মনে করেছেন, সে অনুযায়ী শুল্কহার নির্ধারিত হয়েছে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, হোয়াইট হাউস মূলত তিন ধরনের ক্যাটাগরি করে তারপরই শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করা যাক।

১. যারা ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা চুক্তি করেছে বা করতে চলেছে:

হোয়াইট হাউস ফ্যাক্টশিটে উল্লেখ আছে যে তারা সম্ভবত চুক্তির শীর্ষে পৌঁছাচ্ছে বা ইতিবাচক আলোচনায় আছে এবং অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বিত হচ্ছে। উদাহরণও দেওয়া আছে ফ্যাক্টশিটে। যেমন

  • ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ): ইতিমধ্যে বড় ব্যবসায়িক ও নিরাপত্তা চুক্তি হয়েছে। ১৫ শতাংশ শুল্ক হার নির্ধারণ করা হয়েছে।

  • জাপান: যুক্তরাষ্ট্র ৫৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ ও কৌশলগত চুক্তিতে এসেছে। জাপানের শুল্কহারও ১৫ শতাংশ।

  • ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম: ইইউ ও জাপানের মতো চুক্তি বা আলোচনায় এগিয়ে; শুল্ক ১৫–২০ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছে।

২. যারা চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছে, তবে প্রেসিডেন্ট মনে করেন, তাঁর প্রস্তাব জাতীয় জরুরি পরিস্থিতির সমাধানে যথেষ্ট নয়:

এই দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনাপূর্ণ হলেও হোয়াইট হাউস অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট সেই প্রস্তাবগুলোকে জাতীয় জরুরি সমাধানে পর্যাপ্ত বলে মনে করেননি। কিছু দেশ যাদের নাম ফ্যাক্টশিটে সরাসরি বলা হয়নি, তারা আলোচনায় ছিল, কিন্তু পর্যাপ্ত সমন্বয় হয়নি। যেমন ভারতের সঙ্গে লম্বা সময় ধরে আলোচনা হলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তা মেনে নেননি।

৩. যারা একেবারেই আলোচনা করেনি:

এই দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়নি, কোনো আগ্রহও দেখায়নি। তাই তারা সর্বোচ্চ শুল্কের আওতায় এসেছে। যেমন সিরিয়া, মিয়ানমার, লাওস। এসব দেশের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি, তাই সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক ধার্য হয়েছে।

ওয়াশিংটনে পাল্টা শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দলের প্রথম দিনের আলোচনা
ওয়াশিংটনে পাল্টা শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দলের প্রথম দিনের আলোচনাছবি: বাংলাদেশ দূতাবাস ওয়াশিংটন ডিসির সৌজন্যে

বাংলাদেশ কোন শ্রেণিতে

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ প্রথম ক্যাটাগরিতে পড়েনি। এটা ঠিক যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করবে। এ নিয়ে আলোচনাও করছে। তবে সেই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি সন্তুষ্ট হলে শুল্কহার হতো ১০ বা ১৫ শতাংশ। আবার একেবারেই আলোচনা করেনি, এই তালিকায়ও বাংলাদেশ নেই। সুতরাং হোয়াইট হাউসের ফ্যাক্টশিট অনুযায়ী বাংলাদেশ সম্ভবত পড়েছে দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে। অর্থাৎ কিছু দেশ চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছে, তবে প্রেসিডেন্ট মনে করেন, তাদের প্রস্তাব জাতীয় জরুরি পরিস্থিতির সমাধানে যথেষ্ট নয়। তবে এটা ঠিক, আলাদা করে বাংলাদেশের ওপর শাস্তিমূলক কোনো শুল্ক আরোপ করা হয়নি।

বাংলাদেশ কেন স্বস্তিতে

বাংলাদেশ মূলত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানি সবচেয়ে বেশি করে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির একক শীর্ষ বড় বাজার। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এটি দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশের কিছু বেশি। আর এই দেশটিতে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৬ শতাংশের বেশি হচ্ছে তৈরি পোশাক। সুতরাং বাংলাদেশ বেশি চিন্তিত তৈরি পোশাকের বাজার নিয়েই।

এ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ স্বস্তিতে আছে। কারণ, প্রতিযোগী দেশগুলো সবাই বাংলাদেশের কাছাকাছি অবস্থানেই আছে। যেমন পাকিস্তান ও কম্বোডিয়ার ওপর আরোপ করা শুল্কহার হচ্ছে ১৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ এবং ভারত আরও বেশি, ২৫ শতাংশ। সুতরাং কোনো একটি দেশ বিশেষ সুবিধা পাবে এমনটি নয়; বরং ভারত বেশ বিপাকেই আছে। কেননা, ভারতের ওপর অতিরিক্ত আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

দেশটির অন্যতম সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া গত ৩১ জুলাই এক প্রতিবেদনে বলেছে, শুল্ক বাড়লে এর প্রভাব খাতভেদে আলাদা হবে। বিশেষ করে শ্রমনির্ভর খাতগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকবে। এর মধ্যে রয়েছে পোশাক ও টেক্সটাইল, চামড়া ও নন-চামড়াজাত জুতা, রত্ন ও গয়না ও কার্পেট ও হস্তশিল্প।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ে বাংলাদেশের অন্যতম বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার জাতীয় দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসে ২ আগস্ট লিখেছেন, পাকিস্তান সামান্য ভালো চুক্তি পেয়েছে, ১৯ শতাংশ। সম্ভবত দক্ষিণ পাকিস্তানের উপকূলে একটি অজানা মার্কিন তেল কোম্পানিকে অফশোর তেল অনুসন্ধানের একচেটিয়া অধিকার দেওয়ার প্রস্তাবের কারণে। আর মাসের পর মাস আলোচনা করেও ভারত ২৫ শতাংশ শুল্ক পেয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো, তারা কৃষি ও দুগ্ধ খাতকে উন্মুক্ত করতে দীর্ঘদিন ধরে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে—এই খাতে ভারতের গড় শুল্ক ৪০ শতাংশ। সুতরাং তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ একটি মোটামুটি ভালো চুক্তি পেয়েছে, যদিও এটি অসাধারণ নয়।

ড. জায়েদি সাত্তারের আরেকটা বিশ্লেষণ হচ্ছে,

• একটি বেসলাইন (ন্যূনতম) শুল্কহার ১০ শতাংশ যুক্তরাজ্য ও ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে প্রযোজ্য।

  • ১৫ শতাংশ শুল্ক প্রধানত আফ্রিকার দেশগুলোর ক্ষেত্রে এবং কিছু দেশ যাদের অর্থনীতি বেশ উন্মুক্ত বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে (আবশ্যিকভাবে মিত্র না হলেও)। যেমন তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও নিউজিল্যান্ড।

  • ১৯-২০ শতাংশ শুল্ক সেই দেশগুলোতে প্রযোজ্য, যারা আলোচনায় আগ্রহ দেখিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে শূন্য-শুল্ক সুবিধা ও মার্কিন পণ্যের আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। ১৯ শতাংশ হার দেওয়া হয় ‘মিষ্টি প্রণোদনা’ হিসেবে, যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে অতিরিক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে।

  • ২৫-৩০ শতাংশ শুল্ক (ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা) শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মতো, যখন কোনো চুক্তি হয়নি বা কিছু অমীমাংসিত ভূরাজনৈতিক সমস্যা আছে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, তুলনামূলকভাবে ২০ শতাংশ শুল্কহার বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থা থাকছে।

বিনিময়ে বাংলাদেশকে কী দিতে হবে

বাংলাদেশকেও এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। এর আগে ইইউ, যুক্তরাজ্য, ইন্দোনেশিয়া ও জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করেছে। হোয়াইট হাউস সেসব চুক্তিতে কী কী আছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশও করেছে।

যেমন গত ২২ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্দোনেশিয়া যে বাণিজ্যচুক্তি সই, করেছে তা ফ্যাক্টশিট আকারে হোয়াইট হাউস তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। যেমন সেখানে বলা হয়েছে,

‘প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক পারস্পরিক বাণিজ্যচুক্তি ঘোষণা করেছেন। এই চুক্তির অধীনে ইন্দোনেশিয়া যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে ১৯ শতাংশ শুল্ক দেবে, আর যুক্তরাষ্ট্রের ৯৯ শতাংশ পণ্যে ইন্দোনেশিয়া শুল্ক তুলে দেবে।

চুক্তি অনুযায়ী, কৃষি, স্বাস্থ্য, সামুদ্রিক মাছ, প্রযুক্তি, গাড়ি, রাসায়নিকসহ সব খাতের মার্কিন পণ্য শুল্কমুক্ত বা শুল্ক হ্রাস সুবিধা পাবে। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া স্থানীয় কনটেন্ট শর্ত, প্রি-শিপমেন্ট চেক, অতিরিক্ত সার্টিফিকেশন ও লেবেলিংয়ের মতো অ-শুল্ক বাধা তুলে দেবে। কৃষি খাতে মার্কিন পণ্য আমদানিতে সব লাইসেন্স শর্ত বাতিল হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাংস, পোলট্রি ও দুগ্ধজাত পণ্যের কারখানাগুলোর তালিকা সরাসরি গ্রহণ করবে।

এ ছাড়া ডিজিটাল বাণিজ্যে শুল্কমুক্ত নীতি, তথ্য স্থানান্তরে স্বাধীনতা, ডব্লিউটিওতে সেবা খাত সংস্কার সমর্থন এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজসহ সব শিল্পপণ্যে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। শ্রমমান উন্নয়নে জোরপূর্বক শ্রম নিষিদ্ধ করা ও শ্রমিকদের সংগঠন অধিকার নিশ্চিতের অঙ্গীকার করেছে দেশটি।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের কর্মী, রপ্তানিকারক, কৃষক ও প্রযুক্তি উদ্ভাবকদের জন্য বড় সাফল্য। আগামী কয়েক সপ্তাহে চুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে নথিবদ্ধ হবে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার পণ্যে বাণিজ্যঘাটতি ছিল ১৭.৯ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি হলে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে একটি ফ্যাক্টশিট হয়তো পাওয়া যাবে। তবে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে কতটা জানাবে, সে সংশয় আছে। কারণ, বেশ কিছু বিষয় থাকবে, যা হয়তো ফ্যাক্টশিটে থাকবে না। যেমন বোয়িং কেনা, অস্ত্র কেনা বাড়ানো, শ্রম অধিকার রক্ষা ইত্যাদি। এখন চুক্তির যেসব খসড়া তৈরি হয়েছে, তাতে এসব বিষয় আছে বলেই জানা যাচ্ছে।

 

যুক্তরাষ্ট্র কী পাবে

দি বাজেট ল্যাব (টিবিএল) হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি স্বাধীন অর্থনৈতিক ও নীতি বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান। তারা মূলত কর ও শুল্ক, সরকারি বাজেট এবং অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে গবেষণা করে থাকে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ট্রাম্প শুল্কের প্রভাব বিশ্লেষণ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, নতুন শুল্ককাঠামোয় মার্কিন ভোক্তারা এখন থেকে গড়ে ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ কার্যকর শুল্কহার দেবেন, যা ১৯৩৪ সালের পর সর্বোচ্চ।

ভোক্তাদের জন্য শুল্কের চাপ

  • নতুন কাঠামোয় গড়ে ১৮.৩% কার্যকর শুল্ক দিতে হবে মার্কিন ভোক্তাদের—এটি ১৯৩৪ সালের পর সর্বোচ্চ।

  • স্বল্প মেয়াদে (২০২৫ সালের হিসাবে) পণ্যের দাম ১.৮% বাড়বে, যা প্রতি পরিবারের গড়ে ২,৪০০ ডলার ক্ষতির সমান।

  • দরিদ্র পরিবারের জন্য এই ক্ষতি (মূল্য পরিবর্তনের আগে) বছরে প্রায় ১,৩০০ ডলার হবে।

  • দাম সমন্বয়ের পর মূল্যবৃদ্ধি দাঁড়াবে ১.৫%, যা প্রতি পরিবারের ২,০০০ ডলার ক্ষতি।

কোন পণ্যে দাম বেশি বাড়বে

  • সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে পোশাক ও জুতায়।

  • স্বল্প মেয়াদে: জুতার দাম ৪০% এবং পোশাকের দাম ৩৮% বেড়ে যাবে।

  • দীর্ঘ মেয়াদে: জুতার দাম গড়ে ১৯% এবং পোশাকের দাম ১৭% বেশি থাকবে।

অর্থনীতিতে প্রভাব

  • ২০২৫ ও ২০২৬ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রতিবছর ০.৫% পয়েন্ট কমে যাবে।

  • দীর্ঘ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি স্থায়ীভাবে ০.৪% ছোট হবে, যা বছরে প্রায় ১২০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি।

চাকরির বাজারে প্রভাব

  • ২০২৫ সালের শেষে বেকারত্ব ০.৩% পয়েন্ট বাড়বে।

  • ২০২৬ সালের শেষে বেকারত্ব ০.৭% পয়েন্ট বাড়বে।

  • ২০২৫ সালের শেষে চাকরি কমবে প্রায় ৫ লাখ।

খাতভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

  • উৎপাদনশিল্পে ২.১% প্রবৃদ্ধি হবে।

  • তবে নির্মাণ খাত ৩.৫% ও কৃষি খাত ০.৯% কমে যাবে।

সরকারি রাজস্বে প্রভাব

  • ২০২৬-২০৩৫ সময়ে শুল্ক থেকে ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার আয় হবে।

  • অর্থনৈতিক ধীরগতির কারণে এই আয় থেকে প্রায় ৪৬৬ বিলিয়ন ডলার কমে যাবে।

  • ফলে চূড়ান্ত আয় দাঁড়াবে ২.২ ট্রিলিয়ন ডলার।

সুতরাং শেষ বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাল্টা শুল্ক কী প্রভাব ফেলবে, তার ওপরই নির্ভর করছে এর ভবিষ্যৎ। এই শুল্ককাঠামো কি কেবল ট্রাম্পের সময়েই থাকবে, পরবর্তী প্রেসিডেন্টও বহাল রাখবেন কি না, সে প্রশ্ন তো আছেই। তবে বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা হচ্ছে, কেবল এক পণ্য আর দুই দেশের বাজারের ওপর রপ্তানি নির্ভরশীল করে রাখলে বিপদ আসবে যেকোনো সময়।