
সদ্য বিদায়ি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। ২৮ জুন পর্যন্ত ৩ হাজার ৪ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় দেশে এসেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ বেশি। এর আগে এত বেশি রেমিট্যান্স আসেনি দেশে। এই আয়ে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছেন সৌদি আরব প্রবাসীরা। যদিও ২০২২ সালের জুলাই থেকে গত মার্চ পর্যন্ত রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষ দেশ হিসেবে কখনো সংযুক্ত আরব আমিরাত, কখনো যুক্তরাষ্ট্র, কখনো যুক্তরাজ্যকে দেখানো হচ্ছিল। গত এপ্রিলে আবার শীর্ষ দেশ হিসেবে সৌদি আরবের নাম উঠে এসেছে, যা মে মাসেও অব্যাহত রয়েছে। জুন মাসেও একই চিত্র দেখা যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে প্রবাসীরা অনেক বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। আগে যার অর্ধেক আসত ব্যাংকিং চ্যানেলে। আহসান মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর ডলারের দর একদফায় অনেকখানি বাড়িয়ে ১২২ টাকা নির্ধারণ করেন। এতে প্রবাসীরা বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন। বর্তমানে আইএমএফের পরামর্শে ডলারের দর বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। তারপরও স্থিতিশীল রয়েছে ডলারের বাজার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, মে মাসে মোট ২৯৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্সের মধ্যে সৌদি আরব থেকে এসেছে ৫৩ কোটি ৩৩ লাখ ডলার; যা মোট রেমিট্যান্সের ১৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। আর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে ৩৫ কোটি ১৪ লাখ ডলার। যা মোট রেমিট্যান্সের ১১ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ৩৪ কোটি ডলার নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে যুক্তরাজ্য। চতুর্থ অবস্থানে থাকা মালয়েশিয়া থেকে ৩৪ কোটি ডলার এবং পঞ্চম অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ২২ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। পর্যায়ক্রমে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে ওমান, ইতালি, কুয়েত, কাতার ও সিঙ্গাপুর।
দেশের ইতিহাসে একক মাসে সর্বোচ্চ ৩৩০ কোটি ডলার রেমিট্যান্সের রেকর্ড হয় গত মার্চে। ওই মাসে শীর্ষ আহরণকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫৪ কোটি ৬১ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স আসে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আসে ৫০ কোটি ৮৩ লাখ ডলার। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ ৪৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার আসে সৌদি আরব থেকে। চতুর্থ যুক্তরাজ্য এবং পঞ্চম দেখানো হয় মালয়েশিয়াকে। গত অর্থবছরও শীর্ষ দেশ হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাত, দ্বিতীয় যুক্তরাষ্ট্র, তৃতীয় যুক্তরাজ্য, চতুর্থ সৌদি আরব এবং পঞ্চম অবস্থানে ছিল মালয়েশিয়া।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে সরাসরি ব্যাংক এবং এক্সচেঞ্জ হাউস- এই দুই মাধ্যমে দেশে আসে। এক্সচেঞ্জ হাউসের সংগ্রহ করা রেমিট্যান্স ব্যাংকগুলো কিনে নিয়ে সুবিধাভোগীকে টাকা পরিশোধ করে। দেশের মোট রেমিট্যান্সের বেশি অংশ আসে এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে। যেসব দেশের এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসে, এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিবন্ধিত কোম্পানি বেশি। ফলে প্রবাসীরা যে দেশ থেকেই অর্থ পাঠান না কেন, ক্লিয়ারিং হয় এক্সচেঞ্জ হাউসের নিবন্ধিত দেশ থেকে। অবশ্য প্রতিষ্ঠানগুলো দেশভিত্তিক আলাদাভাবে রেমিট্যান্সের হিসাব করে। তবে ব্যাংকগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আলাদাভাবে না দেখিয়ে ওই দেশের রেমিট্যান্স হিসেবে রিপোর্ট করে। এই ভুল রিপোর্টিংয়ের কারণে প্রায় তিন বছর শীর্ষ রেমিট্যান্স আহরণকারী হিসেবে অন্য দেশের নাম উঠে আসছে। এখন থেকে ব্যাংকগুলোকে যে দেশের রেমিট্যান্স, সেই দেশের আয় হিসেবে দেখানোর নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যে কারণে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশি কোনো ব্যাংক হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ১০ লাখ ডলার কিনেছে। সেখানে পাঁচ দেশের রেমিট্যান্স আছে। এটি দেশভিত্তিক আলাদাভাবে না দেখিয়ে পুরোটাই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের রেমিট্যান্স হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিপোর্ট করে আসছিল। এতে করে প্রকৃত চিত্র প্রতিফলিত হতো না। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কথাও উঠেছে। এখন থেকে ব্যাংকগুলোকে দেশভিত্তিক প্রকৃত চিত্রের আলোকে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। সব ব্যাংক যথানিয়মে রিপোর্ট করলে আর ভুল রিপোর্টিং হবে না।
২০২২ সালের জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত সব মাসেই সৌদি আরব শীর্ষে ছিল। হঠাৎ করে ওই মাসে যুক্তরাষ্ট্রকে শীর্ষ আয়ের দেশ দেখানো হয়। দ্বিতীয় ছিল সৌদি আরব এবং তৃতীয় সংযুক্ত আরব আমিরাত। অবশ্য সব মিলিয়ে ওই অর্থবছরে সৌদি আরব শীর্ষে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান উঠে আসে দ্বিতীয়। আর তৃতীয় ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশে ডলার সরবরাহের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয়। বিগত সরকারের সময়ে রেমিট্যান্স কম আসায় দেশে ডলারের চরম সংকট দেখা দেয়। এতে রিজার্ভ কমে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমে যায়। তবে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে প্রবাসীদের আয়ে ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে। এখন পর্যন্ত রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে শক্তিশালী করছেন প্রবাসীরা। ফলে বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ থাকা সত্ত্বেও দেশের রিজার্ভ স্থিতিশীল রয়েছে।
জানা গেছে, আলোচ্য সময়ে জনশক্তি রপ্তানিও খুব বেশি বাড়েনি। কয়েক বছর ধরেই বিদেশের মাটিতে দেশের শ্রমবাজার ধারাবাহিকভাবে সংকুচিত হচ্ছে। গত এক বছরেই বৈশ্বিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৩০ ভাগ কমেছে। আর বিশ্বের মাত্র তিনটি দেশের ওপর নির্ভর করেই এখন চলছে বৈদেশিক শ্রমবাজারের ৯০ ভাগ, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বিদেশে নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি না হওয়া এবং কয়েকটি বড় শ্রমবাজার বন্ধ থাকায় ক্রমেই কমে যাচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি।
বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮৬৯ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে ৯৫ ভাগ কর্মী গেছেন মাত্র পাঁচটি দেশ সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে। তবে এই সংখ্যা ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ৩০ ভাগ কম। ২০২৩ সালে ১৩ লাখ ৭ হাজার ৮৯০ জন কর্মীকে বিদেশ পাঠানো হয়। বিএমইটির তথ্যে আরও জানা যায়, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি যে তিনটি দেশে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- সৌদি আরব ৭৩ শতাংশ, কাতারে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুরে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ এই তিনটি দেশ মোট জনশক্তি রপ্তানির ৯০ ভাগ পূরণ করেছে। বিশ্বের বাকি দেশগুলোতে গেছে মাত্র ১০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, জনশক্তি রপ্তানি বাড়াতে সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামীতে রেমিট্যান্স আরও বাড়বে। এদিকে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির অন্যতম শর্ত হচ্ছে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো।