
মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’ পরিচালনা নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটা পরিচালনা করবে? নাকি ডাক বিভাগ পরিচালনা করবে? তা নিয়েই মূলত এই অস্থিরতা। যদিও উচ্চ আদালত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রশাসক নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করেছে। তবুও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়। কিন্তু ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ মনে করছে, এই প্রতিষ্ঠানের ৫১ শতাংশ রেভিনিউ শেয়ার পায় ডাক বিভাগ। ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডাক অধিদপ্তরেরই এটা পরিচালনা করা উচিত। ডাক বিভাগ ইতিমধ্যে নগদের জন্য একজন সিইও নিয়োগ দিয়েছে। ৯ কোটি গ্রাহকের প্রতিষ্ঠান ‘নগদে’ অস্থিরতা বিরাজ করলে এর সুফল পায় ‘বিকাশ’।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ডাক বিভাগের এই টানাটানিতে প্রতিষ্ঠানটিতে চরম আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। সরকারি নানা ধরনের ভাতার অধিকাংশ বিতরণ হয় নগদের মাধ্যমে। এমন পরিস্থিতিতে সমাজসেবা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নগদের মাধ্যমে ভাতা বিতরণে ঝুঁকি অনুভব করছে, যা উঠে এসেছে গত ১২ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে লেখা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (আইসিটি ও টেলিযোগাযোগ) ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যবের এক চিঠিতে। সেখানে তিনি রেগুলেটর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ফিনান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করলে স্বার্থের সংঘাত হয় বলেও উল্লেখ করেছেন। ঐ চিঠিতে তৈয়্যব উল্লেখ করেছেন, নগদের ডিজিটাল ফরেনসিক অডিটের জন্য সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছে তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা কেপিএমজিকে। এই প্রতিষ্ঠানটি বিকাশের অ্যাকাউনটেন্ট বা অডিটর। তৈয়্যব মনে করেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিআইডিকে দিয়ে এই ধরনের অডিট করার সুযোগ আছে। এতে অর্থের সাশ্রয় হবে। গ্রহণযোগ্যতাও বাড়বে। কিন্তু তা না করে কার স্বার্থে এমন প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে?
বর্তমানে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসে লেনদেনের ক্ষেত্রে বিকাশের একক আধিপত্য রয়েছে। প্রায় ৭০ শতাংশ লেনদেন হয় বিকাশের মাধ্যমে। আর ২০ শতাংশ নগদের এবং বাকি ১০ শতাংশ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এমন পরিস্থিতিতে নগদ ক্ষতিগ্রস্ত হলে লাভবান হবে বিকাশ। গভর্নরকে লেখা ঐ চিঠিতে ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব বলেছেন, বাজারের এমন পরিস্থিতিতে বিকাশের বিরুদ্ধে এসএমপি (সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার) আরোপ করা উচিত। বরং নগদের এই অস্থিরতার সুযোগ বিকাশ বেশ কিছু সেবার দাম ইতিমধ্যে বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রসঙ্গত, মোবাইল অপারেটরদের ক্ষেত্রে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে এসএমপি আরোপিত হয়েছে। সেখানে অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে। তাহলে বিকাশের বিরুদ্ধে কেন এসএমপি হবে না?
গত ২৪ মে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের উদ্যোগে নগদ পরিচালনা নিয়ে একটা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ঐ বৈঠকে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এটর্নি জেনারেল এম আসাদুজ্জামান বলেছেন, আদালত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে ডাক বিভাগ যদি এটা পরিচালনা করে সেক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা নেই। প্রসঙ্গত, সুপ্রিমকোর্টের চেম্বার বিচারক নগদ জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে রেজিস্ট্রার্ড হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসক বসানোকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।
গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক নগদের বোর্ড পুনর্গঠন করে। বিকাশকে নিয়ে যৌথ গবেষণা করেছিলেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. কে এ এস মুরশিদ এবং খন্দকার সাখাওয়াত আলী। এই দুই জনকেই রাখা হয় বোর্ডে। এর মধ্যে খন্দকার সাখাওয়াত আলী আবার বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ভিজিটিং ফেলো হিসেবে কর্মরত আছেন। এছাড়া গভর্নরের নিজের প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) গবেষণা পরিচালক ড. বজলুল হক খন্দকারকে রাখা হয় পাঁচ জনের বোর্ডে। গভর্নর নিজেও বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ দেওয়ার আগে ব্র্যাকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। এর বাইরে বোর্ডে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আনোয়ার হোসেন ও ডাক বিভাগের পোস্ট মাস্টার জেনারেল ফরিদ আহমেদকে রাখা হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যবের এক পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে, তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা যিনি আগেও নাহিদ ইসলামের সঙ্গে কাজ করেছেন সেই আতিক মোর্শেদের নগদে অন্তর্ভুক্তি তিনি জানতেন না। তার স্ত্রীর চাকরি দেওয়ার বিষয়টিও তিনি অবগত ছিলেন না। তবে তিনি স্বচ্ছতার সঙ্গেই এখন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন।
এদিকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে সর্বশেষ গত ২৭ মে জুয়া, বেটিং, ফাইনান্সিং স্ক্যামসহ নানা ধরনের প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত এমএফএসের ১০৯৭টি একাউন্ট শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৬ শতাংশই বিকাশের একাউন্ট। এছাড়া নগদের ২৭ ও রকেটের ১৩ শতাংশ। এর বাইরে অন্তত ১০ লাখ ৮৭ হাজার ৫২৯টি এমএফএস একাউন্টের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের কেওয়াইসি সংরক্ষণ করা হয়নি। সঠিক কেওয়াইসি না থাকা একাউন্টগুলো বন্ধ করতে বলেছে টেলিযোগাযোগ বিভাগ। কিন্তু এসব একাউন্টের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এদিকে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দপ্তর থেকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারীর একটি চিঠির জবাবে এ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘নগদ’-এর মালিকানা, নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে বহুদিন ধরেই রয়েছে বিতর্ক। ‘নগদ’ কার্যত কোনো সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেই। শুরু থেকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ‘নগদ’ পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখ্যায় বলা হয়, নগদ কার্যত সম্পূর্ণভাবে একটি বেসরকারি কোম্পানি। যা নগদ লিমিটেড দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, আগে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড নামে পরিচিত ছিল। এই কোম্পানিকে ‘মাস্টার এজেন্ট’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ২০২৪ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ধরা পড়ে যে, ‘নগদ’-এর ই-মানি (ইলেকট্রনিক মানি) ব্যালেন্স তাদের ব্যাংকে রাখা রিয়েল মানির চেয়ে ১০১ কোটি ৩৬ কোটি টাকা বেশি। যা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবার নিয়ন্ত্রণনীতি অনুযায়ী সরাসরি অবৈধ। পর্যালোচনায় উঠে আসে আরো বিস্ময়কর তথ্য ‘নগদ’ অতিরিক্ত ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি ইস্যু করেছে, যার বিপরীতে কোনো রিয়েল মানি জমা দেওয়া হয়নি। ফলে গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং সরকারি কোষাগারও ক্ষতির ঝুঁকিতে পড়ে।
তবে ডাক অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নগদে যে অনিয়ম হয়েছে, সেটা তো কেউ অস্বীকার করছে না। এগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। পাশাপাশি ডাক বিভাগ এটি পরিচালনা করুক। বাংলাদেশ ব্যাংক এটার তদারকি করুক, কেউ তো এতে আপত্তি করছে না। প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হলে কার লাভ! ফলে এটি বন্ধ না করে সঠিকভাবে চালানো হোক।