
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্য সব খাতের মতো পরিবর্তন আসে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) শীর্ষ পদে। দুজন নতুন কমিশনার এবং একজন পুরোনোকে সঙ্গী করে কমিশনের দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের আস্থা ছিল নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর সংস্কার কার্যক্রমের পাশাপাশি নতুন করে গতি ফিরবে বাজারে। সব পক্ষের ভরসার পাত্র হয়েই তিনি কঠিন সময়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। দায়িত্ব নেওয়ার আট মাস পার হলেও পুঁজিবাজারের গতি বাড়ার বদলে উল্টো আরও কমেছে। দৈনিক লেনদেন, বাজার মূলধন কমাসহ বিনিয়োগকারী এবং ব্রোকারেজ হাউসগুলোর মধ্যে হতাশা চরম আকার ধারণ করেছে।
এ বিষয়ে জানতে বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম কালবেলাকে বলেন, কমিশন আন্তর্জাতিক প্র্যাকটিস অনুযায়ী চলছে। ইন্টারফেয়ার না করে বাজারকে বাজারের মতো চলতে দেওয়া হচ্ছে। এ বাজারটা সবার জন্য সমান, যা কমিশন প্রথম দিন থেকেই বলে দিয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ বাজারের উন্নয়নে সংস্কার করা। কমিশন সেই কাজগুলোই হাতে নিয়েছে এবং সেগুলো করছে। নতুন কমিশন জয়েন করেই টাস্কফোর্স গঠন করে দিয়েছে। এ ছাড়া মার্কেট উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী তৈরি করতে কাজ করে যাচ্ছে। যেখানে লিগ্যাল সাপোর্ট দেওয়া দরকার কমিশন সেখানে সাপোর্ট দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক প্র্যাকটিস অনুযায়ী একটি রেগুলেটরের যে কাজ, সেটাই করা হচ্ছে। মার্কেটে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে।
গত বছরের ১৮ আগস্ট বিএসইসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। তিনি যেদিন দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেদিন দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ছিল ৫ হাজার ৭৭৮ পয়েন্ট। এরপর এই সূচক সামান্য বাড়লেও দিন দিন তা তলানির দিকেই গেছে। গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার সূচক কমতে কমতে নেমে এসেছে ৪ হাজার ৯৭২ পয়েন্টে। এ হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ডিএসইর সূচক কমেছে ৮০৬ পয়েন্ট। যেখানে সব পক্ষের ভরসা ছিল, নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর পুঁজিবাজার আবারও ভালো হবে, সেখানে দেখা গেল ঠিক তার উল্টোটা।
যদিও বিএসইসি নেতৃত্বহীন থাকার সময়ে ডিএসইর প্রধান সূচক স্পর্শ করেছিল ৭ হাজার ১০০ পয়েন্টের বেশি ঘর। যখন বিএসইসিতে চেয়ারম্যান হিসেবে কেউ দায়িত্বে আসেননি, তখন দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে যায় আশ্চর্যজনকভাবে। পাশাপাশি প্রতিদিন বাড়তে থাকে প্রধান সূচকের পয়েন্ট। তবে নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তা ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে থাকে। সেই নামা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
ডিএসইর লাগাতার পতনের পাশাপাশি লেনদেন খরাও চলছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি অসন্তোষ দেখা দিয়েছে ব্রোকারেজ হাউসগুলোতেও। নামমাত্র লেনদেন হওয়ায় তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এদিকে দৈনিক পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব বিনিয়োগকারীরা কয়েকদিন পর পর রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ সমাবেশ করছেন। আর এসব কিছু সামাল দিতে বিএসইসির পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলোর কোনো সুফল এখনো মিলছে না।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারকে চাঙা করতে হলে নতুন ভালো মানের কোম্পানির তালিকাভুক্তি নিশ্চিত করা, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানো এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নইলে দীর্ঘ মেয়াদে পুঁজিবাজারের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
পুঁজিবাজার সংস্কারে যেসব উদ্যোগ
বিগত দিনে পুঁজিবাজারে হওয়া অনিয়ম আর দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে বিএসইসি বেশকিছু সংস্কার উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে গত বছরের ৭ অক্টোবর পুঁজিবাজারের উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করতে পুঁজিবাজার সংস্কারের সুপারিশের জন্য পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। পাশাপাশি পুঁজিবাজার ফোকাস গ্রুপও গঠন করে বিএসইসি। এরপর গত ২০ অক্টোবর একটি ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হয়। পুঁজিবাজারে বিগত সময়ের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত করার জন্যই গঠন করা হয় এ কমিটি। এ ছাড়া বাজারের উন্নয়নে নেওয়া হয় একগুচ্ছ নীতি পদক্ষেপের উদ্যোগ। কিন্তু এতসব উদ্যোগের কোনোটিই যেন দিনশেষে কাজে আসছে না।
আট মাসে ব্যাপক কমেছে বাজার মূলধন
বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৮ আগস্ট থেকে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ব্যাপকভাবে। গত বছরের ১৮ আগস্ট ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। ডিএসইতে দৈনিক লেনদেন খরা এবং সূচকের পতনে বাজার মূলধনও কমে গত বৃহস্পতিবার দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৪৫০ কোটি টাকায়। এ হিসাবে আট মাসের ব্যবধানে বাজার মূলধন কমেছে ৩৭ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। এ সময়ের মধ্যে দৈনিক লেনদেন নামে সর্বনিম্নে। গত ২৪ ডিসেম্বর ডিএসইর লেনদেন হয় মাত্র ২৭৫ কোটি টাকা, যা এই আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন। এ ছাড়া আরও কয়েকদিন লেনদেনে নেমেছে ২০০ কোটির ঘরে।
বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ
লাগাতার পতনে দিশেহারা হয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিএসইসি চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবি করে বিক্ষোভ করেন কয়েকবার। গত বুধবার বিক্ষোভের সময় বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইকবাল হোসাইন বলেন, গত আট মাসে পুঁজিবাজারের সূচক শুধু নিচেই নেমেছে, ওপরে উঠেনি। এই সময় সূচক প্রায় নয়শ পয়েন্ট কমেছে। টানা এই দরপতনে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার মূলধন হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজারে পতন চলতে থাকায় বাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ১৮ লাখ থেকে কমে ৭ লাখে নেমে এসেছে। বিনিয়োগকারী অনেকে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পুঁজি হারিয়েছেন।
এ সময় বিনিয়োগকারীরা বিএসইসি চেয়ারম্যানের অপসারণে আলটিমেটামও ঘোষণা করেন। বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা জানান, ৩০ এপ্রিলের মধ্যে যদি বিএসইসি চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা না হয়, তাহলে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
লেনদেনের বেহাল দশায় সংকটে ব্রোকারেজ হাউসগুলো
পুঁজিবাজারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হচ্ছে ব্রোকারেজগুলো। বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনাবেচায় সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি তারা বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সেবা প্রদান করে, যার বিপরীতে আয় করে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস হলো লেনদেন কমিশন। প্রতিটি শেয়ার কেনাবেচার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটি কমিশন হার ধার্য করা হয়। বিনিয়োগকারীদের প্রতিটি অর্ডারের বিপরীতে ব্রোকাররা এই কমিশন পেয়ে থাকেন, যা তাদের প্রধান আয়ের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ৩০০ থেকে ৪০০ কোটির ঘরে থাকায় এ আয় নেমেছে তলানিতে। এতে ব্রোকার হাউসগুলো রয়েছে চরম সংকটের মধ্যে। হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে।
একটি শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহী কালবেলাকে বলেন, এমন চরম দুঃসময় আমাদের আর কখনোই আসেনি। বর্তমানে যে হারে লেনদেন হচ্ছে এতে আমাদের ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা পরিচালনা সম্ভব হবে না। বর্তমানে সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বগতি। কিন্তু পুঁজিবাজারের এই নিম্নগামী লেনদেন থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে আমাদের চলা ভীষণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশেকুর রহমান কালবেলাকে বলেন, এমনিতেই সার্বিক অর্থনীতির অবস্থা ভালো না। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এবং ট্রেজারি বিলের সুদহার বৃদ্ধি। যেখানে ট্রেজারি বিলের সুদহার ছিল সাড়ে ১০ শতাংশের মতো, তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ শতাংশে। আমরা দেখতে পাচ্ছি নিয়ন্ত্রক সংস্থা শুধু দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদি সমাধানের কথাও ভাবতে হবে। খারাপ সময়ে এসে এমন কিছু করা যাবে না, যা আরও খারাপ হবে। পুঁজিবাজারের ইতিহাসে এখনকার চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি আর দেখিনি। ২০১২-১৩ সালের দিকে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা লেনদেন হতো, যা দিয়ে আমরা ব্রোকাররা চলতে পারতাম। কিন্তু ১৫ বছর পর এসে একই লেনদেন দিয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে না।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ কালবেলাকে বলেন, আমরা কেউই ভালো নেই। ট্রেজারিতে সুদের হার বেড়ে ১২ শতাংশ হয়েছে। এতে করে পুঁজিবাজারে যাদের বিনিয়োগ করার কথা তারা আরও বাজার থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। সামনে বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য প্রণোদনা দেওয়া দরকার। বড় যেসব কোম্পানি রয়েছে সেগুলো তালিকাভুক্ত করতে করহারের ব্যবধান বাড়ানো উচিত। পাশাপাশি রেপো রেট কমানো দরকার। কারণ এর সঙ্গে সুদের হার জড়িত। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কমিয়েছে। এদিকে ব্যাংকগুলো রয়েছে অনেক কড়াকড়ির মধ্যে, যা আগে ছিল না। বিনিয়োগকারীদেরও এ বিষয়গুলো বুঝতে হবে। এর ফলাফল দেখা যাবে দীর্ঘ মেয়াদে।