Image description

আবদুল লতিফ মাসুম

২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারের একটি অনিবার্য উদ্যোগ সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রে নারীদের বিষয়টিও বাদ যায়নি। যেহেতু দেশের অর্ধেকেরও বেশি নারী এবং তাদের বাদ দিয়ে আমাদের জীবন অসম্পূর্ণ, সেহেতু রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও এগিয়ে নিতে হবে।
 
২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক বিশেষ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন’ গঠন করা হয়। এর প্রধান করা হয় বিশিষ্ট নারী নেত্রী শিরীন পারভীন হক কে। দেশের আরো নামিদামি ৯ জন নারীকে এর সদস্য নির্বাচন করা হয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারী সমাজের সেবা, শিক্ষা, উন্নয়ন ও আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট নারী নেত্রীদের এখানে স্থান দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে রয়েছেনÑ শ্রমিক নেত্রী, স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ, মানবাধিকারকর্মী ও সামাজিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকেও এর সদস্য নিয়োগ করা হয়।
লক্ষ করার বিষয়, এসব নারী নেত্রীরা সমাজের অতি উঁচুতলার মানুষ। এতে কোনো সন্দেহ নেই, তারা তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল মানুষ। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের নারী সমাজের কথা যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে তা আরো অনেক বিস্তৃত। নারীরা এখন তাদের কর্মক্ষেত্রে এতই সংশ্লিষ্ট যে, ক্ষেতমজুর থেকে ইটভাঙা, ফুটপাতের দোকান থেকে মুরগির ফার্ম এবং স্কুল, কলেজ, ব্যাংকÑ সর্বত্রই তাদের অবাধ বিচরণ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত অবারিত এই নারী শ্রেণির যথার্থ প্রতিনিধিত্ব এলিট শ্রেণি দ্বারা সম্ভব কি না, তা একটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। মার্কসবাদীরা শ্রেণিবৈষম্যের কথা বলেন। শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলেন।
সুতরাং প্রতিটি স্তরে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত সর্বত্রই তাদের দাবি-দাওয়া ও আশা-আকাঙ্ক্ষা ভিন্নতর হতে বাধ্য। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্যদের তালিকা দেখে আমার মনে হয়েছে, কোথাও একটা জেনারেশন গ্যাপ বা আরো নিবিড়, নিকটতম সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। এর অর্থ অবশ্য এমন নয় যে, বড় বড় মানুষ ছোট ছোট মানুষের দুঃখ-বেদনা, অনুভূতি-উপলব্ধি ও আদর্শ লক্ষ্য ধারণ করেন না। এদেশে অনেক নারী নেত্রীর নাম আমরা জানি, যারা বড় মানুষের কাতারে ছিলেন।
হতদরিদ্র, শিক্ষাবঞ্চিত, সুবিধাবঞ্চিত নারীপক্ষের হয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমরা সেসব নারী নেত্রীর কথা জানি, যারা এদেশের মেহনতি ও শোষিত নারীশ্রেণির মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। সময়ের বিবর্তনে রাজনীতির, সমাজনীতির ও অর্থনীতির যেমন পরিবর্তন ঘটেছে, সে রকম পরিবর্তন হয়েছে বাংলাদেশের সামগ্রিক নারী সমাজে। বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তি বিপ্লব নারী সমাজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটিয়েছে। বাংলাদেশের পোশাক কারখানার দিকে তাকালেই এই পরিবর্তনের আবহাওয়া দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
প্রতিটি সমাজ ও রাষ্ট্রের নিজস্ব স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য থাকে। আমাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য, স্বভাব-চরিত্র, আহার-বিহার ও আচরণ ইউরোপ-আমেরিকার মতো নয়। তাদের আদর্শ, বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা আমাদের থেকে আলাদা। নিউ ইয়র্কের রাস্তায় প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া চলে, ঢাকায় চলে না। অথচ সবাই মানুষ; তবু অধিকার ও কর্তব্যে সমতা নেই।
আমাদের শাসন কাঠামো, জনচরিত্র ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিও পাশ্চাত্যের মতো নয়। বর্তমান বিশ্বে পাশ্চাত্যসভ্যতা উন্নত ও আমাদের লক্ষ্য হলেও, একসময় প্রাচ্য ছিল উন্নত ও অনুকরণীয়। ইংরেজরা ভারতবর্ষে এসেছিল এদেশের প্রাচুর্যের টানে। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার এখন বাস্তবতা। সভ্যতার দ্বন্দ্ব এসপি হান্টিংটন তার ‘The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order’ বইয়ে চমৎকারভাবে তুলেছেন, যদিও তার যুদ্ধতত্ত্বের সঙ্গে আমরা একমত নই। সভ্যতার দ্বন্দ্ব, রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে ও দেশে-দেশে দ্বন্দ্ব চিরকাল ছিল এবং থাকবে। বাংলাদেশ এই অব্যাহত দ্বন্দ্বের অংশ। তা না হলে ১৯৪৭ সালে দেশভাগ বা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আসত না।
বিভেদ রয়েছে এপার বাংলা ও ওপার বাংলার মাঝেও। ১৯০৫ সালে ‘টাওয়ার বাংলার লোকরা’ বঙ্গমাতার অঙ্গ ছেদন বলে আক্ষেপ করেছে। ১৯৪৭ সালে আমরা এক থাকার আকুতি জানিয়েছি। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের ভাষায়, টাওয়ার বাংলার লোকরা ‘মহাভারতের কৌরব’ হয়ে গেছে। এই বাস্তবতা বলছে, আমরা ও সাদা মানুষ এক নই, আমরাও একে অন্যের সঙ্গে পুরোপুরি এক নই। আমাদের নারী সমাজও আলাদা। শিক্ষা, সংস্কৃতি, পোশাকেও এই ভিন্নতা স্পষ্ট।
উচ্চশ্রেণির কিছু নারী পাশ্চাত্য ও প্রতিবেশী সংস্কৃতিতে এতটাই মিশে গেছেন যে, সাধারণ নারীদের থেকে আলাদা হয়ে গেছেন। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায়, সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার ফলে আমাদের এলিট শ্রেণিতে এই পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের সাধারণ নারীরা গায়ে মাথায় কাপড় দেন, শালীনতায় চলেন। উচ্চশ্রেণির নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই এর বিপরীত। তাদের বেশিরভাগ সময় কাটে বিদেশে; মাঝে মাঝে নারীর মুক্তির নামে কিছু উদ্যোগ নেন।
বাংলাদেশের নারীসমাজ তিন ভাগে বিভক্ত :
১. হতদরিদ্র শ্রেণি—বিধবা, স্বামী পরিত্যাক্তা, ভূমিহীন নারীরা।
২. শিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত চাকরিজীবী শ্রেণি—স্কুল, কলেজ, ব্যাংক, অফিস আদালতে কর্মরত, যাদের বেশভূষা ও আচরণে সম্মান ফুটে ওঠে।
৩. বিদেশি শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণি—চলনে-বলনে তারা সাধারণ নারীদের প্রতিনিধিত্ব করেন না। তারা প্রায়ই বাংলাদেশের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। রাজনীতিতেও তাদের ভূমিকা ক্ষীণ। উল্লেখযোগ্য নারী নেত্রীরা এখনো মাথায় কাপড় দিয়েই চলেন।
প্রস্তাবিত নারী সংস্কার প্রতিবেদনটিতে একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাটে প্রতি অধ্যায় বা বিষয়ভিত্তিক নারীর প্রতি প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জগুলোর বর্ণনা রয়েছে। এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে করণীয় নির্দেশ করা হয়েছে। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের মেয়াদে করণীয় বর্ণিত হয়েছে। পরিপূর্ণ স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার কথা বলা হয়েছে। নারীর প্রতি সামাজিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে এতে সন্দেহ নেই এবং নারীর অগ্রায়নে নানা ধরনের করণীয় সম্পর্কেও তেমন দ্বিমত নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সবকিছুর দায়-দায়িত্ব একটি নির্দিষ্ট ঘরানা, ধার-ধারা ও ধর্মকে দায়ী করা। যেমন নারী ও কন্যাশিশুর জন্য সহিংসতামুক্ত সমাজ গড়ার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ‘ধর্ম, প্রথা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে দায়ী করা হয়েছে’। ২৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে নারী উন্নয়নের পথে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে পারিবারিক আইন ও উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা প্রায়ই রক্ষণশীল ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিরোধের মুখে পড়ে। তৃতীয় অধ্যায়ের স্লোগান : রাষ্ট্র এবং পরিবারে সমান হব অধিকারে।
সম্পত্তির অধিকারের ক্ষেত্রে এটি কোরআনিক বিধিবিধানের বিপরীত। এই অনুচ্ছেদের ভূমিকায় বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিধানের ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যক্তিবাচক আইনগুলো নারীদের জন্য বিশেষভাবে বৈষম্য সৃষ্টি করছে। একপর্যায়ে অভিন্ন পারিবারিক আইন ঐচ্ছিক করার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের ভাষায় ‘একটি অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রবর্তন করা, যা বিয়ে, বিয়েবিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব ও উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত সব বিষয়ে ন্যায়বিচার ও সমতার ভিত্তিতে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য ঐচ্ছিকভাবে প্রযোজ্য হবে’। এখানে প্রচলিত ও শরিয়াহ আইনের ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। বিবাহিত জীবনে দাম্পত্য সম্পর্কের বিষয় সম্পর্কে ধর্মীয় বিধিবিধানের বিরোধিতা রয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে যে স্লোগানটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা সমাজে দ্বন্দ্ব ও বিদ্বেষের সৃষ্টি করবে। বলা হয়েছে, ‘পুরুষের ক্ষমতা ভেঙে গড়ো সমতা’।
এটি পুরুষবিদ্বেষী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ে একই প্রবণতার প্রতিফলন ঘটেছে। ‘আমার কথা আমি বলবো স্বাধীনভাবে পথ চলবো’ বলতে গিয়ে আসলে বাস্তবতা বৈরী মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে নারী ও কন্যাশিশুর জন্য সহিংসতামুক্ত সমাজ গড়ার কথা বলতে গিয়ে আবার প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও দ্বন্দ্বের অবতারণা করা হয়েছে। স্লোগানটি এ রকম ‘নারী নির্যাতন রুখবো সবে, হাত আছে হাতিয়ার হবে’। এই অধ্যায়ে বৈষম্য প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জের কথা বলে প্রথা ও ধর্ম উপশিরোনামে ধর্মবিরোধী বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। সপ্তম অধ্যায়ে জনপরিসরে নারীর ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘রাজপথের নারীর সাড়াকে জাগরণের নতুন ধারা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে’। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন ও সংগ্রাম একটি প্রশংসিত বিষয়; কিন্তু নারীকে রাজপথে নিক্ষেপ করলে সামাজিক বন্ধন ও শৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটবে কি না, তা বিবেচ্য বিষয়। অষ্টম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘সকল বাধা ভাঙবো সমঅধিকার আনবো’। এখানেও সাংঘর্ষিক সুর লক্ষ করা যায়। নবম অধ্যায়ে যথার্থই বলা হয়েছে, ‘শিক্ষাই মুক্তি, শিক্ষাই নারীর শক্তি’। দশম অধ্যায়ে স্লোগানটি আপত্তিকর। এখানে নষ্ট নারী লেখক তসলিমা নাসরিনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘শরীর আমার, সিদ্ধান্ত আমার’।
এটি বাংলাদেশের মতো মূল্যবোধসমৃদ্ধ সমাজে সর্বনাশের কারণ ঘটাবে। একাদশ অধ্যায়ে অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ ও সম্পদের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে সমান হিস্যা ও সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। যেটি আবার ইসলামি বিধিবিধান ও শরিয়াহ দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করছে। দ্বাদশ অধ্যায়ে একটি ইতিবাচক কথা বলা হয়েছে। আর তা হলো, ‘নিজের হাতে কাজ করি, নিজের ভাগ্য নিজে গড়ি’। কিন্তু সেখানে স্পষ্টতই একটি আপত্তিকর দাবি উত্থাপিত হয়েছে। প্রতিবেদনের ১৩২ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘নারীদের একটি চ্যালেঞ্জ বা সমস্যা হচ্ছে যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি না থাকা। আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের আইনগত স্বীকৃতি নেই, যৌন পেশা সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট আইনও নেই। আইন না থাকায় যৌনকর্মীরা পুলিশের হয়রানি ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হন। আর্থিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে তারা আরো ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি না থাকায় তারা আইনি সহায়তা ও নিরাপত্তা পান না’।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে, ‘শ্রম আইনে যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান’। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে, ‘যৌনকর্মীদের শ্রম অধিকার, নিরাপদ আবাসস্থল, জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা, শিশুদের অভিভাবকত্ব ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা’। বিষয়টি নৈতিক স্খলনের প্রকাশ্য সমর্থন। এ ধরনের দাবি এই সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ ও ধর্মীয় বিধিবিধানের প্রতি সরাসরি আঘাত। শুধু তাই নয়, কমিশন-পরবর্তী সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে যৌনকর্মীদের রীতিমতো প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রদানের। এটি একটি ঔদ্ধত্যপূর্ণ দাবি। তাদের মনে রাখতে হবে, আমরা ইউরোপ, আমেরিকায় বসবাস করি না।
এমনকি প্রতিবেশী দেশের অবাধ যৌনপল্লির অনুসরণও আমরা নৈতিকভাবে করতে পারি না। ত্রয়োদশ অধ্যায়ে নারীশ্রমিকের অভিবাসন প্রসঙ্গে যথার্থভাবেই অধিকার মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়েছে। চতুর্দশ অধ্যায়ে দারিদ্র্য হ্রাসে টেকসই সামাজিক সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। পঞ্চদশ অধ্যায়ে গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ চিত্রায়ণ ও প্রকাশ সম্পর্কে নানা প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছে। ষোড়শ অধ্যায়ে ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে নারীর অন্তর্ভুক্তি ও বিকাশের কথা বলা হয়েছে। সপ্তদশ অধ্যায়ে নারীর ওপর দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
অভিযোগ এসেছে, দায়েরকৃত প্রতিবেদনটি ২০২১ সালে আওয়ামী লীগ প্রণীত নীতিমালার প্রতিফলন মাত্র। ২০১১ সালের মতো এবারের নারী সংস্কার কমিশনও সম্পদে উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রে কোরআনিক আইন বা মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের স্থলে সমঅধিকারের সুপারিশ করেছে। প্রতিবেদনে নারীর অবাধে চলাফেরা ও কর্মক্ষেত্রের স্বাধীনতাসহ যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, তা এদেশের সামাজিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নারীদের পোশাক-আশাকের ব্যাপারে শালীনতা কোনো বিরোধীয় বিষয় নয়। সুতরাং সমাজ ও পারিবারিক মূল্যবোধের বিপরীত কিছু করতে গেলে বিপত্তি ঘটবে। বিশেষ করে যখন এখানে পাশ্চাত্যের প্রবল প্রভাব রয়েছে, প্রতিবেশী সংস্কৃতির নিত্য ছোবল রয়েছে। প্রতিবেদনের অধিকাংশই সমাজে নারীর উন্নয়নের পক্ষে ইতিবাচক।
কিন্তু সমগ্র প্রতিবেদনে এদেশের জাতীয় আদর্শ, নীতি, মূল্যবোধ ও জীবনবোধের প্রতিফলন নেই। প্রতিবেদনটি মনে হয়েছে যে, অধিকাংশ নারীর মন ও মানসকে ধারণ করে না। আমরা অবশ্যই নারী-পুরুষের সাংঘর্ষিক সমাজ চাই না। একটি ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যনীতির অনুবর্তী বাংলাদেশের সমাজ। সুতরাং যেকোনো নীতির প্রকাশ ও প্রয়োগ সে নিরিখেই নির্ণীত হতে হবে। প্রণীত নারী সংস্কার প্রতিবেদনে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শিক বলয়ের প্রতিনিধিত্ব লক্ষ করা যায়। দেশের মানুষের অনুসৃত সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিবিধান তথা ইসলামি আদর্শের ধারণ, এমনকি প্রকাশও এখানে অনুপস্থিত। তাই সংগত কারণেই ইসলামের অভিভাবক আলেম-ওলামা ও নানা শ্রেণির ধার্মিক মানুষ এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন।
প্রতিবেদন যারা তৈরি করেছেন, তাদের চেয়েও বেশি দায়ী যারা এ ধরনের নারী বিচ্ছিন্ন ও নৈতিকতা বিবর্জিত নারী এলিটদের দ্বারা এই কমিশন তৈরি করেছেন। এদেশের উচ্চশিক্ষিত হাজারো নারী স্কলারকে তাদের চোখে পড়েনি। একপেশে এই প্রতিবেদন পুরো জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই নতুন করে একটি নারী ঘনিষ্ঠ ও নারীবান্ধব নীতিমালা নতুন করে প্রণীত হোক। প্রণীত প্রস্তাবনায় অনেক বিষয় ইতিবাচক। তাদের প্রতি বিদ্বেষ বা ক্ষোভ প্রকাশ না করে আমাদের উচিত ইতিবাচক পথে অগ্রসর হওয়া।
 
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাবেক অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।