
গ্রামের নাম দৌলতপুর। এই গ্রামের এক কোণে ‘ইন্ডিয়ানপাড়া’ নামে একটি জনপদ রয়েছে। পৃথক জনপদ বললে ভুল হবে, এখানে বাংলাদেশিদের পাশের বাড়িতে বসবাস করেন ভারতীয় নাগরিকরা। ভারতীয়রা যেখানে বসবাস করেন, সেটি সে সেশেরই ভূখণ্ড। যদিও তা কাঁটাতারের বেড়া থেকে দেড়শ’ গজ দূরে, কার্যত বাংলাদেশের গ্রামেরই অংশ।
সীমান্তে বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা-নির্যাতন নৈমিত্তিক ঘটনা। কখনো কখনো ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পাশাপাশি সে দেশের নাগরিকরাও হত্যা-নির্যাতনে শামিল হয়। অথচ দৌলতপুরে বংশপরম্পরায় বসবাসরত ভারতীয় নাগরিকদের গায়ে আজ পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি ফুলের টোকাটিও দেননি।
শান্তিতে বসবাসরত এই ভারতীয়রা নির্দ্বিধায় স্বীকার করলেন বাংলাদেশের মানুষের বদান্যতার কথা। যে কারণে পরিবারের কারো শরীর খারাপ হলে তারা চিকিৎসা করাতে পারছেন বাংলাদেশের হাসপাতালে। বাজারঘাট করছেন এই দেশের হাটে-বাজারে। সন্তানদের পড়াচ্ছেন এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। নামাজও পড়ছেন বাংলাদেশের মসজিদে, ঈদগাহে।
দৌলতপুর গ্রামটির অবস্থান যশোরের চৌগাছা উপজেলার পশ্চিম সীমান্তে। এই গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক হায়দার আলী বলছিলেন, ‘ভারতীয় নাগরিক হলেও তারা আমাদের ভাই। আমরা একসঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করি। আমার জীবদ্দশায় এখানে দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে কোনো ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট হয়নি।’
স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, গেল শতাব্দীর আশির দশকে চৌগাছার সীমান্তের এই অংশে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজ শুরু করে। সে সময় ভারত শূন্যরেখা বরাবর বেড়া নির্মাণের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ়তায় আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী শূন্যরেখা থেকে দেড়শ’ গজ দূরে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করতে বাধ্য হয় দেশটি। ফল হয় এই যে, দৌলতপুর গ্রামের যেটুকু ভারতের ভূমি সে অংশ থেকে যায় কাঁটাতারের বাইরে। ২০০৪ সাল নাগাদ বেড়া নির্মাণ শেষ হওয়ার পর থেকে এখানকার ভারতীয় নাগরিকরা আইডি কার্ড দেখিয়ে নিজ দেশের মূল ভূখণ্ডে দিনে ২/৩ বার ঢুকতে পারেন। ফলে তাদের জীবন মূলত বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল।
কথা হয় দৌলতপুরের ইন্ডিয়ানপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা নূর হোসেনের সঙ্গে। ভাগ্নে রেন্টু মণ্ডলের বাড়িতে বসে তিনি আমার দেশকে জানান, এই গ্রামে তাদের কয়েক পুরুষের বসবাস। এখানে মোট ১৯টি পরিবার আছে। তাদের মূল পেশা কৃষি। জমিতে উৎপাদিত ফসল তারা বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করেন। কাঁটাতারের ওপারে মামা-ভাগিনা, পদ্মপুকুরিয়াসহ আশপাশের গ্রামগুলো বেশ দূরে। সেখানে পণ্য বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়াও ঝামেলাপূর্ণ।
নূর হোসেনের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলেটি কুয়েতে ছিলেন। সেখানেই মারা গেছেন। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশি নাগরিকদের সঙ্গে। কথা বলতে বলতে জোহরের নামাজের সময় হয়ে যায়। নূর হোসেন আমার দেশ প্রতিবেদককে নিজ বাড়িতে বসিয়ে রেখে মসজিদে যান নামাজ পড়তে। যে মসজিদে তিনি নামাজ আদায় করেন, সেখান থেকে তার বাড়ির রান্নাঘরের দূরত্ব ১৫ গজের বেশি নয়। অথচ মসজিদটি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। গ্রামের বাংলাদেশ অংশে অবস্থিত ঈদগাহে দুই ঈদে নামাজ আদায় করেন দুই দেশের নাগরিকরাই।
নামাজ শেষে দুই দেশের মানুষ একসঙ্গে মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলে বাংলাদেশি নাগরিক হায়দার আলী, আবদুল গনি, শফিউদ্দিন প্রমুখের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এখানে বসবাসরত ভারতীয়দের কোনো সমস্যা হয় কি না। সবাই একযোগে ‘না-সূচক’ জবাব দেন। একই কথা ভারতীয় মুসল্লিদেরও। তবে তারা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পান। কারণ টহলে আসা বিএসএফ সদস্যদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের।
গ্রামবাসী জানালেন, এখানে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিকরা নিজ দেশে ঢুকতে পারেন দিনে দুই থেকে তিনবার। তাও আবার নির্ধারিত সময়ে। দৌলতপুরের ইন্ডিয়ানপাড়া থেকে কাঁটাতারের বেড়ার গেটের দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। সেখানে ভারতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে নিজ দেশের অভ্যন্তরে যেতে হয়। আবার নির্ধারিত সময়ে ফিরেও আসতে হয়। এক মিনিট এদিক-ওদিক হলে ওই দিন আর বাড়িতে নাও ফেরা হতে পারে। সেই কারণে জরুরি চিকিৎসাসেবার জন্য তাদের পুরোপুরি বাংলাদেশি চিকিৎসাকেন্দ্রের ওপর নির্ভর করতে হয়। আবার সন্তানদের ভারতের কোনো প্রতিষ্ঠানে নামমাত্র ভর্তি করে রাখলেও তারা পড়াশোনা করে মূলত বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
ইন্ডিয়ানপাড়ায় ঢুকতে ছোট্ট একটি দোকান দিয়ে বসেছেন দাউদ হোসেন (৭০)। ভারতীয় এই ব্যক্তির দোকানে মূলত সে দেশের পণ্যই বিক্রি হয়। দুই দেশের নাগরিকরাই তার খরিদ্দার। গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে কথা বলতে একেবারেই নারাজ এই ভারতীয়। শুধু এটুকু জানান, বিএসএফের অনুমতি নিয়েই তিনি দোকান খুলেছেন। দোকানে বিক্রির জন্য রাখা পণ্য তিনি ভারত থেকেই আনেন।
দৌলতপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ফার্স্ট বয় রাজিব। এই বালকের বাবা বাংলাদেশি, মা ভারতীয়। তার নাগরিকত্ব কোন দেশের ছোট্ট রাজিব তা জানে না। তবে যশোরের কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়ার স্বপ্ন দেখে এই অবুঝ বালক। রাজিব স্কুলের মাঠে ক্রিকেট আর পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলে। দুই মাঠে তার বন্ধুরা দুই দেশের। ক্রিকেটভক্ত রাজিবের কাছে প্রিয় খেলোয়াড়ের নাম জিজ্ঞেস করতে তার পাল্টা প্রশ্নÑ কোন দেশের? ভারতের না বাংলাদেশের?
বাংলাদেশের পক্ষে দৌলতপুর সীমান্তের নিরাপত্তার দায়িত্ব বিজিবি ৪৯ ব্যাটালিয়নের অধীনস্ত আন্দুলিয়া কোম্পানির। এই কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার মো. মামুন শিকদার পরিচয় পেয়ে আমার দেশ প্রতিবেদককে চায়ে আপ্যায়িত করলেন। কিন্তু ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের নির্দেশনা ছাড়া তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে অপারগ বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন।
বিজিবি ৪৯ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী আমার দেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ অনেক সহনশীল, কর্ডিয়াল (সৌহার্দপূর্ণ)। আমার দায়িত্বকালে দৌলতপুর এলাকায় কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। সেখানে দুই দেশের মানুষ শান্তিতে বসবাস করে।’