Image description
প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংকে অনিয়ম যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম ভেঙে চলছে ব্যাংকিং কার্যক্রম। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঋণ বিতরণ, খেলাপিযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে খেলাপি না দেখানো, একক ঋণসীমা লঙ্ঘন, সরকারি সিকিউরিটিজ ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষতি যথাযথভাবে না দেখানো এবং সিআইবিতে মিথ্যা তথ্য দেওয়াসহ নানা অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ পরিদর্শনে। এসব অনিয়মের ফলে ব্যাংক উচ্চ খেলাপি ঋণ ও তারল্য সংকটে রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
২০২৪ সালের নভেম্বরে পরিদর্শন শেষে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দল। প্রতিবেদনটি হাতে এসেছে আমার দেশ-এর।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এবি ব্যাংকের গুলশান শাখাকে কৃষি ও এসএমই ঋণ ছাড়া অন্য যে কোনো ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে গ্লোবাল করপোরেশনস, স্কাই এপারেল্স লিমিটেড, ফু-ওয়াং সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, সালেহ স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এসএস স্টিল লিমিটেড, সৌরভ ফিসারিজ অ্যান্ড এগ্রো লিমিটেড, আরএসএ ক্যাপিটাল, লাইট হাউজ ইনফ্রাস্ট্রাকচার, ডেল্টা হেলথকেয়ার মিরপুর লিমিটেড, ডেল্টা হেলথকেয়ার ময়মনসিংহ লিমিটেড, ডেল্টা হেলথকেয়ার যাত্রাবাড়ী লিমিটেড এবং এলোয় কোট লিমিটেডসহ কয়েকটি গ্রাহকের অনুকূলে নতুন ঋণ দেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা ছিল।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, নির্দেশনা অমান্য করে এবি ব্যাংকের গুলশান শাখা এসএস স্টিল লিমিটেড, ফু-ওয়াং সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, সালেহ স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও ওয়েম্যাক্স ইলেকট্রোডের অনুকূলে ১১টি এলসি সুবিধা দেয়। প্রতিষ্ঠানগুলো একই মালিকানার অধীন হওয়ায় এর নির্দিষ্ট ঋণসীমা রয়েছে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে পৃথকভাবে দেখিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একক গ্রাহক ঋণ সীমা লঙ্ঘন করে। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না এবং শাখার কার্যক্রম লজ্জাজনক ও বিব্রতকর।
তবে ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক এবি ব্যাংককে ২০২৪ সালের ৬ নভেম্বর দুই লাখ টাকা জরিমানা করে। এ ধরনের কার্যকলাপ ব্যাংকিং রীতিনীতির গুরুতর লঙ্ঘন এবং জনআস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ বলে উল্লেখ করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে।
একই ধরনের ঘটনা ঘটে গ্লোবাল করপোরেশনসের ক্ষেত্রেও। কো-অর্ডিনেটর আপত্তি তোলার পরও ব্যাংক ১৫ কোটি ৮০ লাখ টাকার একটি ব্যাংক গ্যারান্টি নবায়ন করে। সব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও প্রতিষ্ঠানটিকে খেলাপি দেখানো হয়নি।
সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা
বাংলাদেশ ব্যাংকের কো-অর্ডিনেটর বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে একক গ্রাহক ঋণ সীমার নির্দেশনা পরিপালন এবং গ্রাহকের নামে শ্রেণিকৃত ও খেলাপি ঋণ না থাকা শর্তে ঋণ সুবিধা পুনঃনবায়ন করতে পরামর্শ দেন। এক্ষেত্রে ব্যাংক বেক্সিমকো গ্রুপের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের ঋণ হিসাবকে একক গ্রুপ হিসেবে না দেখিয়ে তিনটি ভিন্ন গ্রুপে দেখিয়ে ঋণ বিতরণ বা নবায়ন করেছে। এর মাধ্যমে গ্রুপটিকে ব্যাংক অনৈতিক সুবিধা দিয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, এবি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখা ও নিউ এলিফ্যান্ট রোড শাখায় বর্তমানে মোট বকেয়া স্থিতি এক হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রিন্সিপাল শাখার বেক্সিমকো এলপিজি ইউনিট-১, টপিক্যাল ফ্যাশন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড শাখায় বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড প্রতিষ্ঠান খেলাপিযোগ্য হলেও ব্যাংক সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিএল বিবরণীতে খেলাপি দেখায়নি। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ব্যুরো অব ইনফরমেশন (সিআইবি) ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার গ্রাহক ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যারের পুনর্গঠিত ঋণটি ১২ মাস খেলাপি না দেখানোর কারণে এবি ব্যাংককে গত বছরের ১৭ অক্টোবর পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করে।
খেলাপিযোগ্য ঋণকে খেলাপি না করা
এবি ব্যাংক খেলাপিযোগ্য প্রতিষ্ঠানের ‍ঋণ খেলাপি না করে নিয়মিত দেখাচ্ছে। এর মাধ্যমে খেলাপিযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা দিয়েছে এবি ব্যাংক। ২০২৩ সালের এপ্রিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দল বলেছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর ভিত্তিতে ৬ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা যথাযথভাবে খেলাপি করে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকদের সিআইবি আপডেট করে ওই বছরের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে হবে। এছাড়া ব্যাংকের আবেদন বিবেচনায় আরো ৯ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার খেলাপিযোগ্য ঋণ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিয়মিত করা অথবা যথাযথভাবে খেলাপি করে গ্রাহকের সিআইবি আপডেট করতে হবে।
এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আরো দুই দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপরও ব্যাংক ঋণগুলো খেলাপি করেনি, যা ব্যাংক কোম্পানি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ নির্দেশনা পরিপালনের ব্যর্থ হওয়ার পর ব্যাংকের অনুরোধে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগে ৯ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা খেলাপি করে সিআইবি আপডেট করতে বলা হয়। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দল দ্বারা চিহ্নিত আরো ১১ হাজার ৭৬৯ টাকার খেলাপিযোগ্য ঋণ গত বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিয়মিত করতে বলা হয়। তবে এ শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হলে খেলাপি করার নির্দেশ দেয় পরিদর্শন দল।
তবে এই নির্দেশনা পরিপালনে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সময় চায়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের আবেদন নাকচ করে আবারও খেলাপি করতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু ব্যাংকের গত বছরের সেপ্টেম্বরভিত্তিক সিএল বিবরণীতে উক্ত ঋণ খেলাপিতে না দেখিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করেছে।
পরিদর্শন দল বলেছে, ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপিযোগ্য ঋণ খেলাপি না করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে আসছে। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার সরাসরি লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দল আরো বলেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২৩ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭১ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকে এবি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ দেখিয়েছে ১০ হাজার ১১৫ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের মাত্র ৩১ শতাংশ।
সরকারি সিকিউরিটিজ ক্রয়-বিক্রয়জনিত ক্ষতি যথাযথভাবে না দেখানো
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, স্বল্প সময়ের জন্য বিনিয়োগকৃত সিকিউরিটিজের বিক্রয়জনিত লাভ অথবা ক্ষতি সংশ্লিষ্ট সময়ের লাভ-ক্ষতি হিসেবে প্রদর্শন করতে হবে। ব্যাংকের গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে এ ধরনের বিনিয়োগে পুনর্মূল্যায়নজনিত ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ৫৯৬ কোটি টাকা। ব্যাংক তারল্য ঘাটতি মেটাতে এই সিকিউরিটিজের বিপরীতে রেপো করার সময় পুনর্মূল্যায়নজনিত এই ক্ষতি হয়েছে। ব্যাংক এই ক্ষতির মোট ৬৩২ কোটি টাকা লাভ-ক্ষতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না করে সম্পদ হিসেবে দেখিয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার লঙ্ঘন।
নির্দেশনা লঙ্ঘন করে আইটি সরঞ্জামাদি ক্রয়
গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর ব্যাংকের ৭৯৪তম সভায় এটিএম বুথের নিরাপত্তার জন্য এইচডিডি ও ডিভিআর ক্রয় প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কো-অর্ডিনেটর আপত্তি জানিয়েছিলেন। কো-অর্ডিনেটর জামাল উদ্দিন ২৫ সেপ্টেম্বর ব্যাংকে এক ই-মেইল বার্তার মাধ্যমে জানান, ৭৯৩তম সভার খসড়া কার্যবিবরণীর ২ নম্বর এজেন্ডায় আইটি সরঞ্জাম কেনাকাটা সম্পর্কিত ক্রয় কমিটি পুনর্গঠনের পরামর্শটি পরিপালন করা হয়নি। এছাড়া ব্যাংকের প্রকিউরমেন্ট ম্যানুয়েল লঙ্ঘন করে একটি প্রতিযোগিতাহীন প্রতিষ্ঠান থেকে সফটওয়্যারসহ বিবিধ সেবা কেনা হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠান আবার ব্যাংকের খেলাপি গ্রাহক। ফলে ক্রয় প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সন্দেহজনক। এজন্য প্রস্তাবটি অনুমোদনযোগ্য নয়।
তবে কো-অর্ডিনেটরের নিষেধাজ্ঞা আমলে নেয়নি এবি ব্যাংক। তার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে প্রস্তাবটি অনুমোদন এবং আইটি সরঞ্জাম কেনা হয়।
সীমা লঙ্ঘন তবুও ঋণ বিতরণ
এবি ব্যাংকের ঋণ-আমানতের অনুপাত ৮৭ শতাংশ নামিয়ে আনতে দুই দফা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে ব্যাংক নির্ধারিত সীমায় নামিয়ে আনতে ব্যর্থ হওয়ায় বড় অংকের ঋণ বিতরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই নিষেধাজ্ঞাও মানেনি ব্যাংক। গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংক নিষেধাজ্ঞা ‍উপেক্ষা করে ৯৮৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে।
অনিয়মের মাধ্যমে বেতন বৃদ্ধি
এবি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিশেষ বেতন বৃদ্ধির কোনো প্রকার নীতিমালা নেই। নীতিমালা না থাকা সত্ত্বেও পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএভিপি রুহুল আমিন, সিনিয়র অফিসার নুসাইবা নিমাত ও ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর কে এম মহিউদ্দিন আহমেদের বিশেষ বেতন বৃদ্ধি করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে এবি ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি সৈয়দ মিজানুর রহমানকে কল করা হলে তিনি তা রিসিভ করেননি। পরবর্তী সময়ে মেসেজ পাঠালেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।