
পুরুষদের সুতি প্যান্ট, ওভারঅল এবং শর্টস বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সারা বছরই এসব পোশাকে চাহিদা স্থিতিশীল থাকায় এগুলো গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এসব পোশাক সরবরাহে মূল ভূমিকা পালন করে।
তবে প্রতিযোগিতার মাত্রা নির্ভর করে মূল্য নির্ধারণ, বাণিজ্যনীতি এবং উৎপাদন দক্ষতার ওপর। চীনা পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ফাইবার টু ফ্যাশন বাজারের পরিবর্তিত অবস্থানে প্রধান রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান পর্যালোচনা করেছে। যেখানে দেখা গেছে, চীনের ওপর মার্কিন শুল্ক আরোপিত হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য মার্কিন বাজারে এই পণ্য রপ্তানিতে আরও বড় অংশ দখলের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
পুরুষদের সুতি প্যান্ট, ওভারঅল ও শর্টস উৎপাদনে বাংলাদেশ অসাধারণ প্রতিযোগিতামূলক দক্ষতা অর্জন করেছে, যার প্রতিফলন দেখা যায় রিভিলড কম্প্যারেটিভ অ্যাডভান্টেজেস বা তুলনামূলক সুবিধার সূচকে (আরসিএ—আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে ব্যবহৃত একটি সূচক, যা বাণিজ্য প্যাটার্নের ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট পণ্য বা পরিষেবা উৎপাদন ও রপ্তানিতে একটি দেশের আপেক্ষিক শক্তি পরিমাপ করে।)। এই সূচকে বাংলাদেশের পয়েন্ট ১৩১ দশমিক ৯১। এর মানে হলো, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এই পণ্য উৎপাদনে বিশেষভাবে দক্ষ।
বাংলাদেশ প্রতি কেজি মাত্র ১৩ দশমিক ৫৩ ডলার ইউনিট মূল্য বা ইউভিআর (ইউভিআর—ইউনিট ভ্যালু রিয়ালাইজেশন বলতে বোঝায় রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের প্রতি ইউনিটের দামের অর্থনৈতিক মূল্য। অর্থাৎ, প্রতি একক রপ্তানি করে কত টাকা পাওয়া গেল, সেটাই ইউনিট ভ্যালু রিয়ালাইজেশন।) নিশ্চিত করে এই পণ্য সরবরাহ করছে, যা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। আরসিএ-এর উচ্চমান ও কম ইউভিআর-এর কারণে বাংলাদেশ এই খাতে শীর্ষ সরবরাহকারী হিসেবে আধিপত্য ধরে রেখেছে। কম খরচে উৎপাদন ও প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণ বাংলাদেশকে আরও শক্তিশালী অবস্থানে রেখেছে।
মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী মেক্সিকো। কিন্তু দেশটির আরসিএ মাত্র ১ দশমিক ০৫ হওয়ায় দেশটি খুব একটা শক্ত প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দিতে পারে না ক্রেতাদের। এ ছাড়া, মেক্সিকোর বাংলাদেশের তুলনায় বেশি, প্রতি কেজিতে ১৪ দশমিক ৬৪ ডলার। ফলে মূল্য প্রতিযোগিতায় মেক্সিকো অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থানে আছে।
অধিকন্তু, ২০২৫ সালের ৪ মার্চ থেকে যুক্তরাষ্ট্র মেক্সিকো থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে (যদিও যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো রপ্তানি চুক্তির আওতাভুক্ত পণ্য এতে অন্তর্ভুক্ত নয়)। এই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে মেক্সিকোর প্রতিযোগিতার সক্ষমতা আরও কমে যাবে, বিশেষ করে বাংলাদেশ যখন কম খরচে সুতি পোশাক সরবরাহ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি হওয়ায় মেক্সিকো কিছুটা সুবিধা পেলেও শুল্ক বৃদ্ধির ফলে এটি পুরো বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এই পণ্যের অন্যতম উৎপাদক দেশ ভিয়েতনাম বাজার সম্প্রসারণে আগ্রহী হলেও উচ্চ মূল্যের চ্যালেঞ্জের কারণে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। ভিয়েতনামের আরসিএ ২ দশমিক ০৭, যা একটি মাঝারি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা নির্দেশ করে। তবে দেশটির ইউভিআর অত্যন্ত বেশি, প্রতি কেজিতে ব্যয় ২০ দশমিক ৬৩ ডলার, যা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। যদিও সরবরাহ চেইন দক্ষতার কারণে লজিস্টিকস পারফরম্যান্স সূচকে (এলপিআই) সূচকে ভিয়েতনাম কিছুটা এগিয়ে, তবে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার ঘাটতি ও উচ্চ মূল্যের কারণে এটি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দুর্বল অবস্থানে আছে।
শক্তিশালী প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা থাকার পরও বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পাকিস্তান। পাকিস্তান উচ্চ আরসিএ, ৫৪ দশমিক ০৫ নিয়ে এই বাজারে শক্ত প্রতিযোগী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দেশটির ইউভিআর প্রতি কেজিতে ১২ দশমিক ৮০ ডলার, যা বাংলাদেশের তুলনায় সামান্য কম, তবে তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী। কম খরচের কারণে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আরও শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে।
চীন প্রতিযোগিতায় দুর্বল এবং শুল্ক চাপের কারণে আরও সংকটে পড়েছে। চীনের আরসিএ মাত্র শূন্য দশমিক ৪৬, যা দেখায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের প্রতিযোগিতা অনেকটাই দুর্বল। তবে চীনের ইউভিআর অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম, মাত্র ৯ দশমিক ২৩ ডলার প্রতি কেজি।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতির ফলে চীনের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা কমে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত চীনা রপ্তানির ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। ৪ মার্চের পর এই শুল্কহার ২০ শতাংশে উন্নীত হবে। ফলে চীনা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং প্রতিযোগিতায় আরও পিছিয়ে পড়বে।
প্রথম দফায় ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে চীনের ইউভিআর বেড়ে প্রতি কেজিতে ১০ দশমিক ১৫ ডলারে দাঁড়াতে পারে, যার ফলে উৎপাদন ও রপ্তানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। পরের ধাপে ২০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে ইউভিআর আরও বেড়ে ১১ দশমিক ০৮ ডলার প্রতি কেজি বা তার বেশি হতে পারে। এর ফলে চীনের তুলনামূলক কম দামি পণ্যও উচ্চমূল্যের পণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে, যা প্রতিযোগিতায় তাদের আরও পিছিয়ে দেবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ শীর্ষে আছে। কারণ, বাংলাদেশ একই সঙ্গে সবচেয়ে বেশি আরসিএ ১৩১ দশমিক ৯১ ও বলা চলে, সবচেয়ে (দুই একটি দেশ বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে) কম ইউভিআর নিশ্চিত করছে। কম খরচে উৎপাদন ও উচ্চ পরিমাণ রপ্তানি সক্ষমতা বাংলাদেশকে এই খাতে সবার থেকে এগিয়ে রেখেছে।
পাকিস্তান প্রতিযোগিতায় শক্ত অবস্থানে থাকলেও, বাংলাদেশের বাজার দখল করা কঠিন। ভিয়েতনাম ও মেক্সিকো উচ্চ ইউভিআর এবং দুর্বল আরসিএ-এর কারণে স্পষ্টতই পিছিয়ে। চলতি বছরের ২ এপ্রিল নতুন শুল্কনীতি ঘোষিত হলে মেক্সিকোর প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা আরও কমে যেতে পারে। চীন তার ঐতিহাসিক অবস্থান হারাচ্ছে। ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বৃদ্ধির ফলে চীনা পণ্যগুলোর খরচ বেড়ে যাচ্ছে, ফলে এটি কম দামি পোশাক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না।
নতুন মার্কিন শুল্ক কাঠামোর আলোকে বাংলাদেশই সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। কম উৎপাদন ব্যয়, উচ্চ প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে স্থিতিশীল রপ্তানি প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ আরও বড় বাজার শেয়ার দখল করতে সক্ষম হবে।