একটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রধান নির্দেশক হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এটি মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ, যা আমদানি ব্যয় মেটানো, মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করা এবং বৈদেশিক দেনা পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের ঘরে ওঠানামা করছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ ও অর্থ পাচার অনেকটা বন্ধ থাকলেও ২১ বিলিয়নের গণ্ডি পার হয়নি রিজার্ভ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে আমদানি ব্যয় সংকুচিত করা ছিল। সম্প্রতি সংকট ঠেকাতে আমদানি বাড়ানো হয়েছে। যে কারণে রিজার্ভ একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য বলছে, চলতি মাসের ৬ তারিখ পর্যন্ত দেশের গড় রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৬০ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৬৬০ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১৪০ কোটি ডলার। তারও আগে সদ্য সমাপ্ত ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখ পর্যন্ত দেশের গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ১৩ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৬১৩ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৯০ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৯০ কোটি ডলার।
তবে গত ৭ মার্চ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল বাবদ ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন বা ১৭৫ কোটি ডলার পরিশোধ করে বাংলাদেশ। এতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভ কমে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে তথ্য হালনাগাদ করা হয়নি।
বিপিএম-৬ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুনে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৩ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তা ছিল ১৯ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। ওই বছরের জুন শেষে রিজার্ভ দাঁড়ায় ২১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে। আর সর্বশেষ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি তা ২০ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আকুর বিল পরিশোধের পর দেশের গড় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫২৩ কোটি ডলার বা ২৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী, ১ হাজার ৯৯৫ কোটি ডলার বা ১৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার।
গড় রিজার্ভ ও বিপিএম-৬ এই দুই হিসাবের বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের আরও একটি হিসাব রয়েছে, সেটি হচ্ছে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ। এ তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে শুধু আইএমএফকে জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ হিসাবে আইএমএফের এসডিআর খাতে থাকা ডলার, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে থাকা বৈদেশিক মুদ্রা এবং আকুর বিল বাদ দিয়ে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের হিসাব করা হয়। সেই হিসাবে দেশের ব্যয়যোগ্য প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৫ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা ওপরে। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। দেশে সে পরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে। আর নিট রিজার্ভ গণনা করা হয় আইএমএফের ‘বিপিএম-৬’ পরিমাপ অনুসারে। মোট রিজার্ভ থেকে স্বল্পমেয়াদি দায় বাদ দিলে নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ পাওয়া যায়।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করা হয়েছে। রিজার্ভ বাড়াতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আমরা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছি। অন্যদিকে, রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়ছে। ডলারের বাজার স্থিতিশীল আছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকেও রিজার্ভ সহায়তা পাওয়ার আশ্বাস মিলেছে। ফলে এখন আর রিজার্ভ কমবে না। ধীরে ধীরে বাড়বে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে গড় রিজার্ভ ছিল ২৯ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম-৬ অনুযায়ী ছিল ২৩ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। তবে বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব আছে, যা শুধু আইএমএফকে (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) দেওয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেই হিসাবে দেশের ব্যবহারযোগ্য প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। প্রতি মাসে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো কষ্টসাধ্য হবে বাংলাদেশের জন্য। দীর্ঘদিন ধরেই বিপিএম-৬ অনুযায়ী, ২০ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে রিজার্ভ। অনেকটা ২০ বিলিয়নের ফাঁদে আটকে গেছে রিজার্ভ। বর্তমানে রেমিট্যান্সপ্রবাহ ভালো। রপ্তানিও শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। তা সত্ত্বেও রিজার্ভ একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতেই আটকে আছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ বন্ধ হয়েছে সত্য। কিন্তু আমাদের আমদানি খরচও বেড়েছে। সম্প্রতি সময়ে সংকট ঠেকাতে ব্যাপক ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানি সংকট ঠেকাতেও তা আমদানি করা হয়েছে। সে তুলনায় রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স আসছে না। যার কারণে রিজার্ভের পরিমাণটা স্থিতিশীল রয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১২ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। সাত বছর আগে ছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছায়। ওই বছর ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে। এরপর তা বেড়ে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশের রিজার্ভ রেকর্ড গড়ে ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট। ওইদিন রিজার্ভ ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার ৮০৪ কোটি ডলারে উঠে যায়। এরপর ডলার সংকটে গত বছর থেকে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৩২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৩৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন। ২০২০-২১ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার এবং সব শেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৩১ বিলিয়ন ডলার ও ২০২৩-২৪ সালে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ২৭ বিলিয়ন ডলার।
মূলত প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ থেকে যে ডলার পাওয়া যায়, তা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তৈরি হয়। আবার আমদানি ব্যয়, ঋণের সুদ বা কিস্তি পরিশোধ, বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা, পর্যটক বা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাসহ বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় হয়ে থাকে, তার মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রা চলে যায়। এভাবে আয় ও ব্যয়ের পর যে ডলার থেকে যায়, সেটাই রিজার্ভে যুক্ত হয়। আর বেশি খরচ হলে রিজার্ভ কমে যায়।