ক্যাসপারের জন্য ভালোবাসাঃ রাকিব কিশোর
চার বছরের ছোট্ট এই বাবুর নাম ক্যাসপার। পুরো নাম মোহাম্মদ সাদমান ক্যাসপার। তার পাহাড়ে ঘোরাঘুরি পাগল বাবা তাকে খুব আদর করে ‘ভূত’ নামে ডাকে। এই ভূতের বাবা চট্টগ্রামের ট্রেকিং–ভক্তদের মধ্যে জনপ্রিয় নাম, কালপুরুষ অপু, পুরো নাম তোফাজ্জল হোসেন।
চার বছরের এই ছোট্ট ভূতটা গত ১৯ আগস্ট ভর্তি হয়েছিল হাসপাতালে। পেটে তাজা রক্ত এসে জমা হচ্ছিল তার, সেই রক্ত বের হয়ে যাচ্ছিল পায়খানার সঙ্গে। দিশেহারা মা-বাবা তাকে ভর্তি করালেন চট্টগ্রামের রয়্যাল হাসপাতালে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো, সিদ্ধান্ত হলো অস্ত্রোপচার করে পেটে জমা রক্ত বের করে ফেলতে হবে। কিন্তু পুরো পেট ওয়াশ করার পরও কীভাবে রক্ত বেরোচ্ছে, সেটার কোনো আলামত পাওয়া গেল না। অথচ রক্ত এসে জমা হচ্ছে।
শুরু হলো আতঙ্কের দিন, রোগই যদি ধরতে না পারা যায়, তাহলে তার চিকিৎসা হবে কীভাবে! চট্টগ্রামের চিকিৎসকেরা ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন। ২৬ আগস্ট রাজধানীর পথে রওনা দেয় ছোট্ট ‘ভূত’। রাতে এসে ভর্তি হয় সেন্ট্রাল হাসপাতালে, পরদিন সকালে বিএসএমএমইউতে।
ততক্ষণে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয় ছড়িয়ে পড়েছে ক্যাসপার, খবর হয়েছে ছোট্ট ভূত অসুস্থ।
ক্যাসপারহাসপাতালের বাইরে রক্ত দেওয়ার জন্য জড়ো হলো প্রায় শ দুয়েক মানুষ, যার কাছে যা ছিল, তা-ই পাঠিয়ে দেওয়া শুরু হতে লাগল তার বাবার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। ঘোরাঘুরি-পাগল বাবার কল্যাণে এই চার বছর বয়সেই বাবুটা সিলেট, সীতাকুণ্ডের পাহাড় পাড়ি দিয়ে ফেলেছে, কক্সবাজারের সাগরের পানি যেমন ধরেছে, তেমনি করে ছুঁয়ে দেখেছে বান্দরবানের মেঘও। সেই বাবুকে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিল অগণিত মানুষ।
একজন ফোন দিয়ে বলছেন, ‘ভাইয়া, আমি তো বেকার, তাই ক্যাসপারের চিকিৎসায় টাকা দিতে পারছি না। তবে আমার গায়ে রক্ত আছে ভাইয়া, ও পজিটিভ রক্ত, কতগুলা লাগবে একবার খালি বলেন।’
অন্য একজন বললেন, ‘ভাইয়া, আমি গত সপ্তাহে টিউশনির টাকা জমিয়ে গিটার কিনেছি। বিশ্বাস করেন, একদম নতুন এখনো। যেদিন ক্যাসপারের রোগটা জানতে পারব, সেদিন বিক্রি করে তার বাবার হাতে টাকা দিয়ে আসব।’
কিছুতেই তার রক্তপাত বন্ধ হচ্ছিল না, অনবরত রক্তপাত ভয় পাইয়ে দিল ডাক্তারদেরও। শেষমেশ আট সদস্যের এক চিকিৎসক দল তার আগের অপারেশনের জায়গাতেই আবার অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিল। সেদিন রাতে অপারেশনের পরে আমাদের ছোট্ট ‘ভূত’ কথা বলেছে, নিজের নাম বলেছে, মা-বাবার নাম বলেছে। আমরা খুব খুশি, ভোররাতে ডাক্তাররাসহ সবাই মিলে খুশিতে কোলাকুলি করলো। পুরো দুনিয়াকে যে যার প্রোফাইল থেকে পোস্ট দিয়ে জানিয়ে দিলাম যে আমাদের ক্যাসপার সুস্থ আছে।
কিন্তু ছেলেটা আবার অসুস্থ হয়ে গেল পরদিন দুপুর থেকেই। এবারে সমস্যাটা পেটে না, শনাক্ত করা হলো তার ফুসফুসে। সে শ্বাস নিতে পারছে না। আইসিইউ সাপোর্টের জন্য রাতে তাকে স্থানান্তর করা হলো রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে। সেখানে রাত দুইটা থেকে ক্যাসপারের অবস্থার চরম অবনতি হলো। তাকে ভেন্টিলেশন দেওয়া হলো, পুরো রাত চলল লাইফ সাপোর্টে। পরের ৩৬ ঘণ্টা ক্যাসপার কাঁদিয়ে বেড়াল তার মা-বাবা ও শুভাকাঙ্ক্ষী সবাইকে।
২৯ আগস্ট বিকেলে তাকে শক দেওয়া হলো তার মস্তিষ্ক কাজ করছে কি না, তা দেখার জন্য। ক্যাসপার সাড়া দিল। তার মস্তিষ্ক কাজ করছে, কিন্তু থমকে গেছে শরীর। ক্যাসপার অপারেশনে যাওয়ার আগে বাবার কাছে আইসক্রিম খেতে চেয়েছিল। যারাই তাকে দেখতে গিয়েছিল, সবার কাছে চকলেট খেতে চেয়েছিল। হাসপাতালে রোগীদের জন্য নিয়ে আসা খাবার দেখে হাউমাউ করে কেঁদে বারবার বলছিল, ‘আমাকে একটু ভাত দাও মা, আমি কত দিন ভাত খাই না, ডাল দিয়ে হলেও একটু ভাত দাও আমাকে মা।’ কিন্তু তার তো মুখে কোনো খাবার খাওয়া নিষেধ। ডাক্তাররা বলে দিয়েছিলেন, যেকোনো ফলাফল মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এখন কেবল অলৌকিক কিছু ঘটলেই ক্যাসপার ফেরত আসতে পারে।
বাবার সঙ্গে ক্যাসপারক্যাসপারের জীবনে অলৌকিক কিছু ঘটেনি। ৩০ আগস্ট বিকেল আনুমানিক চারটার দিকে চলে গেল ক্যাসপার—চিরতরে। হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, অপারেশন থিয়েটার, আইসিইউ, অ্যাম্বুলেন্স, লাইফ সাপোর্ট, তার বাবার সব বন্ধুবান্ধব, ভাইবোন আর সারা দেশের অনেক মানুষ, সবাই মিলেও তাকে বাঁচাতে পারলাম না।
যে ছেলেটা এই ধূসর শহরে বাঁচার জন্য এসেছিল, সে এখন চোখ বুজেছে জন্মস্থান রাউজানের মাটিতে। ৩১ আগস্ট সকালে তার দাফন হয়েছে।
জানিস ক্যাসপার, তোকে এক নজর দেখার জন্য আট মাসের গর্ভবতী মা চলে এসেছেন হাসপাতালে, হুইলচেয়ারে বসে থাকা এক বৃদ্ধ এসে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে খুঁজেছে তোকে, সুদূর ইংল্যান্ড থেকে চলে এসেছেন অচেনা-অজানা তোকে মন থেকে ভালোবাসা মানুষটা।
তুই চলে যাওয়ার পরদিন তোর বাবা বললেন, ‘আমার পোলাটারে ১১ দিন পানি খাইতে দিতে পারি নাই, আমার ক্যাসপার আমার থেকে পানি চাইসে, আমি তার মুখে পানি দিতে পারি নাই, আমি ক্যামনে পানি খামুরে কিশোর, আমি ক্যামনে পানি খামু...।’
আমাদের ক্যাসপার এই বয়েসই জেনে এসেছে, সত্য মানে বাংলাদেশ। বাবাকে সে খুব আবদার নিয়ে বলত, ‘বাবা, তুমি আমার সাথে মিথ্যা কথা বলবা না...তুমি আমার সাথে সব সময় বাংলাদেশি কথা বলবা। ঠিক আছে!’
আমরা সবাই খুব করে চেয়েছিলাম, আমাদের ছোট্ট ভূতটা সুস্থ হয়ে উঠুক, ছোট্টবেলার মতন বড় হয়েও সে সবার সঙ্গে ‘বাংলাদেশি কথা’ বলুক।
কিন্তু আমাদের ছোট্ট ভূতটা অনেককে কাঁদানোর ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিল।
ভালো থাকিস ছোট্ট ‘ভূত’।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
I as well as my buddies appeared to be going through the great tactics from your web page while at once I got a horrible suspicion I never expressed respect to the web site owner for those tips. Most of the young men ended up for this reason excited to see all of them and have in truth been taking pleasure in these things. Appreciate your truly being quite helpful and then for obtaining this kind of quality tips most people are really eager to understand about. My sincere apologies for not expressing gratitude to sooner.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন