‘বদ নজর’ কি ভ্রান্ত বিশ্বাস? কী বলে ইসলাম?
প্রশ্নঃ আগে মুরুব্বিদের থেকে শুনে এসেছি, তারা বদ নজর বিশ্বাস করতেন এবং এ থেকে বেঁচে চলার চেষ্টা করতেন। কিন্তু ইদানীং কোনো কোনো মানুষকে বলতে শুনছি, এসব নাকি শুধুই ভ্রান্ত চিন্তা-বিশ্বাস। এ ব্যাপারে কুরআন-হাদিসে কোনো দলীল বিদ্যমান থাকলে জানানোর সবিনয় অনুরোধ করছি।
উত্তরঃ নজর লাগা বা বদ নজর লাগা সত্য বিষয়। কুরআন থেকে এ বিষয়ে দলিল পাওয়া যায়। একাধিক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বদ নজরের কু-প্রভাব ও প্রতিকারের পদ্ধতি বলে দিয়েছেন।
কুরআন থেকে বদ নজরের দলিলঃ
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন-
وَقَالَ يَا بَنِيَّ لَا تَدْخُلُوا مِنْ بَابٍ وَاحِدٍ وَادْخُلُوا مِنْ أَبْوَابٍ مُتَفَرِّقَةٍ وَمَا أُغْنِي عَنْكُمْ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَعَلَيْهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُونَ، وَلَمَّا دَخَلُوا مِنْ حَيْثُ أَمَرَهُمْ أَبُوهُمْ مَا كَانَ يُغْنِي عَنْهُمْ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا حَاجَةً فِي نَفْسِ يَعْقُوبَ قَضَاهَا وَإِنَّهُ لَذُو عِلْمٍ لِمَا عَلَّمْنَاهُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
অর্থঃ এবং (ইয়াকুব আলাইহিস সালাম) বললেন হে আমার প্রিয় সন্তানগণ! তোমরা সবাই (শহরে) কোন এক প্রবেশ পথে প্রবেশ করো না বরং বিভিন্ন প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করো। আমি তোমাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা কোনো বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারব না। কেননা প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী কেবল আল্লাহ। তার উপর আমার আস্থা রয়েছে। ভরসাকারীকে ভরসা করলে তার প্রতিই করতে হবে। আর যখন তারা দিয়েছিলেন অথচ আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত কোনো কিছু থেকে কেউ রক্ষা করতে পারে না। তবুও ইয়াকুবের (আলাইহিস সালাম) অন্তরে একটি আশা ছিল যে, তিনি তা পূর্ণ করেছেন। নিশ্চয় তিনি ইলমের (নবুওয়াতের) বাহক ছিলেন। অথচ অনেক লোক তা জানে না। –সূরা ইউসুফঃ ৬৭-৬৮
আল্লামা ইবনে কাসীর (র.) উপরোক্ত আয়াত দুটির ব্যাখ্যায় বলেছেন, এটা সেই সময়ের ঘটনা যখন ইয়াকুব (আ.) ইউসুফ (আ.)-এর ভাই বিন ইয়ামিনকে তার অন্য ভাইদের সাথে মিশরে পাঠিয়েছিলেন। আয়াতে ইয়াকুব (আ.)-এর উক্ত নির্দেশনার ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস (রা.) মুহাম্মাদ বিন কা’ব, মুজাহিদ, যাহহাক, কাতাদা এবং সুদী (র.) প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ বলেছেন, এমনটি তিনি বদ নজরের ভয়ে বলেছিলেন। কারণ, তার সন্তানরা খুবই সুন্দর সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন। তাই তাদের উপর লোকদের বদ নজরের আশঙ্কা করে তিনি উক্ত নির্দেশ দেন। কেননা, বদ নজরের ক্রিয়া বাস্তব; কিন্তু পরে তিনি এও বলেনঃ তবে এ ব্যবস্থা আল্লাহর তাকদিরকে প্রতিহত করতে পারবে না। তিনি যা চাইবেন তাই হবে। পরিশেষে তা তাদের জন্য বদ নজর হতে প্রতিরোধক হিসেবেই আল্লাহর হুকুমে কাজ হয়েছিল। –তাফসীর ইবনে কাসীরঃ ২/৪৮৫
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
وَإِنْ يَكَادُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَيُزْلِقُونَكَ بِأَبْصَارِهِمْ لَمَّا سَمِعُوا الذِّكْرَ وَيَقُولُونَ إِنَّهُ لَمَجْنُونٌ
অর্থঃ কাফিররা যখন উপদেশ বাণী (কুরআন) শ্রবণ করে তখন তারা যেন তাদের তীক্ষ্ম দৃষ্টি দ্বারা তোমাকে আছড়িয়ে ফেলতে চায় এবং বলে— সে তো এক পাগল। (সূরা কলামঃ ৫১)
আল্লামা ইবনে কাসীর (র.) ইবনে আব্বাস (রা.) এবং মুজাহিদ (র.) থেকে বর্ণনা করেন যে, (لَيُزْلِقُونَكَ) “তোমার প্রতি বদনজর দিবে।” অর্থাৎ তারা তোমাকে হিংসার প্রতিফলন ঘটিয়ে রুগী বানিয়ে দিবে যদি আল্লাহর তোমার প্রতি হেফাযত না থাকে। আয়াতটি প্রমাণ বহন করে যে, বদনজরের কুপ্রভাবের বাস্তবতা রয়েছে, আল্লাহর হুকুমে। যেমন এ ব্যাপারে হাদিসও রয়েছে। –তাফসীর ইবনে কাসীরঃ ৪/৪১০)
হাদিস থেকে বদ নজরের প্রমাণঃ
১। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, নবী (সা.) এরশাদ করেনঃ
عن ابى هريرة قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم العين حق
“বদ নজর সত্য।” -বুখারীঃ ১০/২১৩
অর্থাৎ এর বাস্তবতা রয়েছে, এর কুপ্রভাব লেগে থাকে।
২। আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ
استعيذوا بالله من العين فإن العين حق
তোমরা বদ নজরের ক্রিয়া (খারাপ প্রভাব) থেকে রক্ষার জন্যে আল্লাহ তায়ালার সাহায্য প্রার্থনা কর। কেননা তা সত্য। -ইবনে মাযাহঃ ৩৫০৮
৩। ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন যে, নবী (সা.) বলেছেনঃ
العين حق ولو كان شيء سابق القدر لسبقته العين ، وإذا استغسلتم فاغسلوا
বদ নজর (এর খারাপ প্রভাব) সত্য এমনকি যদি কোন বস্তু তাকদিরকে অতিক্রম করতো তবে বদ নজর তা অতিক্রম করত। সুতরাং তোমাদেরকে যখন (এর প্রভাবমুক্ত হওয়ার জন্য) গোসল করতে বলা হয় তখন তোমরা গোসল করো। -মুসলিমঃ ১৪/১৭১
উপরোল্লিখিত কুরআনের আয়াত ও হাদিস থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হলো যে বদ নজর সত্য। এমন আরও অনেক সহিহ হাদিস কেউ বদ নজরে আক্রান্ত হলে এর প্রতিকার সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। তাই স্বল্পজ্ঞান থেকে যে কোনো কিছুকেই নাকচ করে দেওয়া অনুচিত।