Image description

ডিজিটাল বিপ্লব মানুষের যোগাযোগের ধরন পাল্টে দিয়েছে। এক সময় যেখানে পরিচয়, বন্ধুত্ব কিংবা প্রেম সামাজিক পরিসরেই সীমাবদ্ধ থাকত, এখন সেই পরিচয়ের শুরু হয় আঙুলের এক টাচে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম দ্রুত, সহজ ও গোপনীয় উপায়ে সঙ্গী খুঁজতে চায়- যার ফলে ডেটিং অ্যাপগুলোর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। টিন্ডার, বাম্বল, আলি-ম্যাচ, আজার কিংবা ফেসবুক ডেটিং- এসব প্ল্যাটফর্মে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ‘মনের মানুষ’ খোঁজার আশায় ভিড় জমাচ্ছে। কিন্তু সম্পর্কের এই ডিজিটাল দুনিয়ার পেছনে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর কিছু ছায়া। প্রেমের মোড়কে, বন্ধুত্বের নামে কিংবা বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে প্রতিনিয়ত ঘটছে আর্থিক প্রতারণা, মানসিক নির্যাতন, ব্ল্যাকমেলিং, এমনকি বড় ধরনের অপরাধের পরিকল্পনাও। সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন- ডেটিং অ্যাপ এখন শুধু সম্পর্কের প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে সাইবার অপরাধীদের অন্যতম বড় ‘হান্টিং গ্রাউন্ড’। অনেকে প্রেম, বন্ধুত্ব বা একাকিত্ব দূর করতে এসব অ্যাপ ব্যবহার করেন। কিন্তু সামান্য অসতর্কতায় বিপদের গভীরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ব্যাপকভাবে।
ডেটিং অ্যাপ: সুবিধা ও ভয়ঙ্কর ফাঁদের দ্বৈত বাস্তবতা
ডেটিং অ্যাপ মূলত দুই পক্ষকে স্বেচ্ছায় পরিচিত হওয়ার সুযোগ দেয়। নিজের ছবি, আগ্রহ, পেশা, বয়স উল্লেখ করে প্রোফাইল তৈরি করলে অ্যাপ মানব-মনস্তত্ত্ব, অবস্থান ও পছন্দ ভেদে ম্যাচ প্রস্তাব করে। এর মধ্যে ভালো কিছু সম্পর্ক যেমন তৈরি হয়, তেমনি অসংখ্য মানুষ প্রতারণার শিকারও হন।
সাইবার বিশেষজ্ঞদের মতে, “ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করা মানেই বিপদ নয়, কিন্তু সতর্কতা না থাকলে বিপদ যে কোনো সময় এসে ধরা দিতে পারে।” কারণ অপরাধীরা এসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে নতুন ধরনের ছলচাতুরীর অস্ত্র হিসেবে।
ডেটিং অ্যাপে কোন কোন ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হবেন?
নিচে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত এবং ভয়ঙ্কর প্রতারণার ধরনের বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে-
ক্যাটফিশিং (ঈধঃভরংযরহম): ভুয়া পরিচয়ের দুনিয়ায় ফেঁসে যাওয়া। ক্যাটফিশিং হলো ভুয়া প্রোফাইল ব্যবহার করে কাউকে প্রেম বা বিশ্বাসের ফাঁদে ফেলা।
অপরাধীরা- আকর্ষণীয় ছবি চুরি করে প্রোফাইল বানায়। উচ্চপদস্থ চাকরি বা প্রভাবশালী পরিচয় দাবি করে। ধীরে ধীরে পরিচয় গভীর করে। এরপর কোনো না কোনো অজুহাতে টাকা দাবি করে।
উদাহরণস্বরূপ- "আমার মা অসুস্থ, টাকার প্রয়োজন", "ভ্রমণে আটকে গেছি",
"ব্যাংক সমস্যায় পড়েছি" ইত্যাদি।
শিকার সাধারণত আবেগে পড়ে সহানুভূতি দেখিয়ে সাহায্য করতে যায় এবং এখানেই ঘটে আর্থিক ক্ষতি।
ক্যাটফিশিং শুধু আর্থিক প্রতারণাই নয়; ব্যক্তি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়, অনেকে ডিপ্রেশনে চলে যান।
রোম্যান্স স্ক্যাম: প্রেম দিয়ে ব্ল্যাকমেলিং
ডেটিং অ্যাপে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রতারণার একটি হলো রোম্যান্স স্ক্যাম। এখানে প্রথমে অপরাধী দীর্ঘদিন ধরে প্রেমের সম্পর্ক গড়ার অভিনয় করে। ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত ছবি/ভিডিও চাইতে থাকে।
বিশ্বাস তৈরি হওয়ার পর ভুক্তভোগী তা পাঠিয়ে ফেললে সেই ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেল শুরু হয়।
হুমকি দেওয়া হয়- এসব ছবি পরিবারে পাঠানো হবে, ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হবে, কর্মস্থলে জানিয়ে দেওয়া হবে।
ফলে ভুক্তভোগী মানসিক চাপের মুখে পড়েন এবং অনেকেই টাকা দিতে বাধ্য হন।
সাইবার বিশেষজ্ঞদের মতে, “রোম্যান্স স্ক্যাম দ্রুত বেড়ে চলা ডিজিটাল অপরাধগুলোর একটি।”

স্পাইওয়্যার: ফোনে গুপ্তচর বসিয়ে ফেলা
ডেটিং অ্যাপের বড় ঝুঁকি হলো ম্যালওয়্যার ও স্পাইওয়্যার ইনস্টল করিয়ে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করা। প্রক্রিয়াটি সাধারণত এভাবে হয়- প্রথমে অপরাধী বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক গড়ে তোলে। বিশ্বাস অর্জনের পর একটি লিংক পাঠায়। বলে- “এটা আমার ছবি/ভিডিও”, “গিফট কার্ড দেখো”, “এটা খুললে আমাকে দেখতে পাবে”, ব্যক্তি লিংকে ক্লিক করলেই ফোনে স্পাইওয়্যার ইনস্টল হয়।
এরপর- ব্যক্তিগত ছবি, বার্তা, ফোনবুক, ব্যাংক অ্যাপের পাসওয়ার্ড ঙঞচ, মেসেজ, সবকিছু অপরাধীরা সংগ্রহ করতে পারে। এটি মূলত ‘ফিশিং’-এর আধুনিক রূপ।
আর্থিক প্রতারণা: ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করার টার্গেট
কিছু অপরাধী ডেটিং অ্যাপে বন্ধুত্ব করে ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করে ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেয়- ঘওউ/পাসপোর্ট তথ্য, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ডের তথ্য, পিন বা ঙঞচ, ইমেইল পাসওয়ার্ড ।
একবার এসব তথ্য পেয়ে গেলে- অ্যাকাউন্ট ফাঁকা, অনলাইন লোন, ফেক লেনদেন, সবকিছুই খুব সহজে হয়ে যায়।
চুরি হওয়া এই ডেটা পরে ডার্ক ওয়েবে বিক্রি হয়- যা পরবর্তী বড় অপরাধের জন্ম দেয়।
বড় ধরনের অপরাধের গুপ্তচরবৃত্তি
অনেক ক্ষেত্রে ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করে অপরাধীরা- কোনো এলাকার সিকিউরিটি তথ্য সংগ্রহ। সরকারি/বেসরকারি অফিসের কর্মীদের তথ্য। সামরিক বা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অবস্থান।
গুরুত্বপূর্ণ নথি বা ছবি চুরি
এসব ঘটনার পেছনে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র থাকে। একবার শিকার এ ধরনের চক্রে জড়িয়ে গেলে পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে পারে। কেন তরুণরা সহজেই প্রতারণার শিকার হয়? মনস্তত্ত্ববিদরা কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন-
একাকিত্ব: অনেকেই বন্ধুহীনতা বা আবেগীয় শূন্যতার কারণে দ্রুত সম্পর্ক চান। অপরাধীরা এই দুর্বলতাকে লক্ষ্য করে।

‘পারফেক্ট ম্যাচ’ এর মোহ: ডেটিং অ্যাপে যাকে দেখি তিনি বাস্তবেও তেমনই হবে—এই ভ্রান্ত বোধ অনেককে বিপদে ফেলে।

অতিরিক্ত বিশ্বাস: প্রথম পরিচয়েই ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা একটি সাধারণ ভুল।
সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চাপ: প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ কমে যায়। অপরাধীরা এই সুযোগ নেয়।
কীভাবে বুঝবেন আপনি প্রতারণার টার্গেট?
হঠাৎ করে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা দেখানো, আর্থিক সাহায্য চাইতে থাকা, ভিডিও কল এড়ানো, নিজের পরিবার/অতীতের কথা অস্পষ্ট রাখা, অদ্ভুত লিংক পাঠানো, ব্যক্তিগত ছবি/ভিডিও চাওয়া, বিদেশ থেকে এসেছে কিন্তু দেশে আসতে টাকা চাচ্ছে- এ ধরণের গল্প। এসব লক্ষণ দেখলে সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ করাই নিরাপদ।
সন্দেহ হলে সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট করুন
ডেটিং অ্যাপ এবং পুলিশ সাইবার ক্রাইম ইউনিটে অভিযোগ করতে পারেন। একটি সত্য ঘটনা (বাস্তব অনুপ্রাণিত উদাহরণ)
রাজধানীর এক তরুণী ফেসবুক ডেটিং-এ পরিচিত হন এক তরুণের সঙ্গে। ছেলেটি নিজেকে ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে কিছুদিন খুব কাছাকাছি সম্পর্ক তৈরি করে। একসময়ে সে বলে, “মা অসুস্থ, অপারেশন লাগবে, একটু সাহায্য করলে ফিরিয়ে দেব।” তরুণী একাধিকবার টাকা পাঠানোর পর দেখতে পান সে হঠাৎ অদৃশ্য। পরে জানা যায়- ছবিগুলোও নকল, পরিচয়ও ভুয়া। তার পাঠানো টাকায় প্রতারক বিদেশে চলে গেছে। এমন ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে।
ডেটিং অ্যাপ মানুষের যোগাযোগকে সহজ করেছে ঠিকই, কিন্তু একইসঙ্গে খুলে দিয়েছে অপরাধীদের নতুন খেলার মাঠ। প্রেম, বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক- এসব মানবিক অনুভূতির ওপর ভর করে অপরাধীরা আজ ভয়ঙ্কর সব ফাঁদ পেতেছে। তাই ‘মনের মানুষ’ খুঁজতে গেলে চোখ-কান খোলা না রাখলেই বিপদ। ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করতে হলে- সতর্কতা, সচেতনতা এবং নিজের নিরাপত্তাঅভ্যাস সবচেয়ে বড় অস্ত্র।

শীর্ষনিউজ