Image description

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার এক কলেজশিক্ষার্থী গত মাসে ফেসবুকে প্রচারিত বিজ্ঞাপন থেকে একটি ওয়েবসাইটের খোঁজ পান। তিনি জানতে পারেন, প্রতিদিন বিজ্ঞাপন দেখে ঘরে বসে মাসে ১০ হাজার টাকা আয় করা যাবে। এর জন্য শুরুতে ১০ হাজার টাকা ওয়েবসাইটটির অ্যাকাউন্টে জমা করতে হবে।

প্রলুব্ধ হয়ে এই কলেজশিক্ষার্থী একটি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা ওয়েবসাইটটির অ্যাকাউন্টে জমা করেন। কয়েক দিন নিয়মিত ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দেখা শুরু করেন। কিছুদিন পরে ওয়েবসাইটে থাকা এই কলেজশিক্ষার্থীর অ্যাকাউন্টটি ‘ব্লক’ করে দেওয়া হয়। তাঁকে জানানো হয়, অ্যাকাউন্টটি আবার চালু করতে আরও পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে।

সন্দেহ হলে বন্ধুদের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে এই কলেজশিক্ষার্থী জানতে পারেন, ওয়েবসাইটটি প্রতারণামূলক। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও তিনি তাঁর জমা করা টাকা আর তুলতে পারেননি।

এই কলেজশিক্ষার্থীর মতো এমন প্রতারণার ফাঁদে পড়া ভুক্তভোগীর সংখ্যা কম নয়। ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ থেকে বিজ্ঞাপন দিয়ে চালানো হচ্ছে এসব প্রতারণামূলক ওয়েবসাইটের প্রচারণা। এ নিয়ে করা একটি গবেষণা সম্প্রতি প্রকাশ করেছে অনলাইন ভেরিফিকেশন ও মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিসল্যাব।

গবেষণায় উঠে এসেছে, ভিন্ন ভিন্ন নামে খোলা হলেও এসব ওয়েবসাইটের ডোমেইন নাম, হোস্টিং, এমনকি আইপি ঠিকানা অনেক ক্ষেত্রেই এক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব ওয়েবসাইটের পেছনে একটি নির্দিষ্ট চক্র থাকে। তারা বারবার ভিন্ন নামে নতুন ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইট খুলে একই কৌশলে সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে নেয়।

এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও দৃক আইসিটি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম আলতাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি সুসংগঠিত এক বা একাধিক সংঘবদ্ধ চক্রের কাজ। এদের পেজগুলোর পোস্টের নিচে থাকা ইতিবাচক মন্তব্যগুলো লক্ষ করলেও তা নিশ্চিত হওয়া যায়।’

ওয়েবসাইটে সাদৃশ্য

ডিসমিসল্যাব গবেষণায় মেটা অ্যাড লাইব্রেরিতে দুই দিন ‘অ্যাড দেখে ইনকাম করুন’ ও ‘ইনকাম ওয়েবসাইট’—এই দুই কিওয়ার্ড সার্চ করে অন্তত ৩১টি পেজ থেকে এ ধরনের বিজ্ঞাপন চলতে দেখে। এসব বিজ্ঞাপন থেকে ২৫টি ওয়েবসাইট খুঁজে পায় তারা।

ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণ বলছে, প্রতিটি ওয়েবসাইট অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখানোর মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের প্রতিশ্রুতি দেয়। সব কটি ওয়েবসাইটের মূল লগইন পেজে দেখা যায় একটি বৃত্তাকার আইকন, যেখানে সাইটটির লোগো বসানো থাকে। নিচে দেখা যায়, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবার লোগো।

ডিসমিসল্যাবের গবেষণা বলছে, তারা ২৩টি ওয়েবসাইটে একই ধরনের আইকন দেখতে পেয়েছে। লেআউট ছাড়াও অন্যান্য দৃশ্যগত মিল পাওয়া গেছে এসব ওয়েবসাইটে।

ওয়েবসাইটগুলোর ডোমেইন তথ্য বিশ্লেষণ করে ডিসমিসল্যাব দেখেছে, বেশির ভাগের নিবন্ধন করা ২০২৫ সালের এপ্রিল ও মে মাসে। অনেক ক্ষেত্রে একই রেজিস্ট্রার ও হোস্টিং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এগুলো পরিচালিত হচ্ছে।

উদাহরণ হিসেবে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ৫টি ওয়েবসাইট নিবন্ধন করা হয়েছে পিডিআর লিমিটেডের মাধ্যমে। এগুলো হোস্ট করা হয়েছে একই আইপি ঠিকানায়।

যেভাবে কাজ করে

প্রতারণামূলক এ কাজ কীভাবে হয়, তা জানতে ফেসবুকে এ ধরনের বেশ কয়েকটি পেজ বিশ্লেষণ করে প্রথম আলো। ‘ইটস লিয়ান’ নামের একটি পেজ থেকে এ ধরনের একটি ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা, ‘অ্যাড দেখে প্রতিদিন ২০০-৫০০ টাকা খুব সহজেই ইনকাম করুন’।

ভিডিওতে একটি পুরুষকণ্ঠ জানাচ্ছে, শুরুতে একটি ওয়েবসাইট সার্চ করতে হবে। সেখানে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। দুভাবে টাকা উপার্জনের বিষয়ে ধারণা দেয় পুরুষকণ্ঠটি।

তবে টাকা আয় করার জন্য একটি প্যাকেজ কিনতে হবে বলে জানানো হয় ভিডিওতে। এতে বলা হয়, ভিআইপি ১ প্যাকেজ কিনলে ৫০০ টাকা জমা রেখে প্রতিদিন ২০০ টাকা করে আয় করা যাবে। আর ভিআইপি ২ প্যাকেজ কিনলে ১ হাজার টাকা জমা রেখে প্রতিদিন ৪০০ টাকা আয় করা যাবে। প্যাকেজ কেনার জন্য অর্থ পাঠাতে বলা হয় মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে।

জনপ্রিয় ইউটিউবারদের ভিডিও ব্যবহার

ডিসমিসল্যাবের গবেষণায় দেখা গেছে, অনলাইন থেকে সহজে অর্থ উপার্জনসংক্রান্ত এসব ওয়েবসাইটের বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছে পাঁচ থেকে ছয় মিনিটের কিছু ভিডিওর মাধ্যমে।

ভিডিওর শুরুর ৩০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট সময় পর্যন্ত দুটি জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেলের কনটেন্ট নির্মাতার ক্লিপ ব্যবহার করা হয়েছে। দুটি চ্যানেলেই আছে ৪০ লাখের বেশি সাবস্ক্রাইবার। এই অংশে তাঁদের বলতে শোনা যায়, কীভাবে ফেসবুকে ভিডিও দেখে ব্যবহারকারীরা অর্থ উপার্জন করতে পারেন।

এই কনটেন্ট নির্মাতাদের চ্যানেলের মূল ভিডিওগুলো বিশ্লেষণ করেছে ডিসমিসল্যাব। এই ভিডিওগুলোয় ফেসবুকে রিঅ্যাকশন ভিডিও বানানোর মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের কৌশল বলা হয়েছে। সেখানে কোনো ওয়েবসাইটে নিবন্ধন বা অর্থ জমা করার প্রসঙ্গে কথা বলা হয়নি। বিজ্ঞাপনগুলোয় জনপ্রিয় ইউটিউবারদের এমন ভিডিওর শুরুর অংশটুকু দেখানোর পর মোবাইলের স্ক্রিন রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে দেখানো হয়, ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করে অর্থ জমা করার মাধ্যমে কীভাবে কাজ পাওয়া যায়, অর্থ উপার্জন করা যায়। বিজ্ঞাপনে ক্লিক করলে সেটি ব্যবহারকারীদের নিয়ে যায় ওয়েবসাইটে।

‘ভুয়া’ ইতিবাচক মন্তব্য

বিশ্লেষণে ডিসমিসল্যাব দেখেছে, প্রতারণাপূর্ণ ওয়েবসাইটগুলোর বিজ্ঞাপন ফেসবুকে ব্যাপকভাবে প্রচার সত্ত্বেও কিছু ব্যবহারকারী এ বিষয়ে অন্যদের সতর্ক করেছেন।

পেজের কোনো কোনো পোস্টে ১০০ জনের বেশি ব্যবহারকারী লিখেছেন, তাঁরা অর্থ জমা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। তবে এই সতর্কবার্তাগুলো চাপা পড়ে যায় বিপুলসংখ্যক ‘ইতিবাচক’ মন্তব্যের নিচে, যেগুলোর অধিকাংশই ভুয়া।

ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ ধরনের ‘ইতিবাচক’ মন্তব্য আছে, এমন ১০টি পোস্টের নিচে থাকা ৪ হাজার ৮০৯টি মন্তব্যের মধ্যে ৭৯ শতাংশই ঘুরেফিরে করা একই ‘ইতিবাচক’ কথা। সবচেয়ে বেশি মন্তব্য ছিল, ‘আমি ৫০০০ টাকা মেম্বারশিপ ৩ দিন আগে অ্যাকটিভ করলাম। এখন পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছি।’ এই একই মন্তব্য করা হয়েছে ৮৬টি প্রোফাইল থেকে।

‘ইতিবাচক’ মন্তব্যকারীদের ৬৪টি প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে ডিসমিসল্যাব দেখেছে, এগুলো ভুয়া অ্যাকাউন্ট। এসব অ্যাকাউন্টে পোস্ট থাকে না। বন্ধুর সংখ্যা ৫০-এর নিচে। প্রোফাইলের ‘অ্যাবাউট’ অংশ ফাঁকা। অ্যাকাউন্টে বার্তা পাঠালে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এসব প্রতারণামূলক পেজ কয়েক দিনের মধ্যে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। পরে আবার একই নামে নতুন পেজ খোলা হয়।

ফেসবুকে এ ধরনের প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে মেটার অন্তত দুই ধরনের নীতিমালা ভঙ্গ করা হয়েছে বলে ডিসমিসল্যাবের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।

ডিজিটাল সাক্ষরতায় জোর

মেটার প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন দিয়ে এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা নতুন নয়। তবে এ ধরনের প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন শনাক্তে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এ ধরনের প্রতারণা মোকাবিলায় ডিজিটাল সাক্ষরতাসহ ব্যক্তিপর্যায়ের সচেতনতার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতারকেরা সাধারণ ব্যবহারকারীদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে। অনেক সময় শিক্ষিত মানুষও এ ধরনের প্রতারণার শিকার হন। এর প্রধান কারণ ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব। ডিজিটাল যুগের জন্য যে সচেতনতা, যে শিক্ষা দরকার, তা এখনো দেশে অপ্রতুল। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিপর্যায়ের সচেতনতার ওপর তিনি গুরুত্ব দেন। পাশাপাশি জনসচেতনতা তৈরিতে রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

বি এম মইনুল হোসেন বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও এ ধরনের প্রতারণা মোকাবিলায় নিয়মিত তদারকি কার্যক্রম চালু রাখতে হবে।’