
নিরবচ্ছিন্ন ও দ্রুতগ্রতির ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার লক্ষে গত ২০ মে বাংলাদেশে চালু হয়েছে স্টারলিংক ইন্টারনেট। এটি চালু হওয়ার ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছিলেন, এই সংযোগ ভবিষ্যতের যেকোনো রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও ইন্টারনেট সেবা চালু রাখবে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মূলত জুলাই আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে আওয়ামী সরকার ইন্টারনেট ও টেক্সট মেসেজিং সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। এই প্রেক্ষাপটে স্টারলিংকের উদ্বোধনকে অস্থির রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যেও ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করার যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
স্টারলিংক শুধু শহর নয়, গ্রাম ও সীমান্তবর্তী এলাকাতেও ডিজিটাল সংযুক্তির নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। অনলাইন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যবসা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে এটি ব্যাপক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইলন মাস্কের এই ইন্টারনেট সেবা নিয়ে ইতোমধ্যেই দেশের প্রযুক্তি জগতে আগ্রহ বাড়ছে। অনেকে জানতে যাচ্ছেন এটা কী, কীভাবে কাজ করে, খরচ কত এবং কীভাবে পাওয়া যাবে। এ প্রতিবেদনে তা বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:
স্টারলিংক কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে?
স্টারলিংক হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মহাকাশ গবেষণা ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের মালিকানাধীন একটি সহায়ক কোম্পানি, যা কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা সরবরাহ করে।
স্পেসএক্সের তথ্য অনুযায়ী, স্টারলিংক মূলত পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে ঘুরতে থাকা হাজার হাজার ছোট স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কাজ করে। যদিও প্রচলিত জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৫,৭৮৬ কিলোমিটার ওপর দিয়ে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, স্টারলিংকের স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর মাত্র ৫৫০ কিলোমিটার ওপরে কক্ষপথে ঘুরছে, যা ইন্টারনেটের গতি বাড়ায় এবং ল্যাটেন্সি (সময়) কমায়। মূলত লেজার সিগন্যাল ব্যবহারের কারণেই এটির এমন সুবিধা পাওয়া যায়।
স্টারলিংক বিশ্বের বিভিন্ন কক্ষপথে প্রায় ৭০০০টি স্যাটেলাইট স্থাপন করেছে। প্রাথমিকভাবে ১২ হাজার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা থাকলেও স্পেসএক্স ভবিষ্যতে মোট ৪২ হাজার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে বিশ্বের ১২০টিরও বেশি দেশে স্টারলিংক তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম ভুটানে সেবা চালু হয়। বাংলাদেশে ভারত ও পাকিস্তানের আগে এই সেবায় যুক্ত হয়েছে।
স্টারলিংকের কার্যপ্রণালী অনেকটাই স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মতো। একজন গ্রাহক যখন কোনো ওয়েবসাইটে প্রবেশের অনুরোধ পাঠান, সেই অনুরোধটি প্রথমে তার নিকটবর্তী স্যাটেলাইটে পৌঁছায়। এরপর এটি একাধিক স্যাটেলাইট হয়ে সংশ্লিষ্ট সার্ভারে পৌঁছে যায়। প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে সেই একই পদ্ধতিতে তথ্যটি গ্রাহকের ডিভাইসে ফিরে আসে।
এইভাবে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে এমনকি দুর্গম পাহাড়, দ্বীপ বা অরণ্যেও ইন্টারনেট সংযোগ সম্ভব হয়। ফলে পুরো পৃথিবীকে উচ্চগতির ইন্টারনেট কাভারেজের আওতায় আনার লক্ষ্য বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।
স্টারলিংকের সুবিধাসমূহ
গ্রাহকরা স্টারলিংক ব্যবহারে বেশকিছু সুবিধা পাবেন:
- উপলভ্যতা: যেখানে ফাইবার বা মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, সেখানেও কাজ করে
- উচ্চ গতি: ৫০–২০০ এমবিপিএস পর্যন্ত ডাউনলোড স্পিড
- কম ল্যাটেন্সি: ২০–৫০ মিলিসেকেন্ড, যা রিয়েল-টাইম ব্যবহারে উপযোগী
- সহজ ইনস্টলেশন: নিজেই যন্ত্রপাতি বসানো সম্ভব
- মোবিলিটি: গ্রাহক তার ইচ্ছানুযায়ী স্টারলিংক কিটটি বহন করে যেকোনো জায়গায় স্থাপনের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ পেতে পারবেন।
স্টারলিংকের প্যাকেজ ও মূল্য
স্টারলিংকের দুটি মাসিক প্যাকেজ বর্তমানে চালু রয়েছে- রেসিডেনশিয়াল ও রেসিডেনশিয়াল লাইট। স্টারলিংক রেসিডেনশিয়াল প্যাকেজটি পাওয়া যাচ্ছে ৬,০০০ টাকায় এবং স্টারলিংক লাইট ৪,২০০ টাকায়। তবে যন্ত্রপাতির জন্য এককালীন ৪৯,৮০০ টাকা খরচ করতে হবে।
দুই প্যাকেজেই অসীম ডাটা ব্যবহার করা যাবে এবং সর্বোচ্চ ৩০০ এমবিপিএস গতিতে ডাউনলোড স্পিডের কথা বলা হয়েছে সংস্থাটি থেকে।
স্টারলিংকে একটি ‘ডিভাইস’ (যন্ত্র) থেকে ২০ থেকে ৫০ মিটার (৬৫-১৬৫ ফুট) পর্যন্ত ইন্টারনেট পাওয়া যাবে। গ্রামে এটা ৫০ থেকে ৬০ মিটার (সর্বোচ্চ প্রায় ২০০ ফুট) পর্যন্ত হবে।
বেশি দূর পর্যন্ত ইন্টারনেট পেতে চাইলে রিপিটার, মেশ, আউটডোর অ্যাকসেস পয়েন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। এক ব্যক্তি বা একাধিক ব্যক্তি কিনে সেটা ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে পারবেন। ছোট আকারের বিল্ডিংয়ে বা বড় বিল্ডিংয়ের পাশাপাশি কয়েকটি ফ্ল্যাটে ভাগাভাগি করেও এটি ব্যবহার করা যাবে। এতে সেবার তেমন কোনো তারতম্য হবে না বলে জানানো হয়েছে স্টারলিংকের পক্ষ থেকে।
বাংলাদেশ থেকে কীভাবে স্টারলিংক অর্ডার করবেন?
বাংলাদেশের গ্রাহকরা এখন সরাসরি স্টারলিংকের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট থেকে স্টারলিংক কিট অর্ডার করতে পারছেন। অর্ডার প্রক্রিয়া খুবই সহজ:
১. প্রথমে স্টারলিংকের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুন;
২. আপনার অবস্থান (লোকেশন) নিশ্চিত করে ‘Order Now’ বাটনে ক্লিক করুন;
৩. কোথায় এই কিটটি রিসিভ করতে চান তার জন্য ড্রপডাউন মেনু থেকে আপনার নির্ভরযোগ্য ঠিকানা নির্বাচন করুন;
৪. পছন্দের ইন্টারনেট প্যাকেজ বেছে নিয়ে ‘Check Ou’ চাপুন
৫. ব্যক্তিগত তথ্য ও পেমেন্ট ইনফরমেশন দিয়ে ‘Place Order’ ক্লিক করুন।
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কার্ড ব্যবহার করেও এই পেমেন্ট প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যাবে। অর্ডার নিশ্চিত হলে স্টারলিংক কিট ৩ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে আপনার ঠিকানায় পৌঁছে যাবে।
কী কী থাকবে স্টারলিংক কিটে?
প্রতিটি স্টারলিংক সেটআপ কিটে রয়েছে:
- একটি স্যাটেলাইট ডিশ
- একটি ওয়াই-ফাই রাউটার
- একটি মাউন্টিং ট্রাইপড
- প্রয়োজনীয় সব ক্যাবল
ইনস্টলেশন প্রক্রিয়াও সহজ। শুধু ডিশটি খোলা আকাশের দিকে মুখ করে বসাতে হবে এবং রাউটার সংযোগ দিলেই ইন্টারনেট চালু হয়ে যাবে। কোনো প্রযুক্তিগত দক্ষতা না থাকলেও নিজেই সেটআপ করা সম্ভব।