Image description

গাজী আয়ান (১১) রাত-দিন মিলে এক’দু ঘণ্টা পড়াশোনা করে। এর বাইরে অবসরের বাকি সময়টা কাটায় মোবাইল দেখে। এ বয়সেই মোবাইল আসক্তি পেয়ে বসেছে তাকে। শিশুটির মা তামান্নারা তানিয়া জানান, ইদানীং ছেলের পড়াশোনায় কোনো মনোযোগ নেই। মোবাইল নিয়েই কাটে সারাবেলা। ছোট ভাই আয়াজের সঙ্গেও খেলাধুলা করে না।

ভুক্তভোগী এ মায়ের আক্ষেপ, মোবাইল তিলে তিলে নষ্ট করে দিচ্ছে তার সন্তানের জীবন। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়েও তিনি এখন দুশ্চিন্তায়।

ঢাকার লালমাটিয়া এলাকার ভুক্তভোগী আরেক মা রোকসানা আখতার জানান, তার মেয়ে রাইসাকে নিয়ে সপ্তাহে ৫ দিন প্রায় ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা কোচিং সেন্টারে বসে থাকতে হয়। ১২ বছরের ছেলে রায়হানকে সেই সময়টায় একা বাসায় রেখে আসতে হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে বাধ্য হয়ে মোবাইল ফোনটি তার কাছে রেখে আসা।

বর্তমানে তার অবস্থা এমন হয়েছে যে, মোবাইল ছাড়া এক মুহূর্তও চলে না। পড়াশোনা করে না, কারো সঙ্গে কথা বলে না। সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে মোবাইল দেখে। মোবাইল রাখতে বললেই চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো বাসা মাথায় তুলে। ঠিকমতো খায় না, ঘুমায় না। অস্বাভাবিক আচরণ করে।

ইদানীং এই চিত্র রাজধানীর বেশিরভাগ শিশু-কিশোরদের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। এসব শিশুর দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে। শিশু গাজী আয়ান, রায়হানের মতো একই চিত্র প্রায় প্রতিটি পরিবারে।

আজকাল একান্নবর্তী পরিবার প্রায় দেখাই যায় না। বেশিরভাগ মানুষই ছোট ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে থাকেন। অনেক বাচ্চাই মা-বাবার একমাত্র সন্তান। মা-বাবা সারাদিন নানা কাজে গলদঘর্ম। বাচ্চাকে দেওয়ার সময় নেই।

এই মা-বাবারা অনেকে ভাবেন, স্মার্টফোনই হয়তো তাদের মুশকিল আসান করবে। বাচ্চাকে মোবাইল হাতে বসিয়ে রাখলে ও বারবার বিরক্ত করবে না। এটাই বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় চলে যায় দেখা যায়, বাচ্চা হয়তো সর্বক্ষণই স্মার্টফোনে ডুবে থাকছে।

কিছুদিন আগেও এ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা ছিল না। গত কয়েক বছরে এর নেতিবাচক প্রভাব ভাবিয়ে তুলছে মা-বাবাকে। সন্তানদের এই ডিজিটাল আসক্তি নিয়ে চিন্তিত অভিভাবকরাও।

[H1] তারা জানান, রাতের ঘুমের সময়, হাঁটাচলার সময়, খাবারের সময় বাচ্চাদের মোবাইল লাগে, মোবাইল ছাড়া দিন চলে না তাদের। ক্রমেই বাবা-মার সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে। অভিভাবকরা বলছেন, পর্যাপ্ত খোলা জায়গা এবং খেলার মাঠ না থাকায় রাজধানী ঢাকায় ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তির সমস্যা প্রকট।

মূলত পরিবারের সব শিশু বড়দের বিশেষ করে বাবা-মায়ের ব্যবহার করা স্মার্টফোনের মাধ্যমে শুরু হয় স্ক্রিন আসক্তি। শিশুদের স্মার্টফোনে আসক্তির শুরুটা হয় কার্টুন, অ্যানিমেশন ও ইউটিউব দিয়ে। কার্টুন, অ্যানিমেশন আর ইউটিউব দেখতে দেখতে পরে আসক্ত হয় ফেসবুকিংসহ বিভিন্ন অনলাইন গেমসে। এভাবেই প্রায় সব শিশু স্মার্টফোন, আইফোন, ট্যাব নিয়ে ব্যস্ত ডিজিটাল গেমসে।

মার্কিন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. নিকোলাস কারদারাস এ ধরনের আসক্তিকে ‘ডিজিটাল মাদক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বেশ কয়েক বছর হলো আমাদের সমাজেও ডিজিটাল মাদকের সর্বগ্রাসী থাবা শুরু হয়েছে। বৈজ্ঞানিকভাবে এসব ডিজিটাল ডিভাইসের ক্ষতির বিষয়টি প্রমাণিত।

ভারতের চার্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা থে[H2] কে জানা যায়, স্মার্টফোনের অধিক ব্যবহার চোখের রেটিনা, কর্নিয়া এবং অন্যান্য অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিশুদের অনিদ্রা, আগ্রাসী মনোভাব, বান্ধবহীনতা, আত্মবিশ্বাসহীনতার অন্যতম কারণ এই স্ক্রিন আসক্তি।

গবেষকরা আরো বলেন, বাচ্চাদের অন্তত দুই ঘণ্টা বাইরে খেলতে দিলে ধীরে ধীরে তার স্মার্টফোনের প্রতি আসক্তি কমে যাবে। মোট কথা তাদের ঘরে বদ্ধ করে না রেখে বাইরের পরিবেশের সঙ্গে মিশতে দিতে হবে, খেলাধুলা করতে দিতে হবে। বয়স অনুযায়ী গল্প ও সৃজনশীল বই পড়ায় আগ্রহী করে তুলতে হবে।

শিশুদের জন্য পারিবারিক গ্রন্থাগার তৈরি করতে হবে। ছোট বয়স থেকে তাদের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে বাবা-মাকে সহযোগিতা করতে হবে। তাহলে যেমন তারা এই স্ক্রিন আসক্তি থেকে বের হতে পারবে তেমনি সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ অর্জন করতে পারবে।

২০২২ সালে করা যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের ৪ থেকে ১৭ বছর বয়সি প্রায় ৬০ লাখ শিশু-কিশোর ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তির কারণে নানা জটিলতায় ভুগছে। গবেষণার প্রতিবেদন বলছে, শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি নানা রকম মানসিক সমস্যায়ও ভুগছে তারা।

ছোট বাচ্চাদের জন্য এ ক্ষতি আরো বেশি হয় বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ আই হাসপাতালের শিশু বিভাগের কনসালট্যান্ট ডাক্তার কাজী সাব্বির আনোয়ার। তিনি বলেন, রাস্তায় কিংবা স্কুলে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অনেক শিশুর চোখে সমস্যা।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর কারণ এই ডিজিটাল মাদকাসক্তি। ফলে এই আসক্তির ভয়াবহতাকে বিবেচনায় রাখা অভিভাবকদের অন্যতম দায়িত্ব। এছাড়া মনে রাখতে হবে, যারা স্মার্টফোনের স্ক্রিনে সেঁটে থাকে, তারা অন্য কিছুতে দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। কোনো কাজ করলে অল্প সময়ে অধৈর্য হয়ে যায়। স্ক্রিনে সেঁটে থাকার কারণে বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যাও খুব কম হয়।

ফলে কোনো পরিস্থিতিতে সহজে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামান্য বিপদে একদম দিশাহারা হয়ে যায়। রেগে যাওয়ার প্রবণতাও বেশি দেখা যায়।

যেসব শিশু প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিভি দেখে বা কম্পিউটারে খেলার জন্য স্ক্রিনের সামনে বসে থাকে, তারা অন্যদের যারা এসব করে না তাদের চেয়ে অনেক বেশি মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় ভোগে। বেশি আবেগপ্রবণ হয়, সবকিছুই অতিরিক্ত করে ইত্যাদি। তাদের সব ধ্যান-জ্ঞান থাকে ওই স্মার্টফোন বা স্ক্রিনকেন্দ্রিক। মা-বাবারও এ ব্যাপারে তেমন কোনো আপত্তি নেই। মা-বাবা অনেকেই ‘বাচ্চা ঠান্ডা তো দুনিয়া ঠান্ডা’ নীতিতে বিশ্বাসী।

বাচ্চাকে সাময়িক শান্ত করার জন্য ঠেলে দিচ্ছে নীরব ঘাতকের হাতে। এতে সাময়িক স্বস্তি খুঁজে পেলেও এটা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তির কারণে শিশুরা অন্যান্য কার্যক্রম থেকেও দূরে থাকে, আর এতে তাদের শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধে। ডিজিটাল ডিভাইস এড়িয়ে চলতে হলে শিশুদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন শারীরিক অনুশীলন এবং ইনডোর ও আউটডোর খেলায় মনযোগী করে তুলতে হবে।

কোমলমতি শিশু-কিশোরদের ডিজিটাল আসক্তির ভয়ঙ্কর ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য অভিভাবকদের আরো সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের চিকিৎসক নেহাল করিম বলেন, এই ডিজিটাল জগৎ নিয়ে পরে থাকলে বাচ্চাদের চোখের, ব্রেনের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। অতিমাত্রায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের ফলে তাদের আইকিউ হয়তো সেভাবে নষ্ট হচ্ছে না, তবে তার মেধার বিশাল একটা অংশ এই খাতে ব্যবহারের ফলে অন্যান্য স্থানে মেধার প্রয়োগ হচ্ছে না।

এ ক্ষেত্রে শিশুর বিকাশে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের নিজেদের এবং সন্তানদের মঙ্গলের জন্য তাদের বুঝাতে হবে। সন্তানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়লে মা-বাবার জন্যই মঙ্গল।

তিনি মনে করেন, কোনো অবস্থাতেই একটানা ৪০-৪৫ মিনিটের বেশি ডিভাইস ব্যবহার করা যাবে না। তার মতে, মোবাইলের অপব্যবহারে শিশুদের মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু শিশু নয়, সব বয়সি মানুষের টিউমার, স্মৃতি ও দৃষ্টিশক্তি লোপসহ নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। মোবাইলসহ বিভিন্ন ডিভাইস ব্যবহারে আরো সতর্ক থাকা ও যত্নবান হওয়ার আহবান জানান তিনি।

মেডিকেল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ.বিএম আবদুল্লাহ বলেন, ইলেক্ট্রলাইটিক রেডিয়েশন স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ‘যতটুকু সম্ভব বাচ্চাদের ডিজিটাল ডিভাইস থেকে দূরে রাখতে হবে। ডিজিটাল ডিভাইসের ওপর আসক্তি বেড়ে গেলে তাদের শারীরিক অনুশীলন কমে যায়।

সেক্ষেত্রে তারা মোটা হয়ে যায় এবং ওজনও বাড়তে থাকে। এতে বয়স হলে তাদের উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া তৈরি হতে পারে থাইরয়েডের সমস্যাও। একই সঙ্গে চোখ ও মস্তিষ্কের উপরেও এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে। ‍বিভিন্ন ডিভাইসের ইলেক্ট্রলাইটিক রেডিয়েশন আছে, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

ছোট্ট পর্দায় এই মনোযোগ দেয়ায় ঘাড়ে ব্যথা, মাথাব্যথা ও দৃষ্টিশক্তি লোপ পাচ্ছে। এই স্মার্ট ডিভাইসে আসক্তি সমাজের জন্য এক বিরাট ক্ষতি। পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকি তো আছেই। তাই তিনি মনে করেন, শিশুদের হাতে স্মার্ট ডিভাইস যত কম দেওয়া যায় ততই মঙ্গল।