
ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের অংশ হিসেবে নির্মিত হয় ‘অঞ্জলি লহ মোর’ নামে একটি ভাস্কর্য। তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক সৌমিত্র শেখরের ব্যক্তিগত আগ্রহেই এটি স্থাপন করা হয়েছিল বলে জানা গেছে। তবে প্রকল্পের মূল নকশায় ভাস্কর্যটির উল্লেখ ছিল না। সম্প্রতি নতুন প্রশাসনের নির্দেশে ঈদের ছুটির মধ্যেই ভাস্কর্য ভাঙার কাজ শুরু হয়। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনার মুখে প্রশাসন ভাঙার কাজ স্থগিত করে দেয়।
এদিকে ভাস্কর্য বিতর্কে নিয়েছে নতুন মোড়। ভাস্কর্যটি তৈরি করেন ভাস্কর মনিন্দ্র পাল। ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনা শুনে নিজের সম্মানির ৭ লক্ষ টাকা বকেয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি। এ ঘটনায় অভিযোগের তীর সাবেক উপাচার্য সৌমিত্র শেখরের দিকে।
সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সৌমিত্র শেখরের সময়কালে প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদ ভবনের সামনের পুকুরঘাটের সৌন্দর্য বাড়াতে নির্মাণ করা হয় ‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাস্কর্য।
বকেয়া টাকার ব্যাপারে ভাস্কর মনিন্দ্র পাল বলেন, ভাস্কর্যটি নিয়ে আমার সঙ্গে ভ্যাট-ট্যাক্সছাড়া ১৫ লক্ষ টাকার চুক্তি হয়েছিল। এর মধ্যে আমি ৮ লক্ষ টাকা পেয়েছি। এখনও ৭ লক্ষ টাকা বকেয়া রয়েছে। টাকার জন্যও আমি প্রায় এক বছর ধরে ঘুরছি। এই প্রকল্পের চুক্তি হয়েছিলো তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর এবং প্রকল্প পরিচালক জুবায়ের আহমেদের সঙ্গে।
তিনি আরো বলেন, ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পেরে পিডি জুবায়ের, ডিন, ত্রিশাল থানার ওসি, প্রক্টর এবং ডিপিডি হাফিজের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু কেউই দায় স্বীকার করেননি কিংবা স্পষ্ট কোনো বক্তব্য দিতে চাননি। ডিপিডি শুধু এটুকু বলেন, আপনি ভালো করেই জানেন কেন ভাঙা হচ্ছে। আমি আসলেই জানি না, কী কারণে ভাঙা হয়েছে। এই কাজের মধ্যে বিন্দুমাত্র রাজনৈতিক বার্তা নাই, এটি কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘অঞ্জলি লহ মোর’ গানের থিম থেকে নেওয়া। একজন শিল্পী হিসেবে এটি আমার জন্য অত্যন্ত অপমানজনক, দুঃখজনক এবং মানসিকভাবে বিপর্যয়কর।
এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক জুবায়ের আহমেদ বলেন, শিল্পীর সম্মানীসহ অন্যান্য বিষয়গুলো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করে। কেন পারিশ্রমিক বাকি এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই বলতে পারবে।
ভাস্কর্যটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কন্টিনেন্টালের অংশীদার লাভলু বলেন, শিল্পীকে আমরা ৮ লক্ষ টাকা দিয়েছি, এরপর প্রস্তুতকালীন সময়ে আরও ৪ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে। শিল্পীর সম্মানির মধ্যেই প্রস্তুতকালীন খরচ থাকবে কি না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এমনই হওয়ার কথা। এখন তো প্রশাসনও পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমরা বসে আলোচনা সাপেক্ষে বিষয়টি সমাধান করবো।
এর আগে গত ১৭ জুন পূর্ব নির্ধারিত কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই ‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাস্কর্যটি ভাঙচুর শুরু হয়। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা শুরু হলে বুধবার (১৮ জুন) অনলাইনে এক জরুরি সভা করে কাজ আপাতত বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আগামী ২২ জুন সংশ্লিষ্ট দপ্তর প্রধান এবং ডিনদের সমন্বয়ে আবারও আলোচনায় বসবে প্রশাসন।
এদিকে ভাস্কর্য নির্মাণে প্রশাসনের অনিয়মের তদন্ত, মূল ডিজাইন অনুসারে ভাস্কর্যটি সংস্কার এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়কারীদের শাস্তির আওতায় আনার ৩ দফা দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী ঐশ্বর্য সরকার বলেন, ভাস্কর্যটি ভাঙার মধ্য দিয়ে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা মানে শিল্প সংস্কৃতিকে আঘাত করা। আমরা এর প্রতিবাদ জানাই। এই ভাস্কর্য যদি পুনর্নির্মাণ করে দেয়া না হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিমনা শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলব। এই অঞ্জলি লহ মোর নজরুলের সৃষ্টিকর্মের সাথে জড়িত। এটি ভাঙা মানে নজরুলকে অবমাননা করা। এর সাথে যারা জড়িত তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।