বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ভারত থেকে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ আমদানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। এ উদ্যোগের লক্ষ্য স্থানীয় সক্ষমতার ব্যবহার বাড়ানো এবং বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশ দুটি প্রধান উৎস থেকে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ সংগ্রহ করে—টেরেস্ট্রিয়াল এবং সাবমেরিন ক্যাবল। বর্তমানে ব্যান্ডউইথ সংগ্রহের ওপর কোনো সীমাবদ্ধতা (ক্যাপ) নেই।
তবে দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে আমদানি করা আন্তর্জাতিক টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল (আইটিসি) থেকে আসে। এ বাণিজ্য শেখ হাসিনার সরকারের আমলে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে।
এর ফলে একমাত্র রাষ্ট্র-পরিচালিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল পিএলসি (বিএসসিপিএলসি) বাজারে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। প্রতিষ্ঠানটি অবকাঠামোতে এক হাজার কোটিরও বেশি টাকার বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু সেগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অব্যবহৃত রয়ে গেছে।
এ পার্থক্য দূর করার জন্য বিটিআরসি প্রস্তাব করেছে, ভারত থেকে আমদানি করা ব্যান্ডউইথের পরিমাণ দেশের মোট চাহিদার সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখতে। নিয়ন্ত্রক এ সংস্থাটি ইতোমধ্যে এ ব্যবস্থার জন্য সরকারের অনুমোদন চেয়েছে।
এ প্রস্তাব অনুমোদিত হলে দেশের চূড়ান্ত পর্যায়ের ইন্টারনেট সরবরাহকারীদের কাছে আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথের পাইকারি বিক্রেতা ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি)-সমূহ তাদের চাহিদার সর্বোচ্চ অর্ধেক আইটিসি ও সাবমেরিন ক্যাবল থেকে নিতে পারবে।
বিটিআরসি প্রতিযোগিতামূলক উৎসগুলোর মধ্যে একটি ন্যায্য রাজস্ব ভাগাভাগির মডেলের প্রস্তাবও দিয়েছে। এ প্রস্তাব অনুযায়ী, আইটিসি অপারেটরদেরকে তাদের রাজস্বের ৩ শতাংশ অবদান রাখতে হবে, যা বর্তমানে ১ শতাংশ। এ হার বিএসসিপিএলসির জন্য বিদ্যমান বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এছাড়া বাজারের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বিটিআরসি সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছে, যেন আইটিসি অপারেটররা ভর্তুকিযুক্ত ব্যান্ডউইথ তাদের নিজস্ব ফরোয়ার্ড-লিঙ্কড ব্যবসায় বিক্রি না করে।
বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এসব উদ্যোগ সুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে এবং দেশের নিজস্ব সক্ষমতার ব্যবহার বাড়াবে। তিনি আরও বলেন, 'সরবরাহ বিঘ্নিত হলে স্থলজ এবং সাবমেরিন ক্যাবল উভয়ই প্রয়োজনীয়। তবে বর্তমান বাজারের ভারসাম্যহীনতা সমাধান করা অত্যন্ত জরুরি।'
তিনি আরও বলেন, আইটিসিগুলো প্রাথমিকভাবে বিশেষ সুবিধা পেয়েছিল, কিন্তু শিল্পে অসদাচরণের ফলে বর্তমানে সমস্যা তৈরি হয়েছে। 'এখন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সাবমেরিন এবং স্থলজ ক্যাবল ব্যবসার টেকসইতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিচ্ছে।'
আগে আইআইজি নির্দেশিকার অধীনে কোনো নির্দিষ্ট উৎস থেকে ব্যান্ডউইথ সংগ্রহের ওপর ৬০ শতাংশ ক্যাপ ছিল। কিন্তু, আইটিসির পৃষ্ঠপোষকতার জন্য বিটিআরসি ২০১২ সালের জুনে একটি অন্তর্বর্তী নির্দেশনার মাধ্যমে সে ক্যাপ তুলে দেয়। বর্তমানে, বিটিআরসি সে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার উদ্যোগ নিচ্ছে।
স্থানীয় সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ: বাংলাদেশ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৪.৫ টেরাবিট (টিবিপিএস) ব্যান্ডউইথ আমদানি করে ভারতের ছয়টি প্রতিষ্ঠান থেকে—ভারতী এয়ারটেল, রিলায়েন্স জিও ইনফোকম, এসআইএফওয়াই টেকনোলজিস, লাইটস্টর্ম টেলিকম কানেক্টিভিটি এবং টাটা কমিউনিকেশনস। এ আমদানিতে বছরে বৈদেশিক মুদ্রায় ৪ কোটি ডলারের বেশি খরচ হয়।
অন্যদিকে, বিএসসিপিএলসি ২০০৬ সাল থেকে সাবসি ক্যাবল এসএমডব্লিউ-৪ এবং ২০১৭ সাল থেকে এসএমডব্লিউ-৫ পরিচালনা করছে। এর সম্মিলিত সক্ষমতা ৭.২ টিবিপিএস হলেও প্রতিষ্ঠানটি সিঙ্গাপুরে ব্যান্ডউইথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং আপস্ট্রিম পেমেন্টে বছরে প্রায় ৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে।
তবে শিল্প সূত্রমতে, সিঙ্গাপুরে বিএসসিপিএলসির মোট ব্যয় প্রায় বাংলাদেশে ভারত থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানির ব্যয়ের সমান। কারণ, বিএসসিপিএলসির অবকাঠামো ব্যবহার করেও বেশিরভাগ ক্লায়েন্ট বিদেশি উৎস থেকে ব্যান্ডউইথ কেনার জন্য অর্থ প্রদান করে।
বর্তমানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা স্থানীয় সক্ষমতার ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। বিশেষ করে, বিএসসিপিএলসির নতুন ক্যাবল এবং ২০২৭ সালের মধ্যে তিনটি আসন্ন বেসরকারি সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে জাতীয় সক্ষমতা প্রায় ৬০ টিবিপিএসে উন্নীত হবে।
বিএসসিপিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসলাম হোসেন বলেন, 'আমরা এ নীতিগত পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই, কারণ এটি জাতীয় সম্পদের কার্যকর ব্যবহার বাড়াবে এবং বাংলাদেশের বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে ভারতীয় হস্তক্ষেপের ঝুঁকি কমাবে।'
তিনি আরও বলেন, বিএসসিপিএলসির ১৩.২ টিবিপিএস ক্ষমতাসম্পন্ন ও এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের এসএমডব্লিউ-৬ প্রকল্পটি ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে চালু হলে মোট ক্ষমতা ২০.৪ টিবিপিএসে উন্নীত হবে।
বর্তমানে দেশের ব্যান্ডউইথ চাহিদা প্রায় ৬ টিবিপিএস। বিএসসিপিএলসি সেপ্টেম্বরে এর ৪০ শতাংশ সরবরাহ করেছে, যা তাদের বর্তমান ক্ষমতার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ এবং ভবিষ্যৎ ক্ষমতার মাত্র এক-দশমাংশ।
ভারতীয় আমদানি যেভাবে সাবমেরিনকে ছাড়িয়ে গেছে: প্রথম সাবমেরিন ক্যাবলের ক্ষয়রোধ এবং অপ্রয়োজনীয়তা এড়াতে বিটিআরসি ২০১২ সালে ৬টি আইটিসি লাইসেন্স ইস্যু করে এবং পরে ২০১৪ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানির (বিটিসিএল) জন্য সপ্তম লাইসেন্সের অনুমোদন দেয়।
ব্যান্ডউইথ-আমদানি ব্যবসার জন্য ন্যূনতম বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। শুরুতে এটি সাবমেরিন ইন্টারনেটের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হিমশিম খাচ্ছিল। কিন্তু গুগল, অ্যামাজন, মেটা এবং আকামাইয়ের মতো বৈশ্বিক প্রযুক্তি-জায়ান্টদের জন্য বিশাল স্থানীয় সার্ভার তৈরি করতে ভারতের উদ্যোগের ফলে প্রতিযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
এ সার্ভারগুলো কোম্পানিগুলোকে আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথের খরচ সাশ্রয় করতে সহায়তা করে, যা পূর্বে সিঙ্গাপুর সার্ভারের সঙ্গে সংযোগের জন্য ব্যয় করা হতো।
ফাইবার@হোম গ্লোবালের সিওও লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) মশিউর রহমানের মতে, কোভিড-১৯ মহামারির সময় ইন্টারনেট ব্যবহারের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি বাংলাদেশে আইটিসি ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা যোগ করে।
তিনি জানান, আইটিসিগুলো কাছাকাছি ভারতীয় সার্ভারগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে, যেখানে সাবমেরিন কেবল ইন্টারনেট রুটগুলো সিঙ্গাপুরে সংযুক্ত থাকে। এর ফলে লেটেন্সিতে ৮-১১ মিলিসেকেন্ড থেকে ৪৮ মিলিসেকেন্ড পর্যন্ত পার্থক্য দেখা যায়।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের ৭০ শতাংশের বেশি সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়, যেখানে লেটেন্সি পার্থক্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এমদাদুল হক অভিযোগ করেন, বিএসসিপিএলসির সক্ষমতা কম ব্যবহার হলেও এটি দাম কমানোর বিষয়ে কখনো বিশেষ উদ্যোগ নেয়নি।
তিনি বলেন, যদি সাবমেরিন ক্যাবলের দাম কমানো যেত, তাহলে আইটিসি ইন্টারনেট আরও সাশ্রয়ী হতো। কারণ ভারতীয় সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথের ওপর কম নির্ভরশীল থাকায় আরও ব্যয় কমানো যেত।
তিনি বলেন, বেসরকারি ব্যবসায়ীদের বিএসসিপিএলসির মতো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের তুলনায় আরও নির্ভরযোগ্য ২৪/৭ পরিষেবা প্রদান করে।
বিএসসিপিএলসির বিপণন ও বিক্রয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. আরিফুল হক বলেন, ক্যাপ বাস্তবায়িত হলে আগামী বছরগুলোতে বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোর স্থানীয় সার্ভার স্থাপনকে ত্বরান্বিত করবে।
তিনি জানান, আইটিসির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে বিএসসিপিএলসি সম্প্রতি আইআইজিদের জন্য ৫০ শতাংশ বোনাস ব্যান্ডউইথ এবং চেন্নাই সার্ভারের সঙ্গে সংযুক্ত তাদের প্রথম ক্যাবলের পরিকাঠামোর ব্যবহারকারীদের জন্য ৩০ শতাংশ বোনাস ঘোষণা করেছে।
ক্রস ভর্তুকি : বিটিআরসি চেয়ারম্যান বারী বলেন, ক্রস ভর্তুকি, যেখানে কোম্পানিগুলো অন্যান্য ব্যবসার মুনাফা ব্যবহার করে প্রতিযোগিতায় সুবিধা অর্জন করে, একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিটিআরসি বিশ্লেষণ অনুসারে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে আইটিসি অপারেটররা তাদের অর্ধেক ব্যান্ডউইথ প্রতি এমবিপিএস অস্বাভাবিক কম দাম মাত্র ৭ টাকায় তাদের সংযুক্ত আইআইজি ফার্মগুলোর কাছে বিক্রি করেছে।
অন্যদিকে, অন্যান্য আইআইজিগুলো আইটিসির ক্রয়মূল্য ১ থেকে ১.০৫ ডলারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অবশিষ্ট ব্যান্ডউইথ প্রতি এমবিপিএস ১৩৫ থেকে ১৮৪ টাকায় কিনেছে।
ছয়টি সক্রিয় আইটিসি অপারেটরের মধ্যে পাঁচটি আইআইজি ব্যবসা পরিচালনা করে। এর মধ্যে রয়েছে বিএটিসিএল, নভোকম, সামিট কমিউনিকেশনস, ফাইবার@হোম এবং ম্যাঙ্গো টেলিসার্ভিসেস। বিএসসিপিএলসিও আইআইজি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছে বলে বিটিআরসি জানিয়েছে।
শিল্প প্রতিক্রিয়া : ফাইবার@হোম গ্লোবালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মইনুল হক সিদ্দিকী মনে করেন, নীতির অসঙ্গতির আশঙ্কার কারণে ব্যান্ডউইথ ক্যাপিং বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোকে নিরুৎসাহিত করতে পারে।
'ক্যাপিং নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইটিসিগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করেনি। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যেতে পারে,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বজুড়ে স্থানীয় সার্ভারের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়ছে। গত এক দশকে দেশে ইন্টারনেটের খরচ কমাতে আইটিসির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সিদ্দিকী জানান, বছরের শুরুতে দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের ব্ল্যাকআউট যখন দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলছিল, তখন আইটিসিগুলো সেই শূন্যতা পূরণে বড় ভূমিকা রেখেছিল। তবে ক্যাপ আরোপ করা হলে এমন পরিস্থিতিতে সাড়া দেওয়া সম্ভব হবে না।
তিনি বলেন, টেরেস্ট্রিয়াল এবং সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহের চাহিদা আলাদা। ব্যবহারকারীদের তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ না দিয়ে উভয়ের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য করা যেন 'কাউকে তার বাজারের কেনাকাটা স্থানীয় সুবিধাজনক দোকান ও দূরের বড় হাটের মধ্যে ভাগ করে নিতে বাধ্য করার মতো'।
আইটিসিগুলো তাদের ব্যান্ডউইথের অর্ধেক মাত্র ৭ টাকায় প্রতি এমবিপিএসে বিক্রি করেছে—নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ দাবির যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সিদ্দিকী। তিনি বলেন, এটি কোনো কোম্পানির জন্য 'বাস্তবসম্মত হতে পারে না'।
স্থানীয় সক্ষমতার ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আইআইজি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল আহমেদ জুনায়েদ বলেন, এটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হওয়া উচিত।