
বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতের লাইসেন্সিং ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্সিং ব্যবস্থার সংস্কার নীতিমালা- ২০২৫’ এর খসড়ায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা জটিল, বহুস্তর বিশিষ্ট লাইসেন্সিং কাঠামো বিলুপ্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে প্রযুক্তি ও বাজারের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে নীতিমালায় উদ্ভাবনী, বিনিয়োগবান্ধব ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিভিন্ন প্রস্তাবনাও রাখা হয়েছে।
নীতিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে, বর্তমান লাইসেন্সিং কাঠামোতে জটিলতা, পুনরাবৃত্তি, উচ্চ খরচ ও অপ্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তা ও বহুপদক্ষেপের কারণে বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হন। অন্যদিকে, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ভোগেন নিয়ন্ত্রক জটিলতায়।
এসব বিবেচনায় নতুন নীতিমালায় লাইসেন্সিং ব্যবস্থাকে সীমিত করে তিনটি মূল লাইসেন্স এবং দুটি এনলিস্টমেন্ট (তালিকাভুক্তি বা নিবন্ধন) চালুর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিনটি লাইসেন্সিং ব্যবস্থার মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে মোবাইল ও ফিক্সড টেলিকম সেবা, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ব্যাকহল, টাওয়ার ও ফাইবার অবকাঠামো এবং তৃতীয়টি হচ্ছে আন্তর্জাতিক ভয়েস ও ডেটা সংযোগ।
নতুন নীতিমালায় লাইসেন্সিং ব্যবস্থাকে সীমিত করে তিনটি মূল লাইসেন্স এবং দুটি এনলিস্টমেন্ট (তালিকাভুক্তি বা নিবন্ধন) চালুর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিনটি লাইসেন্সিং ব্যবস্থার মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে মোবাইল ও ফিক্সড টেলিকম সেবা, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ব্যাকহল, টাওয়ার ও ফাইবার অবকাঠামো এবং তৃতীয়টি হচ্ছে আন্তর্জাতিক ভয়েস ও ডেটা সংযোগ
এনলিস্টমেন্ট (নিবন্ধন) প্রক্রিয়ায় রাখা হয়েছে উপজেলা বা থানা পর্যায়ের ইন্টারনেট সেবা এবং এসএমএস অ্যাগ্রিগেটর, ক্ষুদ্র টেলিকম সেবা ও এন্টারপ্রাইজ সল্যুশন। খসড়া নীতিমালার বাস্তবায়ন হলে এসব কাঠামোতে প্রতিটি অপারেটর প্রযুক্তি ও নিরপেক্ষভাবে সেবা দিতে পারবেন অর্থাৎ তারা একই লাইসেন্সের আওতায় বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে ভিন্নধর্মী সেবা চালু করতে পারবেন।
আলগা হচ্ছে টেলিকম খাতের বাঁধন, বিলুপ্ত হচ্ছে ইন্টারনেট সঞ্চালনের ৪ স্তর
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির খসড়া নীতিমালায় ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স), ন্যাশনাল ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ (নিক্স), ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) এবং ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি)— এ চারটি স্তর বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ হলো, ইন্টারনেট ডেটা এখন সরাসরি এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে প্রবাহিত হতে পারবে, যেখানে মধ্যবর্তী এ স্তরগুলোর আর কোনো ভূমিকা থাকবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পদক্ষেপের ফলে ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের একটি জটিল কাঠামো সরল হবে। ধারণা করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে এবং গ্রাহকেরা আরও দ্রুত ও সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। এছাড়া, মধ্যবর্তী স্তরগুলো না থাকায় একদিকে যেমন পরিচালন খরচ কমবে, অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের কারসাজি বা অতিরিক্ত চার্জের সম্ভাবনাও হ্রাস পাবে।
প্রস্তাবিত নীতিমালায় টেলিযোগাযোগ খাতের বেশকিছু সেবাকেও লাইসেন্সের আওতামুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এসবের মধ্যে কল সেন্টার, ভেহিকেল ট্র্যাকিং সেবা এবং টেলিকম খাতের ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস (টিভ্যাস)-এর মতো সেবাগুলো এখন থেকে লাইসেন্স ছাড়াই প্রদান করা যাবে। এ সিদ্ধান্ত নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করবে এবং বাজারে আরও বেশি উদ্ভাবনী সেবা নিয়ে আসতে উৎসাহিত করবে
শুধু তা-ই নয়, প্রস্তাবিত নীতিমালায় টেলিযোগাযোগ খাতের বেশকিছু সেবাকেও লাইসেন্সের আওতামুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এসবের মধ্যে কল সেন্টার, ভেহিকেল ট্র্যাকিং সেবা এবং টেলিকম খাতের ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস (টিভ্যাস)-এর মতো সেবাগুলো এখন থেকে লাইসেন্স ছাড়াই প্রদান করা যাবে। এ সিদ্ধান্ত নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করবে এবং বাজারে আরও বেশি উদ্ভাবনী সেবা নিয়ে আসতে উৎসাহিত করবে।
নীতিমালায় প্রাধান্য পেয়েছে উদ্যোক্তাবান্ধব ব্যবস্থা
এ নীতিমালায় কল সেন্টার, ভেহিকেল ট্র্যাকিং সেবা ও টেলিকম ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসের মতো সেবাকে লাইসেন্সিংয়ের আওতামুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র এনলিস্টমেন্ট বা স্বীকৃতির মাধ্যমে এগুলো পরিচালনার সুযোগ রাখা হয়েছে। এছাড়া ভিস্যাট, এসএমএস অ্যাগ্রিগেটরসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র সেবা প্রোভাইডারদের জন্য ‘স্মল টেলিকম সার্ভিস’ নামে একটি অপশনাল প্ল্যাটফর্ম রাখা হয়েছে। যা উদ্যোক্তাদের নতুন উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহ জোগাবে।
দুয়ার খুলছে বিদেশি বিনিয়োগের
নতুন নীতিমালার খসড়ায় দুটি প্রধান লাইসেন্স ক্যাটাগরিতে বিদেশি মালিকানার সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত নীতিমালা অনুযায়ী, ন্যাশনাল ইন্টারনেট কমিউনিকেশন সার্ভিস প্রোভাইডার (এনআইসিএসপি) লাইসেন্সের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত মালিকানা ধারণ করতে পারবে। অন্যদিকে, ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট কমিউনিকেশন সার্ভিস প্রোভাইডার (আইসিএসপি) লাইসেন্সের ক্ষেত্রে এ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ।
এ পদক্ষেপের ফলে আন্তর্জাতিক টেলিকম সংস্থাগুলো বাংলাদেশের দ্রুত বর্ধনশীল টেলিকম বাজারে বিনিয়োগে আরও বেশি উৎসাহিত হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে, বিদেশি বিনিয়োগের আগমন একদিকে যেমন টেলিযোগাযোগ অবকাঠামোর গুণগত মানোন্নয়নে সহায়ক হবে, অন্যদিকে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী সেবা প্রবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
আমরা বিশ্বাস করি, নতুন এ বিধান সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সহায়ক হবে। এটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে আমাদের টেলিকম সেক্টরে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আসবে এবং গ্রাহকেরাও উন্নত মানের সেবা উপভোগ করতে পারবেন। এছাড়া, বিদেশি মালিকানার সীমা নির্ধারণের মতো একটি ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্তও অনেক দিন ধরে প্রয়োজন ছিল
-বিটিআরসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিটিআরসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, নতুন এ বিধান সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সহায়ক হবে। এটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে আমাদের টেলিকম সেক্টরে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আসবে এবং গ্রাহকেরাও উন্নত মানের সেবা উপভোগ করতে পারবেন। এছাড়া, বিদেশি মালিকানার সীমা নির্ধারণের মতো একটি ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্তও অনেক দিন ধরে প্রয়োজন ছিল।
৭ উদ্দেশ্য নতুন নীতিমালা
বিটিআরসির টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্সিং ব্যবস্থার সংস্কার নীতিমালার খসড়া প্রস্তাবে ইন্টারনেট সেবার দীর্ঘদিনের জটিল কাঠামো ভেঙে একটি সরল এবং কার্যকর ব্যবস্থা তৈরি করার কথা বলা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ আছে, নতুন নীতিমালার প্রধান উদ্দেশ্য সাতটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— সহজ নেটওয়ার্ক ‘টপোলজি’ তৈরি, ব্যবসাবান্ধব ও সৃজনশীলতামূলক লাইসেন্সিং মডেল গড়ে তোলা, সেবা ও প্রযুক্তিগত নিরপেক্ষতার প্রসার, টেলিযোগাযোগ সেবায় ভোক্তার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি।
একইসঙ্গে নীতিমালাটি বাস্তবায়নের জন্য একটি তিন ধাপের পরিকল্পনাও প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে (২০২৫ সালে) নীতিমালার কার্যকারিতা শুরু হবে (নীতিমালা অনুমোদন ও বাস্তবায়ন শুরু), দ্বিতীয় ধাপে (২০২৫-২০২৬ সালে) নতুন লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া শুরু হবে (নতুন লাইসেন্স প্রদান) এবং তৃতীয় ধাপে (২০২৭ সালে) বিদ্যমান লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন কাঠামোর অধীনে আসবে (পুরনো লাইসেন্সের মেয়াদ শেষে নতুন কাঠামো বাধ্যতামূলক)। তবে, যেসব লাইসেন্স মেয়াদপূর্তির আগেই নতুন কাঠামোয় যেতে আগ্রহী, তাদের জন্য সুযোগ থাকবে।