Image description

হঠাৎই গত রোববার রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে—‘সোমবার সকাল থেকে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হচ্ছে।’ এরপর যে যেভাবে পারছে, তা নিজেদের মতো বিশ্লেষণ করে ছড়িয়ে দিয়েছে ফেসবুক আইডিতে। তবে গতকাল সোমবার সকাল পেরিয়ে গেলেও বরাবরের মতোই স্বাভাবিক দেশ। এটি যে অপতথ্য বা অপপ্রচার বা গুজব, তা বুঝতে বাকি থাকে না কারও। গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নাসিমুল গনি বলেন, ‘দেশে জরুরি অবস্থা নিয়ে যা ছড়ানো হচ্ছে, এটা গুজব।’

এর আগে গত শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়, ‘গত দুদিন হয় ৩৩ জন বিজিবি সদস্য নাফ নদে মিশনে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছে।’ যেটি পরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তর নিশ্চিত করে যে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত এই তথ্যটি ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

শুধু এই দুটি ঘটনাই নয়; সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বিভিন্ন আইডি যাচাই করে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ছড়ানো প্রায় সবই রাজনৈতিক ইস্যুভিত্তিক গুজব বা অপতথ্য। পাশাপাশি রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনীসহ স্পর্শকাতর বিষয় নিয়েও এসব গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেক অপতথ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা দিতে জনপ্রিয় গণমাধ্যমের নামে ‘ফটোকার্ড’ বানানো হচ্ছে। গণমাধ্যমের লোগো ব্যবহার করে এসব ফটোকার্ড ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

 

গুজব চিহ্নিত করতে কাজ করা ফ্যাক্ট চেকিং বিশেষজ্ঞ ও সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা পরিকল্পিতভাবে নানা ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে। নিজেদের কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে এবং জনমতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হিসেবে নানা ধরনের অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। ওই রাজনৈতিক গ্রুপটি দেশে অস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়—এমন গুজবও ছড়াচ্ছে, যা ভয়ংকর।

 
 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুজব ছড়ানো অন্য একটি গ্রুপ রয়েছে, যারা টাকা কামানোর উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে নানা ধরনের উসকানিমূলক তথ্য বা ভিডিও ছড়াচ্ছে। এরা মূলত ভিউ ব্যবসায়ী। এই দুই গ্রুপের ছড়ানো গুজব তৃতীয় পক্ষ না বুঝেই ছড়িয়ে দিচ্ছে বা শেয়ার করছে।

 

পুলিশের সাইবার ইউনিটের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাইবার স্পেস ব্যবহার করে সব সময়ই নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হয়ে থাকে। সম্প্রতি রাজনৈতিক ইস্যুভিত্তিক গুজব বেড়েছে। এই ধরনের গুজব সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করতে পুলিশের সাইবার ইউনিটগুলো সব সময়ই সাইবার স্পেসে টহল দিচ্ছে বা মনিটর করছে। সাম্প্রতিক সময়ে তা বাড়ানো হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এএফপির ফ্যাক্ট চেকিং বিভাগের অনুসন্ধানী সাংবাদিক মোহাম্মদ ইয়ামিন কালবেলাকে বলেন, ‘যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে অপতথ্য বা গুজব ছড়ানো হচ্ছে, তাদের অধিকাংশের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তিন থেকে চার দিন ধরে দেশে সেনাবাহিনীসহ নানা বিষয়ে ইস্যু বানিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভুয়া পোস্ট ও ভিডিও ছড়াতেও দেখা গেছে।’

তিনি বলেন, অনেক গ্রুপই এই গুজব বা অপতথ্যগুলো ছড়াচ্ছে। তবে একশ্রেণির অনলাইন কনটেন্ট ক্রিয়েটর এবং ২০২৪ সালে যে রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়েছে, তাদের নেতাকর্মী এবং সমর্থকরা বর্তমান সরকার এবং অন্যান্য সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোকে বিতর্কিত করতে, মবকে উসকে দিতে এবং আত্মগোপনে থাকা নিজেদের নেতাদের উৎসাহ দিতে এটা বেশি করছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ছড়ানো অপতথ্যগুলোর মধ্যে দেখা যায়, গত রোববার মধ্যরাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘তথ্য’ ছড়িয়ে পড়ে, ‘এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ গ্রেপ্তার হয়েছেন।’ এ ছাড়া ছড়িয়ে দেওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শত শত সদস্য দলবেঁধে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। যেটি দিয়ে কেউ কেউ ছড়িয়ে দেন যে, ঢাকার রাস্তায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নেমে পড়েছে। যদিও ওই রাতেই কালবেলা নিশ্চিত হয় যে, ফুয়াদকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ গ্রেপ্তার বা আটক করেনি। আর ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি রোববার রাতের দাবি করা হলেও, ফ্যাক্ট চেকাররা বলছেন, ওই ভিডিওটি গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাজশাহীতে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি অনুষ্ঠানের।

অবশ্য গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আসাদুজ্জামান ফুয়াদকে গ্রেপ্তারের গুজব ছড়িয়ে আওয়ামীপন্থি বেশ কিছু ব্লগার রোববার সারা রাত উত্তেজনা তৈরি করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশকে অস্থিতিশীল করা, সেনাবাহিনী ও ছাত্র-জনতাকে মুখোমুখি করে একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করা। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড় করানোর যে সুযোগ এসেছে, সেটি নস্যাতের জন্য এই চক্র (গুজব সৃষ্টিকারীরা) কাজ করছে।

এ ছাড়াও কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ‘প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছেন, জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠিত হচ্ছে’ বলেও অপপ্রচার চালানো হয়। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাস ঘিরেও নানা গুজব চলতে থাকে কয়েকদিন ধরে। এসব গুজবে বলা হয়, ওই নেতাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধরে নিয়েছে, কেউ কেউ গুজব ছড়ায় যে, তাকে ধরে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অনেক ফেসবুক আইডি থেকে এমন গুজবও ছড়ানো হয় যে, ‘বর্তমান সরকারের অনেক উপদেষ্টা দেশ ছেড়েছেন।’

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা, কর্মকর্তা, নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়াও ভিন্ন ধরনের অপতথ্যও ছড়াতে দেখা গেছে গত কয়েকদিনে। এসব গুজবের মধ্যে গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়া ‘শেখ হাসিনা দেশে ফিরছে, সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন’—এমন সব অপপ্রচারও চালানো হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (উত্তর) উপকমিশনার মহিউদ্দিন মাহমুদ সোহেল কালবেলাকে বলেন, গুজব ঠেকাতে সাইবার স্পেসে তাদের নজরদারি কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। কোনো ধরনের গুজব বা এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে অপরাধ সংঘটিত হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

বিভিন্ন ফেসবুক আইডি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব আইডি থেকে বর্তমানে রাজনৈতিক গুজব ছড়ানো হলেও কয়েক মাস আগে আইডিগুলো থেকে বিভিন্ন ভুয়া ও পুরোনো ভিডিও ছড়িয়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে গুজব ছড়ানো হতো।

ফ্যাক্ট চেকিং বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ইয়ামিন বলছেন, সাধারণ মানুষদের অনেকেই না জেনে বা যাচাই না করে এসব অপতথ্যে ভরা কনটেন্টগুলোতে শেয়ার দিচ্ছেন। অবশ্য অনেকের পক্ষে তা যাচাই করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি পরামর্শ দেন যে, যেসব আইডি বা অ্যাকাউন্ট থেকে অপতথ্য বা গুজব ছড়ানো হচ্ছে, সেই প্রোফাইলগুলোর কয়েক মাসের কার্যক্রম যাচাই করতে হবে। এতে দেখা যাবে ওই প্রোফাইল থেকে নিয়মিতই গুজব ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে এবং তা সরকারকে টার্গেট করে করা হচ্ছে। কিছু শেয়ার করার আগে এভাবে যাচাই করা যায়।

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা কালবেলাকে বলেন, সাধারণত জনমত প্রভাবিত করা, রাজনৈতিক বা সামাজিক ইস্যুতে মানুষকে বিভ্রান্ত করে কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শ বা ব্যক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে ধারা তৈরি করার জন্য সাইবার স্পেসে গুজব বা অপতথ্য ছড়ানো হয়ে থাকে। এই গ্রুপটি গুজব ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, জনগণের মধ্যে ভয়, উদ্বেগ বা ঘৃণা ছড়িয়ে সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে অপতৎপরতা চালায়।

তিনি বলেন, ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিল করতে, প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিপক্ষকে হেয় করতে এবং কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি নষ্ট করতেও অপতথ্য ছড়াতে দেখা যায়। এর বাইরে আরেকটি গোষ্ঠী আর্থিক লাভের জন্য ক্লিকবেইট নিউজ বা ভুয়া কনটেন্ট দিয়ে বেশি ভিউ বা শেয়ারের আশায় এটা করে থাকে। যে কারণেই গুজব ছড়ানো হোক, তা দীর্ঘমেয়াদে বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়, আইনি সমস্যা তৈরি হয় এবং সামাজিক বিভাজন বাড়ে। তাই তথ্য যাচাই করে শেয়ার করাই সবচেয়ে ভালো।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (উত্তর) উপকমিশনার হাসান মোহাম্মদ নাছের রিকাবদার কালবেলাকে বলেন, সাইবার স্পেসে মনিটরিং করে তারা দেখেছেন, পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। তবে পুলিশের সাইবার সদস্যরা ২৪ ঘণ্টা ধরেই নজরদারি করে আসছেন। পাশাপাশি ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের নির্দেশে এই গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন।